বদলে যাওয়া বাংলাদেশে তিন মাসের ব্যস্ত সফর

সালেক সুফী

পঞ্চম পর্ব

অন্নুনত দেশ থেকে উন্নতশীল দেশে উন্নীত হওয়ার অন্যতম উপকরণ দেশব্যাপী সহজ, নিরাপদ, বাধাহীন, সুলভ যাতায়ত ব্যবস্থা।  বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম নদীবাহিত পলিমাটি গঠিত বদ্বীপ।  ক্ষুদ্র কিন্তু বিশাল জনগোষ্ঠীর দেশে বিস্তির্ণ এবং নিবিড় সড়ক বা রেল যোগাযোগ স্থাপনের সুযোগ সীমিত। পর্যাপ্ত সুযোগ ছিল এবং আছে জলপথে যোগাযোগ আধুনিক করার।  কিন্তু ভারত এবং নেপাল থেকে শুরু হওয়া অনেক নদীতে উজানে বাঁধ দেয়ায় নদীপথ সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে।

অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে রাজধানী ঢাকা সহ বড় বড় শহরগুলো কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে। নগরের পাশের নদীগুলো বেদখল হয়ে গেছে, নগরে প্রবাহিত অনেক খাল মরে গেছে। এতশত সংকট সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিগত দুই দশকে দেশব্যাপী সড়ক, রেল, বিমান এবং জলপথে বিপুল বিনিয়োগ করে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া যোগাযোগ ব্যাবস্থায় যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে।  এই ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতু, পদ্মা বহুমুখী সেতু উত্তর এবং দক্ষিণ বাংলাকে একসুতোয় গেঁথে ফেলেছে।

ছোট দেশে ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, যশোর, সৈয়দপুর, বরিশাল, কক্সবাজার বিমানবন্দর থাকা কম কথা না। পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে রেল সংযোগের কারণে দক্ষিণাঞ্চল রেলপথেও ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে।  কিন্তু এতদসত্ত্বেও সরকারি সংস্থা সমূহের সমন্বিত কার্যক্রমের অবর্তমানে ঢাকা যানজট, জলজট, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ এবং বিপুল জনসংখ্যার কারণে এখন বিশ্বের বসবাসের জন্য অন্যতম নিকৃষ্ট শহর।

সুনাম নেই একই কারণে চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ শহর নিয়েও। প্রতিবারই বাংলাদেশ সফরকালে দেশের প্রত্যন্ত প্রান্তরে ছুটে বেড়াই। জানতে, বুঝতে চেষ্টা করি চ্যালেঞ্জগুলো। এবারের সফরে এক কালের তিলোত্তমমা ঢাকা মহানগরীকে অভিশাপ মুক্ত করার সরকার কর্তৃক সম্পাদিত কয়েকটি মেগা প্রকল্প নিয়ে জানতে চেষ্টা করেছি।

সকল সংস্থার সুসমন্বিত কার্যক্রম এবং মেট্রোপলিটন গভর্নেন্স ছাড়া ঢাকাকে যানজট মুক্ত করা যাবে না

ঢাকার আশীর্বাদ ছিল চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষা, তুরাগ, বালু নদী। ঢাকা মহানগরীকে তিলোত্তমা হিসাবে ধরে রাখার জন্য নদীগুলোকে দূষণ মুক্ত এবং অবৈধ দখল থেকে বাঁচিয়ে রাখা অপরিহার্য ছিল। দুনিয়ার অধিকাংশ প্রধান শহর একটি প্রধান নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। অথচ অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে নদীগুলো মারাত্মক দূষণে দুষ্ট, দখল হয়ে গেছে অনেকটা। এমনটি ঢাকার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত অধিকাংশ খালগুলো কালের আবর্তে ইতিহাস হয়ে গেছে।

রাজধানী হিসেবে, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসুবিধা, চাকরি সব ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ায় এবং দীর্ঘদিন ঢাকার সঙ্গে সমগ্র দেশের আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় ঘন জনবসতি পূর্ণ কংক্রিটের জঙ্গলে পরিণত হয়েছে ।  যে শহরে সর্বোচ্চ এক কোটি জনগণ সুখে থাকতে পারে সেখানে প্রায় তিন কোটি জনগোষ্ঠীর চাপে ঢাকার সবধরনের সেবামূলক কার্যক্রম নিদারুন চ্যালেঞ্জে।

শহরে মাত্র ৮-১০% সড়ক থাকায় তীব্র যানজট,  খাল-বিল মরে যাওয়া এবং উপযুক্ত পানি নিষ্কাশন ব্যাবস্থার অভাবে জলজট। সব সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয় না থাকা এবং জনসচেতনার অভাবে বায়ুদূষণ, শব্দ দূষণ ঢাকায় বসবাস অসহনীয় করে তুলেছে। এর মাঝেও কয়েকটি মেগা প্রজেক্ট শেষ হয়েছে, কয়েকটির বাস্তবায়ন চলছে ঢাকাকে যানজট মুক্ত এবং ঢাকার সঙ্গে পার্শবর্তী জেলাগুলোর যোগাযোগ ঝামেলা মুক্ত করার।

ঢাকা মেট্রো রেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে

ঢাকাকে যানজট মুক্ত করার জন্য এযাবৎ চালু হওয়া অন্যতম সফল উদ্যোগ স্বীকার করতেই হবে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল এবং এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে। ঢাকার অন্যতম যানজটের সড়ক বিমানবন্দর সড়ক এর ফলে কিছুটা হলেও চলাচলের জন্য সহনীয় হয়েছে। মেট্রোরেলের আরো কয়েকটি লাইন পরিকল্পনা অনুযায়ী বাস্তবায়িত হলে এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে একদিকে নারায়ণগঞ্জের কুতুবখালী অন্যদিকে আশুলিয়া থেকে নির্মাণাধীন এলেভেটেড এক্সপ্রেস সড়কে যুক্ত হলে যানজট অনেকটাই মুক্ত হবে।

আমি ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৃতীয় টার্মিনাল নির্মাণ যতই দৃষ্টিনন্দন হোক এটি সেখানে স্থাপন না করে ঢাকার বাইরে স্থাপন অনেক যুক্তিযুক্ত হতো মনে করি।  আমার কাছে পূর্বাচলের অত্যাধুনিক ৩০০ ফুট সড়ক এবং গাজীপুর থেকে নির্মাণাধীন ঢাকা বাইপাস সড়ক অধিকতর কার্যকর হবে বলে মনে করি।

কর্তৃপক্ষীয় অবহেলা, অদক্ষতা এবং দুর্নীতির কারণে গাজীপুর থেকে ঢাকা বিমানবন্দর পর্যন্ত নির্মাণাধীন বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট অভিশপ্ত প্রকল্পে পরিণত  হয়েছিল। যাহোক এটি অবিলম্বে চালু হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হবে। ময়মনসিংহ , টাঙ্গাইল সহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের যানবাহন দক্ষিণ বঙ্গে যাওয়ার সময় ঢাকায় যানজট সৃষ্টি করবে না।

ঢাকার যানজট স্থায়ীভাবে নিরসনের জন্য আমার কিছু পর্যবেক্ষণ এবং সুপারিশ

ঢাকা মহানগরীর বিশাল অঞ্চল জুড়ে সামরিক স্থাপনা,  ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং স্থাপনা রয়েছে। সময় এসেছে পিলখানার কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষিত রেখে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদর দপ্তর ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়ায়। একই সঙ্গে ঢাকা সেনানিবাস বর্তমান স্থানে রেখে ঢাকায় যানচলাচল সংকুচিত রাখাও অর্থহীন। বিমানবাহিনীকে কেন তেজগাঁ বিমানবন্দর দখল করে রাখতে হবে।

পাশাপাশি আমি ঢাকার কেন্দ্রস্থল থেকে সচিবালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজের মূল ক্যাম্পাস ঢাকার বাইরে সরিয়ে নেওয়ার সুপারিশ করবো। ঢাকার আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালগুলো সায়েদাবাদ, মহাখালী, গাবতলী থেকে সরিয়ে  নেওয়া জরুরি।  একই সঙ্গে কাওরানবাজার কাঁচাবাজার অবিলম্বে স্থানান্তর করা সঙ্গত।  জানি কাজগুলো যে কোনো সরকারের পক্ষে কঠিন এবং বিব্রতকর।

ঢাকার সঙ্গে পার্শবর্তী শহর নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া,কুমিল্লা, ফরিদপুর দ্রুতগামী শাটল কমিউটার সার্ভিস চালু হলে ঢাকার উপর জনসংখ্যার চাপ অনেক কমবে। অনেকেই নিজ নিজ শহরে থেকে নিত্য ঢাকায় যাতায়াত করতে পারবে।

আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঢাকার মাটির নিচে স্থাপিত গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ পয়ঃনিষ্কাশন লাইনগুলো চিহ্নিত করে আন্ডারগ্রাউন্ড ম্যাপিং করা জরুরি। দুনিয়ার সব শহরে এখন আর্ক জিআইএস ব্যবহার করে এই কাজ করা হচ্ছে। আশা করি সরকার ভেবে দেখবেন।

একসময়ের সবুজ ঢাকা শহর এখন কংক্রিটের জঞ্জাল। দীর্ঘদিন দুনিয়ার অন্যতম সেরা শহর মেলবোর্নে বাস করে নিজের শহর ঢাকায় ফিরে অনেক অসঙ্গতি চোখে পড়ে। সরকারের পাশাপাশি জন সচেতনতা অপরিহার্য। এবার ঢাকার উত্তরা বাসায় থেকে মশার যন্ত্রণা এবং গ্যাস সরবরাহ সংকটে ভুগেছি। সেই সব প্রসঙ্গে পরে লিখবো। চাই কেউ যেন আমার প্রিয় শহর ঢাকাকে আর বেশি দিন যানজট, জলজট, শব্দ দূষণ, বায়ুদূষণের কারণে বসবাসের অনুপুযুক্ত না বলতে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 − 8 =