একটি না-বলা গল্প

মৌ সন্ধ্যা

মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। যে দেশের আলো হাওয়ায় বেড়ে উঠছি আমরা, যাদের ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন মাতৃভূমি পাওয়া; সেই ইতিহাস তো জানতেই হবে। আমাদের শেকড় হলো মুক্তিযুদ্ধ। তিরিশ লক্ষ শহীদের লড়াইয়ের গল্প জানলে দেশের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হবে। দেশকে নতুন করে সাজাবে তরুণ প্রজন্ম। এই কারণে তাদের আরও বেশি করে জানা প্রয়োজন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। তরুণ প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানার একটি বড় সহায়ক হলো মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা। রঙবেরঙ তুলে ধরছে একেকটি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার পেছনের গল্প। এই সংখ্যার সিনেমা ‘একটি না বলা গল্প’। মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি সিনেমাটিতে উঠে এসেছে ১৯৮৮ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রসঙ্গ। চলুন জেনে নেওয়া যাক সিনেমাটি সম্পর্কে।

মুক্তির আলোয়

মাত্র এক বছর আগে আলোর মুখ দেখেছে সিনেমাটি। ‘একটি না-বলা গল্প’ মুক্তি পায় ২০২৩ সালের ১০ মার্চ। সারাদেশে ৮টি সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছিল, পরে প্রিমিয়ার হয়েছে টেলিভিশনেও। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পটভূমিতে নির্মিত সিনেমাটির কাহিনি, সংলাপ, চিত্রনাট্য রচনার সাথে সাথে পরিচালনা ও প্রযোজনা করেছেন পঙ্কজ পালিত। সিনেমাটি চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের নজর কাড়তে সক্ষম হয়। এটি পঙ্কজ পালিত পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। সিনেমাটির কাহিনিকার বিশ্বজিৎ চৌধুরী।

সিনেমার কলাকুশলী

সিনেমাটিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রওনক হাসান, প্রাণ রায়, রুনা খান, আরিফুল ইসলাম, রাকিব হোসেন ইভন, নাঈমা আনজুমান মুন, আহসানুল হক মিনু, শ্রেয়সী গ্রোতস্বিনী, মার্জিয়া আক্তার ও নরেশ ভূইয়া। সিনেমার গানগুলোর সুরকার ছিলেন সৈয়দ সাবাব আলী আরজু। চিত্রগ্রাহক ছিলেন রুবেল মুন্সী। সম্পাদনায় ছিলেন হালিম আহমেদ অতিশ।

কী আছে সিনেমায়

১৯৮৮ সাল স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশ উত্তাল হয়। আন্দোলনকারীদের দমন করতে চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী তৎপর, পুলিশের গুলিতে মারা যায় এক তরুণ। হাসপাতালের বিছানায় সেই তরুণ যখন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে, তখন তার বাবা সিদ্ধান্ত নেন পরিবারের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধের এমন কিছু কথা বলবেন, যা এতদিন তিনি গোপন রেখেছিলেন। বেরিয়ে আসে কিছু অনাকাক্সিক্ষত সত্য। জানা যায়, এতদিন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সব সুযোগ-সুবিধা নিলেও তিনি আসলে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। এমন এক রহস্যময় গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে এই সিনেমা।

যেভাবে মিলেছে সিনেমার কাহিনি

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতায় সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরীর লেখা ‘মৃত্যু যেভাবে বাঁচায়’ নামে একটা গল্প ছাপা হয়। পঙ্কজ পালিত গল্পটি পড়ে সিদ্ধান্ত নেন এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানাবেন। বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সে গল্প অবলম্বে চিত্রনাট্য লিখে অনুদানের জন্য জমা দেন পংকজ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে সরকারি অনুদান পেলে তার প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন।

শুটিংয়ের দিনগুলি

চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ শুরু হয় ২০২১ সালের ৮ জানুয়ারি। এর বেশির ভাগ দৃশ্য ধারণ করা হয়েছে চট্টগ্রাম, বান্দরবান, পুবাইল ও নবাবগঞ্জে। চলচ্চিত্রটিতে রওনক হাসান মুক্তিযোদ্ধা আর তার স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুনা খান। চট্টগ্রাম পর্ব শেষ করে পরবর্তী সময়ে শুটিং হয় বান্দরবান ও পুবাইলে। সিনেমার গল্পের চমক মুগ্ধ করে রেখেছিল শুটিং টিমকে। বেশ আবেগ ও আনন্দ নিয়ে তারা সিনেমাটির কাজ শেষ করেন।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচার

২০২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি টেলিভিশনে প্রিমিয়ার হয় ‘একটি না-বলা গল্প’ চলচ্চিত্রের। ওইদিন দুপুর ২টার বাংলা সংবাদের পর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় সিনেমাটি। বর্তমানে ইউটিউবেও দেখা যায় এটি। দর্শকরা ঘরে বসেই ইচ্ছা করলে সিনেমাটি উপভোগ করতে পারেন।

পরিচালকের ভাষ্য

চলচ্চিত্রটির পরিচালক পঙ্কজ পালিত নানা সময় চলচ্চিত্রটি নির্মাণের পেছনের গল্প শুনিয়েছেন। তিনি বলেন, আমার মনে পড়ে একদিন বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘মৃত্যু যেভাবে বাঁচায়’ গল্পটি পড়ি। গল্পটি আলোড়ন তুলে আমার মধ্যে। তখনও তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। তার সঙ্গে যোগাযোগ করি, উনি খুব উৎসাহী হলেন। তিনি সম্মতি দিলেন ছবি বানানোর জন্য। আমার তৈরি স্ক্রিপ্ট মুক্তিযুদ্ধ চলচ্চিত্র বিভাগে অনুদান পেয়ে গেল। আমার মনে হয় আমি যতটা খুশি হয়েছিলাম তার চেয়ে বিশ্বজিৎদা বেশি খুশি হলেন। স্ক্রিপ্ট উনাকে দেখালাম। ছবি তৈরি হয়ে গেল। লেখকের সঙ্গে পরিচালকের মেলবন্ধন হয়ে গেল, যা সাধারণত হয় না। আমি বাণিজ্যিক ছবির পক্ষে থাকলেও আমি কখনো ইচ্ছাকৃতভাবে বাণিজ্যিক ধারার ছবি নির্মাণে যাব না। আমি ছবিতে বার্তা দিতে চেয়েছিলাম দর্শকদের। সত্য ঘটনা তুলে ধরেছেন লেখক। আমি সেই গল্প পর্দায় নিয়ে গেলাম। ৮-৫ পাতার একটি গল্প ছিল। সেটিকে চিত্রনাট্যে রূপ দিলাম। সিনেমাটিক ফর্মে কনভার্ট করলাম। কিছু পরিবর্তন সংযোজন করলাম। কিছু সংলাপ এনেছি।

আমি বলবো ‘একটি না বলা গল্পের’ জন্য এক ঘণ্টা ৪৬ মিনিট আপনার জীবন থেকে আমার জন্য ব্যয় করতে হবে। এটি সিনেমা নয়, এটি স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের দলিল, ইতিহাস। এ ঘটনাটি আপনাকে জানতেই হবে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের কথা বলি, বঙ্গবন্ধুর কথা বলি। আমরা কতটুকু লালন করি জানি না। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রদের ভূমিকা কী ছিল, আপনারা জানেন। কিন্তু আজকের প্রজন্ম সেই ইতিহাস থেকে অনেক দূরে। ছবির ঘটনাটি আপনারা উপলব্ধি করবেন। কতটুকু উত্তীর্ণ হয়েছি সেটি আপনারাই বিবেচনা করবেন। আমি এই ছবি করতে কখনো ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করিনি। লোকেশন বুঝতে চেষ্টা করেছি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও আশির দশককে আনা কতটা কঠিন ব্যাপার তা আপনারা জানেন। আশির দশকে ছাত্রদের পোশাক কেমন ছিল, রাস্তাঘাটের অবস্থা কেমন ছিল। আজ কোথাও ক্যামেরা বসাতে পারি না। সব জায়গায় সাইনবোর্ড। এত সাইনবোর্ড ছিল না। এক ঘণ্টা ৪৬ মিনিটের ছবিটি ধৈর্য ধরে দেখতে হবে। ছবি নির্মাণে যারা সহযোগিতা করেছেন সবার প্রতি কৃতজ্ঞ।

গল্পকার বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ভাষ্য

একটি চলচ্চিত্রের মূল শক্তিই হলো গল্প। এই চলচ্চিত্রটির গল্প লিখেছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমি অনেক আগে এ গল্পটি লিখেছিলাম। আমার সঙ্গে পরিচালকের পরিচয় ছিল না। তার প্রস্তাব পেয়ে সানন্দে সম্মত হয়েছি। আমাদের প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি শিশু বয়সে। ফলে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে গেলে শৈশবের স্মৃতিই ভরসা। কিংবা পরিণত বয়সে কারও স্মৃতিচারণ বা বইপুস্তক। আমি বলি, আমাদের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ ছিল নব্বইয়ের গণআন্দোলন। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারিকে সামনে রেখে ফ্ল্যাশব্যাকে ১৯৭১ এর ঘটনাবলি বর্ণনা করতে চেয়েছি। সেদিন মোজাম্মেলের বুকে না লেগে গুলি আমাদের বুকে লাগতে পারত। কারণ আমরা সবাই রাজপথে ছিলাম। সেদিন অনেককে দাফন-কাফন করা হয়নি। আমরা দেখেছি সেদিন বলুয়ার দীঘির শ্মশানে কোনো ধর্ম পরিচয় না জেনে অনেককে দাহ করা হয়েছে। এ নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করি ‘চট্টগ্রাম গণহত্যা’ নামে। শিশু বয়সের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পড়াশোনা আর ২৪ জানুয়ারির ঘটনা নিয়ে গল্পটি লিখেছিলাম। গল্পটি যোগ্য লোকের হাতে পড়েছে।’

যে কারণে চট্টগ্রামে প্রথম শো

২০২২ সালের ৫ আগস্ট বিকেলে ‘একটি না বলা গল্প’র প্রথম হাউস ফুল প্রিমিয়ার শো হয় চট্টগ্রামে। কেন চট্টগ্রামে প্রথম প্রিমিয়ার হয়েছিল পরিচালক পঙ্কজ পালিত বলেন, ‘এ গল্পের লেখক চট্টগ্রামের, কাহিনিও চট্টগ্রামের। তাই ভাবলাম আমার এই ছবির উদ্বোধনী প্রদর্শনী চট্টগ্রামে হওয়া উচিত। আমি মনে করি চলচ্চিত্র নির্মাণ ঢাকা কেন্দ্রিক। ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে ছবি তৈরি হচ্ছে স্থানীয় ভাষায়। আমি মনে করি চট্টগ্রামে একদিন সিনেমা ফ্যাক্টরি হবে। এখানকার ছেলেরা ছবিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে।’

শেষকথা

‘একটি না-বলা গল্প’ সিনেমাটি দেখলে দর্শক বুঝবেন এটি একটি আধুনিক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা। ক্যামেরার কাজেও আছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। পরিচালক তার দক্ষতা দেখিয়েছেন নানা ভাবে। মুুক্তিযুদ্ধেও যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাতে নতুন একটি সংযোজন ‘একটি না-বলা গল্প’। সুযোগ করে সিনেমাটি দেখে নেওয়া হবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। একজন পাঠকেরও যদি সিনেমাটি দেখতে ইচ্ছে করে, তাহলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × three =