শূন্য কিভাবে আসলো?

গোলাম মোর্শেদ

পৃথিবীতে যত সংখ্যা রয়েছে তা মাত্র দশটি সংখ্যা দিয়ে তৈরি করা সম্ভব। সব চেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে ০ সংখ্যাটা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ কোনো সংখ্যার শেষে বসালে তার দাম বাড়তে থাকে। শূন্য মানে ‘কিছু না’ আবার শূন্যই একটি সংখ্যা। ১ মানে একটি জিনিস, ২ মানে দুটি, কিন্তু শূন্য মানে কী? যা নেই তা আবার সংকেত দিয়ে প্রকাশ করার কী দরকার? শূন্যের কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু শূন্য ছাড়া আমরা অচল। কিন্তু এই শূন্য আবিষ্কার হলো কিভাবে?

সুমেরীয় সভ্যতাকে পৃথিবীর প্রথম সংগঠিত সভ্যতা হিসেবে গণ্য করা হয়। সুমেরীয় সভ্যতার মানুষেরা আজ থেকে ৪০০০ থেকে ৫০০০ বছর আগে প্রথম গণনা ব্যবস্থার প্রচলন করে। খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৯৪ অব্দে মেসোপটেমিয়ায় এসে সুমের ও আক্কাদ নগরীর মাঝামাঝি ব্যাবিলন নামক স্থানে একটি সভ্যতা গড়ে তোলে। এটিই ব্যাবিলন সভ্যতা নামে পরিচিত। পরবর্তীতে এই গণনা ব্যবস্থা ব্যাবিলনী সভ্যতার মানুষেরা  গ্রহণ করে। ব্যাবিলনী সভ্যতার মানুষেরা সুমেরীয়দের থেকে প্রাপ্ত কিউনিফর্মে লিখতো। শুধুমাত্র খালি জায়গা না রেখে ব্যাবলনীয়রা শূন্যকে একটু ভিন্ন মাত্রা দেওয়ার চেষ্টা করে। তারও ৬০০ বছর পর ব্যাবিলন থেকে ১২,০০০ মাইল দূরে মায়া সভ্যতার গণিতবিদরাও ক্যালেন্ডারে শূন্যকে ‘খালি জায়গা’ নির্দেশক হিসেবে স্থান দেয়।

আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রিক গণিতবিদ ইউক্লিড জ্যামিতির উপর লেখা তার ‘এলিমেন্টস’ গ্রন্থে যে ধরনের গাণিতিক পদ্ধতির আলোচনা করেছেন সেটাই এখন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নামে পরিচিত। কিন্তু মিশরীয়রা সযত্নে তাকে হঠিয়ে কোনোরকম জোড়াতালি দিয়ে সমস্যার সমাধান করতো। কারণ শূন্য ব্যাটা হলো শয়তানের সহচর, ঈশ্বরের পরিপন্থী, ঈশ্বরকে অস্বীকার করে এই পাপিষ্ঠ। তাই শূন্যকে যে করেই হোক ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করতো তারা। সেকালের গ্রিক পণ্ডিতেরা জ্ঞানার্জনের জন্য মিশরে যেতেন। মিশরীয়রা তো শূন্যকে অস্বীকার করতো অনেকটা দেখেও না দেখার ভান করার মতো। কিন্তু গ্রিক পণ্ডিতেরা শূন্যকে রীতিমতো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলেন। পরবর্তীতে এই ভীতির দলে অসীমও যোগ দিয়েছিল। কারণ অসীম মানে সীমাহীন, আর ঈশ্বর হলেন অসীম। জাগতিক সবকিছুই সীমার মাঝে বিদ্যমান এটাই ছিল মিশরীয় পণ্ডিতদের বদ্ধমূল ধারণা।

গ্রিক পণ্ডিত পিথাগোরাস তো শূন্য এবং অমূলদ কথা শুনলেই কঠিন শাস্তি দিতেন। তার মতে, শূন্য হলো শয়তানের দোসর আর অমূলদ সংখ্যা হলো বিশ্বপ্রকৃতিতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী। কারণ গণিতবিদ পিথাগোরাস একজন সঙ্গীতজ্ঞও ছিলেন। বলা চলে, গণিতই তাকে সঙ্গীতের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। পিথাগোরাসের শূন্যভীতি তো সভ্যতাক্রমিক কিন্তু অমূলদ সংখ্যার প্রতি বিতৃষ্ণার কারণ হলো তিনি খেয়াল করেছেন যে তারের বাদ্যযন্ত্রগুলোতে যখনই মূলদ সংখ্যার অনুপাতে টোকা দেওয়া হয় তখনই সুরেলা আওয়াজ বের হয়। কিন্তু যখনই তা অমূলদ হয়ে যায় তখনই সেখান থেকে বেসুরো আওয়াজ বের হতে থাকে।

কিন্তু হিপসাস নামক এক হতভাগা শিষ্য সর্বপ্রথম অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্ব টের পেয়েছিলেন (২ এর বর্গমূল যে একটি অমূলদ সংখ্যা তা হিপসাসই আবিষ্কার করেছিলেন) এবং তা প্রকাশ করার অপরাধে তাকে পানিতে ডুবে স্বেচ্ছা মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হয়েছিল। কিন্তু সত্য একদিন বেরিয়ে আসবেই। পিথাগোরাস নিজেই অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছিলেন। গোল্ডেন রেশিও বা সোনালি অনুপাত হলো সেই সৌন্দর্যময় সংখ্যা, প্রকৃতিতে যার হাজারো উদাহরণ রয়েছে।

ভারতীয় উপমহাদেশে শূন্য ক্ষুদ্র আকারে চর্চা হয়েছিল। কারণ ভারতীয়রা মা ব্রহ্মার প্রতীক হিসেবে শূন্য গণনা করতো। তাদের মতে শূন্য ও অসীম ব্রহ্মারই দুই রুপ। ৪৫৮ খ্রিষ্টাব্দে ঋদবেগ গ্রন্থে শূন্যর প্রথম অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। এটি হিন্দুধর্মের একটি পবিত্র গ্রন্থ। সংস্কৃতে শূন্যকে ‘শূনিয়া’ বা খালি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছিল। এছাড়াও ভারতের গোয়ালিয়রের এক মন্দিরের শিলালিপিতেও শূন্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। শূন্যের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় আরেক গ্রন্থ বাকশালি পাণ্ডুলিপিতেও, তিন থেকে চার  খ্রিষ্টপূর্বে এ গ্রন্থটি লেখা হয়। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকে আলেক্সান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করলো ভারতীয়রা তাদের সৈন্যদের মাধ্যমে ব্যবিলনীয়দের গণনা শাস্ত্রের কথা জানতে পারে। যেহেতু শূন্যের কোনো মান ছিল না তাই কোনো সভ্যতা শূন্যকে গ্রহণ করেনি। তবে ভারতীয়রা জানতে পারে ব্যবিলনীয়রা শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে গ্রহণ না করলেও সংখ্যাব্যবস্থায় ‘স্থানরক্ষক’ হিসেবে গ্রহণ করেছে। এরই সূত্র ধরে ভারতীয়রা শূন্যকে নিগৃহীত হতে দিলেন না। শূন্যকে তারা ১০ ভিত্তিক সংখ্যামালায় স্থান দিলেন।

ব্রহ্মগুপ্ত নামক এক গণিতবিদ ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দে শূন্যকে সংখ্যা হিসেবে প্রথম ব্যবহার করেন।  তিনি শূন্য দিয়ে যোগ, বিয়োগ, গুণও করেছিলেন। শূন্য দ্বারা যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ করার ফলে তিনি দেখতে পান শূন্য দিয়ে কোনো সংখ্যাকে যোগ বিয়োগ করলে সেই সংখ্যাই পাওয়া যায়। শূন্য দিয়ে গুণ করলে শূন্যই পাওয়া যায়। মূল সমস্যা তৈরি হয় শূন্য দ্বারা ভাগ করার সময়। তিনি ভাগ করতে গিয়ে ভুল করে ফেলেন, শূন্য দিয়ে ভাগ করে তিনি ফলাফল শূন্যই দেন। তবে সেই ভুলে বেশিক্ষণ থাকতে হয়নি। ১২শ শতাব্দীতে ভারতীয় গণিতবিদ দ্বিতীয় ভাস্কর প্রমাণ করেন শূন্য দ্বারা কোনো কিছু ভাগ করলে তার ফলাফল শূন্য হয় না বরং তা অসীম হয়।

ভারতীয়দের মাঝে প্রথম শূন্যকে সংখ্যায় মর্যাদা দেন তখনকার সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গণিতবিদ আর্যভট্ট। ২৩ বছর বয়সে আর্যভট্ট ‘আর্যভটিয়া’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন যা শ্রেষ্ঠ বই হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বইটির অধিকাংশ লেখাই ছিল গ্রহ নক্ষত্র নিয়ে। চন্দ্রগ্রহণ, সূর্যগ্রহণের সঠিক কারণ, পৃথিবী যে তার অক্ষের উপর দিনে একবার ভ্রমণ করে তা আর্যভট্ট জানিয়েছিলেন।

লিওনার্দো ফিবোনাচি নামক এক ইতালীয় শিক্ষার্থী আফ্রিকায় যান উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য। কথাটা শুনে অবাক লাগলেও তখনকার সময়ে মুসলমান সম্প্রদায় এতোটাই সমৃদ্ধ ছিল যে পশ্চিমারা যেত মুসলমান সম্প্রদায়দের কাছে। ফিবোনাচি মুসলিম গণিতজ্ঞদের কাছে শিক্ষা নেন এবং সময়ের পরিক্রমায় তিনি গণিতবিদ হয়ে উঠেন। তিনিই ভারতের ‘শূনিয়া’ আরবের ‘সিফর’ পশ্চিমাদের মাঝে তুলে ধরেন যা ধীরে ধীরে পশ্চিমে ‘জিরো’তে পরিণত হয়।

শূন্য এমন এক সংখ্যা বড় সংখ্যার সঙ্গে গুণ করা হলে কোনো অস্তিত্ব থাকে না। কোনো সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে তা অসীম হয়ে যায়। অপরদিকে কোনো সংখ্যার পিছনে শূন্য বসালে সংখ্যার মান তত বাড়তে থাকে। বড়োই অদ্ভুত আর রহস্যময় এক সংখ্যা। দৈনন্দিন জীবনে শূন্য সব ধরনের হিসাব নিকাশের সঙ্গে মিশে আছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 2 =