মুক্তার গহনা

নাহিন আশরাফ

সোনা, রুপা, হীরা ইত্যাদি উপাদান দিয়ে তৈরি হয় নারীদের নানা রকম গহনা। এরমধ্যে সবচেয়ে সাশ্রয়ী কিন্তু অভিজাত গহনার উপাদান হলো মুক্তা। সোনার কদর কমে আসলেও কমতে দেখা যায়নি মুক্তার কদর। পুরো বিশ্বজুড়ে সকল শ্রেণির নারীদের মধ্যে মুক্তা বেশ জনপ্রিয়। আজ জেনে নেওয়া যাক মুক্তার গহনার খুঁটিনাটি।

প্রাকৃতিকভাবে ঝিনুকে মুক্তা থাকলেও মূলত মুক্তা বাণিজ্যিকভাবে চাষ বেশি করা হয়। মুক্তা কিভাবে চাষ করা যায় তা আবিষ্কার করেন জাপানের ককিচি মিকিমটো। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, তিনি নাকি রোজ কয়েকটি করে মুক্তা খেতেন শরীর ভালো রাখার জন্য। সব ঝিনুকের মধ্যেই কিন্তু মুক্তা থাকে না। প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া মুক্তা ও চাষ করা মুক্তার মধ্যে রয়েছে অনেক তফাত। প্রাকৃতিক মুক্তার উজ্জ্বলতা চাষ করা মুক্তার চেয়ে অনেক বেশি। গভীর সমুদ্রে দামি-মুক্তার খোঁজে থাকেন অনেকে, যাদের বলা হয় মুক্তাডুবুরি। এই মুক্তা সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রাণ হারান অনেকে। এতো সাধনার মুক্তা দিয়ে তৈরি করা হয় নানা ধরনের গহনা ও সামগ্রী। মুক্তা যে শুধু গহনা হিসেবে ব্যবহৃত হয় তা নয়; পোশাক, জুতা, ব্যাগ ইত্যাদিতে মুক্তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

একটা সময় ছিল যখন অভিজাত নারীরা জর্জেট শাড়ি ও গলা ভরতি মুক্তার মালা পরতেন। মুক্তার মালায় প্রকাশ পেত তাদের আভিজাত্য ও সৌন্দর্য। রাজা বাদশা এবং জমিদারদের বিভিন্ন ছবিতে দেখা যায় গলায় ভারী মুক্তার মালা। জমিদার বাড়ির নারীরাও এক প্যাচের শাড়ির সাথে নানা ধরনের মুক্তার গয়না পরতেন। সুতরাং বোঝা যায় এক সময় নারী-পুরুষ উভয়ই মুক্তা ব্যবহার করতো। বহু যুগ ধরেই মুক্তার গয়নার ব্যবহার দেখা যায়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে নারীদের ওয়েস্টার্ন পোশাক ও গাউনের সাথেও মুক্তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। পোশাকের সাথে মিল রেখে ইউরোপের নারীরা যেসব টুপি পরতেন সেসব টুপির মধ্যেও মুক্তার ব্যবহার দেখা যায়। মুক্তার রঙ সাদা হলেও পোশাকের রঙের সাথে মিলিয়ে মুক্তার উপরে বিভিন্ন পাথরের কাজ করা হয়। অন্যান্য উপাদানের ব্যবহার মুক্তার আভিজাত্য আরও বাড়িয়ে তোলে।

দেশ-বিদেশ থেকে নানা ধরনের মুক্তা সংরক্ষণ করা অনেকের শখ। মুক্তার আসল রঙ মূলত সাদা, কিন্তু গোলাপি ও বেগুনি আভার মুক্তাও রয়েছে। তবে নীল, আকাশি, কালো ইত্যাদি রঙের মুক্তাও এখন বানানো হয়। অনেকে পোশাকের রঙের সাথে মিলিয়েও মুক্তার গয়না বানিয়ে নিচ্ছেন কারিগর দিয়ে। মুক্তার গয়না যেকোনো বয়সী নারীদের সাজের সাথেই মানিয়ে যায়। অনেক সময় ছোটদের সাজে অন্যান্য গয়না মানানসই না হলেও গলায় হালকা গড়নের মুক্তার মালা পরিয়ে দেওয়া হলে সুন্দর লাগে। বয়স্কদের সব ধরনের গয়না না মানালেও, মুক্তার গয়না পরলে তাদেরও বেশ ভালো লাগে।

নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্যও মুক্তা উপযোগী। অনেকেই অন্য গয়না না পরলেও কানে সবসময় মুক্তার ছোট টপ পরে থাকেন। দেশীয় কিংবা ওয়েস্টার্ন সব ধরনের পোশাকের সাথে মুক্তার গয়না ভালো মানায়। এমনকি সালোয়ার কামিজ কিংবা কুর্তির উপরেও মুক্তার মালা পরলে বেশ রুচিশীল ও মার্জিত লাগে। মুক্তার মালা নানারকম ডিজাইনের পাওয়া যায়। অনেকে সরু চেইনের মতো মুক্তার মালা পরে থাকেন, আবার অনেকে কয়েক লেয়ারের মুক্তার মালা পরেন। মুক্তার চোকারও বেশ জনপ্রিয় যা শাড়িসহ বিভিন্ন পোশাকের সাথে পরা হয়। মুক্তার চোকারের মধ্যে কুদন কিংবা নানা ধরনের পাথরের দিয়ে নকশা করা হয়ে থাকে। খুব জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক হলে চেইন আকারের মুক্তার মালা পরা যেতে পারে। আবার সাদামাটা পোশাক পরে দুই তিন লহর মুক্তার মালা ঝোলানো গহনা মানানসই বেশি। কানে মুক্তার টপ সবচেয়ে বেশি পরা হলেও মুক্তার নানাধরনের ঝুলন্ত কানের দুলও পাওয়া যায়। ঝুলন্ত মুক্তার কানের দুলের নিচে ব্যবহার করা হয় নানান ধরনের পাথর।

এছাড়া আরো পাওয়া যায় মুক্তার আংটি, ব্রেসলেট ইত্যাদি। মুক্তার সাথে ফিউশন করে সোনা ও রুপা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ফিউশনের জন্য কাঠ, পিতল, রুদ্রাক্ষ ইত্যাদি উপাদানের সাথে মিলিয়েও মুক্তার গয়না বানানো হয়। ঐতিহ্যবাহী গয়নার নকশায় এর সঙ্গে ব্যবহৃত হচ্ছে সোনা, পান্না, রুবি ইত্যাদি। সোনার আংটির উপর মুক্তা বসিয়ে আংটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হয়। গহনা ছাড়াও চুলের সাজেও মুক্তার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। খোঁপা কিংবা বেনি করে ছোট মুক্তা গেঁথে নেওয়া যেতে পারে। যারা হালকা ধরনের গয়না পরতে চান তাদের জন্য মুক্তার গয়নার কোনো জুড়ি নেই। চেইনের সাথে মিলিয়ে অনেকে মুক্তার লকেট পরে থাকেন। জামদানি কিংবা যেকোনো দেশীয় শাড়ির সাথে মুক্তার লকেট বেশ সুন্দর লাগে। জাঁকজমকপূর্ণ সাজের জন্য মুক্তার মধ্যে নানাধরনের পাথরের ব্যবহার করা হয়। আজকাল বিয়ের কনেরাও বেছে নিচ্ছেন নানা নকশার মুক্তার গয়না।

ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথে কেমন ধরনের গয়না পরা যায় তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন অনেকেই। সাধারণত সবধরনের গয়না ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথে পরা যায় না। কিন্তু যারা ওয়েস্টার্ন পোশাকের সাথে গয়না পরতে চান তাদের প্রথম পছন্দ হতে পারে মুক্তার গয়না। টপস,স্কার্ট, টি-শার্ট যেকোনো পোশাকের সাথে গলায় পরে নেওয়া যেতে পারে হালকা গড়নের মুক্তার মালা। যারা অন্য ধরনের গয়না পরতে বেশি পছন্দ করেন না তারা হাতে শুধু মুক্তার ব্রেসলেট পরে নিতে পারেন। নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য মুক্তার গয়না বেশ উপযোগী। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে চট করে পরে নেওয়া যেতে পারে মুক্তার কানের দুল কিংবা ব্রেসলেট। তাই তো তরুন প্রজন্ম থেকে বয়স্ক সকলের পছন্দ মুক্তা।

বাজারে এখন আসল ও নকল মুক্তা মিলেমিশে একাকার। তাই মুক্তা কেনার সময় আসল মুক্তা চিনতে হিমশিম খেতে হয় অনেকেরই। আসল মুক্তা মসৃণ ও গোলাকার হবে। আসল মুক্তার উপর কখনোই দাগ থাকে না, এমনকি আগুনের উপর ধরা হলেও আসল মুক্তার উপর কোনো রকম দাগ বসে না। তবে নকল মুক্তার মালার মধ্যে ছোট ছোট দাগ লক্ষ্য করা যায়। মুক্তার দাম কেমন হবে তার নির্ভর করছে কোথা থেকে কেনা হচ্ছে এবং মুক্তার গুণগত মান কেমন। বাণিজ্যিকভাবে এখন প্রচুর পরিমাণে মুক্তার চাষ হবার কারণে দাম এখন কিছুটা সাশ্রয়ী। চাষ করার কারণে মুক্তা এখন শুধু সাদা রঙে আটকে নেই। বিভিন্ন রঙের মুক্তা এখন বাজারে দেখতে পাওয়া যায়। ৮০ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক হাজার টাকায় মুক্তার গয়না পাওয়া যায়। মুক্তার দাম অনেক সময় হয়ে যায় লাখ টাকা যখন এর সাথে সোনা কিংবা হীরার ব্যবহার থাকে। আড়ং, বসুন্ধরা সিটি, কমপ্লেক্স, যমুনা ফিউচার পার্ক, পিংক সিটি ইত্যাদি জায়গায় মুক্তার গহনা পাওয়া যায়। কিছু সোনার দোকানে আলাদা করে মুক্তা বিক্রি করা হয়।

মুক্তার গয়না সঠিকভাবে সংরক্ষণ করার জন্য কাঠের কিংবা কাপড়ের বাক্স ব্যবহার করতে পারেন। সারাদিন মুক্তার গয়না পরে থাকলে সেটি রাখার আগে সুতির কাপড় কিংবা তুলা দিয়ে ভালো করে ঘাম ও ময়লা মুছে রেখে দিন। মুক্তার গয়নার উপর সরাসরি পারফিউম ব্যবহার করবেন না এতে এর বর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। মুক্তার গয়না কয়েকদিন পর পর আলমারি থেকে বের করে আলো বাতাসে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে গয়না ভালো থাকবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ফ্যাশন

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − ten =