শিখা চিরন্তন নেভে না কখনো

নিবিড় চৌধুরী

আমাদের জাতীয় জীবনের সঙ্গে ৬৮ একরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান জড়িয়ে আছে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে। এখানেই রচিত হয়েছে বাঙালির ইতিহাসের গৌরবময় দলিলপত্র! এক নয়, একাধিক। সেকথা আমরা জানব একটু পর। তার আগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিচয় তুলে ধরা যাক। সময়ের ব্যবধানে এর অনেক পরিবর্তন রূপান্তর ঘটেছে, সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। শাহবাগে অবস্থিত এ উদ্যানের পূর্ব নাম রমনা রেসকোর্স ময়দান বা রমনা জিমখানা। ব্রিটিশ আমলে এখানে ঘোড় দৌড় প্রতিযোগিতা হতো, যেটা ঢাকা রেসকোর্স নামে পরিচিত ছিল। পরে এ উদ্যানের নামকরণ করা হয় অখণ্ড ভারতে বাঙালির অধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নামে। যিনি বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক গুরুও।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে রয়েছে এক স্মৃতিস্মারক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে উদ্যান গেইটে যার অবস্থান। সেই স্মারকের নাম শিখা চিরন্তন। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু এই স্থানে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিয়েছিলেন। দিয়েছিলেন স্বাধীনতার ডাক, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দিব, তবুও বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণের স্মৃতি চিরস্মরণীয় করে রাখতেই নির্মিত হয় শিখা চিরন্তন। ১৯৯৭ সালের ২৬ মার্চ ‘শিখা চিরন্তন’ উদ্বোধন করা হয়।

৭ই মার্চের ভাষণ ছাড়াও আরেকটি কারণে এ স্থান ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আত্মসমর্পণ করেছিল পাকিস্তান বাহিনী। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে তৎকালীন ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দানে জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। রচিত হয় আমাদের বিজয়গাথা। সেই আত্মসমর্পণের দলিলের নাম ছিল  ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অভ সারেন্ডার’ যা ঢাকার পতন বলেও পরিচিত।

বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতা ফিরে পায়নি। এরপর ২৩ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভূতপূর্ব এক উদ্যোগ নেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরের এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধরে রাখতে ১৯৯৬ সালে ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপনের উদ্যোগ নেন। এ উপলক্ষ্যে পরের বছর ৭ই মার্চ শেখ হাসিনা ‘শিখা চিরন্তন’ প্রজ্বলন করেন। সেদিন দেশব্যাপী শোভাযাত্রার উদ্বোধনও করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন ১৭ মার্চ। ১৯৯৭ সালে বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁর জন্মস্থান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ছুঁয়ে স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পৌঁছায় ‘শিখা চিরন্তন’। শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওই দিন ‘শিখা চিরন্তন’ স্থাপন করেন বিশ্বনন্দিত চার নেতা – শান্তিতে নোবেল বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক রাষ্ট্রপতি ও মানবতাবাদী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, মুসলিম বিশ্বের অবিসংবাদিত নেতা ও ফিলিস্তিনের সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাত, তুরস্কের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী সুলেমান ডেমিরেল এবং বাংলাদেশের তৎকালীন ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন অনুষ্ঠানে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ। ১৯৯৯ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সেদিন স্থাপিত হয় শিখা চিরন্তন, যার আগুন কখনো নেভে না। গত ২৫ বছর ধরে শিখা চিরন্তনের আলো একটুর জন্যও নেভেনি। অনির্বাপিত এই আগুন। নামেই তো বলে দেওয়া, ‘চিরন্তন’। যে শিখা জ্বলবে সর্বক্ষণ। বাঙালির লড়াকু হৃদয়ের মতো।

‘শিখা চিরন্তন’কে অনেকে ‘শিখা অনির্বাণ’ ভেবে ভুল করেন। নামে কিছুটা মিল থাকলেও দুটি আলাদা, চেতনাগতভাবেও। তবে মিল একটি জায়গায়, এ দুই স্তম্ভের আগুন কখনো নিভে না। ‘শিখা অনির্বাণ’ হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেকটি স্মৃতিস্তম্ভ। মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী সকল সৈনিকদের স্মৃতিকে জাতির জীবনে চির উজ্জ্বল রাখার উদ্দেশ্যে এই স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন করা হয়। যেখানে সার্বক্ষণিকভাবে জ্বালিয়ে করে রাখা হয় শিখা। এটি স্থাপন করা হয়েছে ঢাকা সেনানিবাসস্থ কুর্মিটোলা গলফ ক্লাব ও সেখানকার কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন এলাকায়।

কোনো ঐতিহাসিক স্মৃতি বা চিহ্নকে স্মরণীয় করে রাখতে আমেরিকা-রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শিখা জ্বালিয়ে রাখা বা স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করার বিষয়টি বেশ পুরানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যারা রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে সে দেশজুড়ে বেশ কয়েকটি এই ধরনের স্মৃতিস্তম্ভের শিখা রয়েছে, যা সবসময় জ্বলতে থাকে।

‘শিখা চিরন্তন’ এর পটভূমি ও ইতিহাসের দিকে তাকালে এর গুরুত্ব আরও ভালোভাবে উপলব্ধি করা যাবে। এখানে মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেওয়া বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল আগুনের শিখার মতো, যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। আগুন ধরিয়ে দেয় সাধারণ মানুষের মনে। সেই শিখা পরে মুক্তিযুদ্ধের দাবানল হয়ে ওঠে। ৭ থেকে ২৫ মার্চ – এ ১৮ দিনে বঙ্গবন্ধুর সেই অগ্নিঝরা ভাষণ বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষকে প্রস্তুত করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ নিয়ে রচিত হয়েছে অসংখ্য বই, ডকুমেন্টারি। এই ভাষণকে তুলনা করা হয় আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী কৃষ্ণাঙ্গদের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের ১৯৬৩ সালের ২৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে লাখ লাখ মানুষের মিছিলের শেষে দেওয়া সেই ভাষণের সঙ্গে। লুথার কিংয়ের কারণেই আমেরিকার ২০০ বছরের বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন পরিণতি পায়। সেই আন্দোলন চলাকালেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন তিনি। ১৯৬৮ সালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে শ্বেতাঙ্গ ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান ইতিহাসের এই মহান নায়ক। বঙ্গবন্ধুও প্রাণ হারিয়েছিলেন আততায়ীদের হাতে, ৫৫ বছর বয়সে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির নিজ বাসভবনে একদল ঘাতক বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে।

জার শাসনামল ধ্বংস করে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে লেলিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রাশিয়ায়। তার চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না বাঙালির কাছে মার্চের ওই ১৮ দিন। সাধারণ মানুষদের ওপর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড দেখে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণাটি আসে ২৬ মার্চের প্রথমে প্রহরে। এরপর শুরু হয় ৯ মাসের মুক্তির লড়াই।

বঙ্গবন্ধু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। সেদিন সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালি নেতার ভাষণ শুনতে লাখো মানুষের ঢল নামে। জড়ো হয় আপামর মানুষ। সবাই ছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনার অপেক্ষায়। সেদিনই বঙ্গবন্ধুর বজ্রকণ্ঠ শুনে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে জেগে উঠেছিল পুরো বাঙালি জাতি। সাহস ও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতার বীজ রোপণ করেন লাখো বাঙালির মনে। বলতে গেলে শত্রু ঘাঁটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণ দিয়েছিলেন। আজও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচিহ্ন ধরে রেখে জ্বলছে ‘শিখা চিরন্তন’।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten + 5 =