পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী: বাংলাদেশের থিয়েটারে মনস্তাত্ত্বিক মিউজিকের অভাব আছে

ইরানী বিশ্বাস

মানুষ যেদিন থেকে সভ্য হয়েছে, সেদিন থেকে সুস্থ বিনোদনের জন্ম হয়েছে। সভ্য সমাজে বিনোদনের একটি প্রাচীন মাধ্যম থিয়েটার। থিয়েটারের অন্যতম অংশ জুড়ে রয়েছে মিউজিক। এবছর পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি থেকে থিয়েটারের মিউজিক সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। পণ্ডিত দিশারী চক্রবর্তী এই সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। ২০০৫ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত ১৪০টিরও বেশি থিয়েটারে মিউজিক করেছেন তিনি। তারমধ্যে ৪০টিরও বেশি থিয়েটার এনএসডি (ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামা) নিউ দিল্লিতে নির্বাচিত হয়েছে। পণ্ডিত দিশারী ৩০ বছর বাবা আলাউদ্দিন খান সাহেবের পরিবারে থেকে শাস্ত্রীয় যন্ত্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। একইসঙ্গে তিনি আরো অন্যান্য গুরুর কাছ থেকে ৬ ধরনের যন্ত্রে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা দান করছেন পণ্ডিত দিশারী। এছাড়া তিনি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ফিল্ম মেকিং, মিউজিক এবং সাউন্ড ডিজাইনে বিশেষ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে সেখানে কাজ করেছেন।

তার সঙ্গে থিয়েটারের মিউজিক নিয়ে আলাপচারিতার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।

পণ্ডিত দিশারী বলেন, থিয়েটারে মিউজিক করার জন্য প্রথমে যেটা জানা দরকার তা হলো, মূলত থিয়েটারের ক্ষেত্রে দুই ধরনের মিউজিক হয়। মিউজিকের দুটি ধারা রয়েছে। একটি হলো ভারবাল অর্থাৎ যেখানে টেক্সট রয়েছে। অন্যটি হলো নন ভারবাল। অর্থাৎ যার কোনো টেক্সট নেই। এ দুই ধারার মধ্যে নন ভারবাল পুরোপুরিভাবে মিউজিকের উপর ডিপেন্ডেবল। এখানে মিউজিক শুধুমাত্র মিউজিকের মতো নয়। মিউজিকের রিলেশন হয় সাউন্ডের সাথে। যে কারণে মিউজিকের অ্যাপ্লিকেশনটা সাউন্ডের মতো হতে হয়। কখনোই নরমাল মিউজিকের মতো নয়। অর্থাৎ শাস্ত্রীয় সংগীত যেভাবে বাজে সেরকম নয়। থিয়েটারে ভারবাল টেক্সট যদি থাকে সে ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। এখানে ডায়ালগ থাকে। ডায়ালগ শুনে বোঝা যায় আর্টিস্ট কী বলতে চেয়েছেন। ডায়ালগটা দুঃখের, সুখের না কি রোমান্টিক। সেজন্য নন ভারবাল থিয়েটারে মিউজিকের ভূমিকা অনেক বেশি থাকে। এখানে মিউজিক দিয়ে পুরো সিচুয়েশান বোঝাতে হয় দর্শকদের। মিউজিকের সঙ্গে আর্টিস্টের মুভমেন্ট হয়, তাই মিউজিক হয়ে যায় প্রধান সাবজেক্ট ।

দ্বিতীয়ত টাইম এবং স্পেসের জ্ঞান থাকতে হবে। যখন পাণ্ডুলিপি পড়া হয় তখন কাউন্ট করতে হবে এই দৃশ্যটা পড়তে কতো সময় লাগছে। আর্টিস্ট কখন মুভমেন্ট করবে বা স্টেজে তার জায়গা বদল করবে। এসব কাউন্ট করে মিউজিক করতে হয়। মিউজিক কমপ্লিট করার পর মিউজিকের সঙ্গে রিহার্সেল করতে করতে আর্টিস্টের পরিপূর্ণ ধারনা হয়, কতো সময় পর তাকে মুভমেন্ট করতে হবে। অথবা ডায়ালগ থ্রো করতে হবে। তবে সমস্যা হয় যখন রিহার্সেল রুম এবং ফাইনাল স্টেজ একই মাপের হয় না। অনেক সময় দেখা গেল পড়ার সময়, সময় নিয়ে পড়া হচ্ছে কিন্তু অতটা সময় নিয়ে রিহার্সেল হচ্ছে না। আবার রিহার্সেল যেখানে হচ্ছে সেই স্টেজের চেয়ে বড় বা ছোট পরিসরে ফাইনাল শো হচ্ছে। তখন আর্টিস্টের মুভমেন্ট বদলে যেতে পারে। সুতরাং মিউজিক এমন ভাবে করতে হবে যাতে নাটক যেখানেই প্রদর্শন হোক না কেন, ডায়ালগ থ্রোয়িং এবং মুভমেন্ট যেন একই হয়।

পণ্ডিত দিশারী আরও বলেন, আমি সবসময় একটু ভিন্নভাবে মিউজিক করি। অনেকটা ফিল্মিক অ্যাপ্রোচে মিউজিক করি। আমার নোট টু নোট মিলতে হবে। এভাবে সাধারণত থিয়েটারে মিউজিক করা হয় না। থিয়েটারের মিউজিকে অনেকটা খোলা ভাব থাকে। লম্বা একটা মিউজিক দেওয়া থাকে। যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু বাজিয়ে তারপর ফেড আউট করে দেয়। আমার ক্ষেত্রে এমন হয় না। আমি পারফেক্টলি যেটুকু অভিনয় বা মুভমেন্ট হচ্ছে সেটুকুর জন্যই মিউজিক করি। একটু বেশিও না কমও না। যে কারণে রিহার্সেল শুরুর আগেই আমি মিউজিক করি। আমার মিউজিকের সাথে রিহার্সেল শুরু করা হয়। প্রথমে থিয়েটার গ্রুপ বা নির্দেশকও বুঝতে পারতেন না। এই ধরনটা চালু করতে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। দিনের পর দিন আমাকে রিহার্সেলে থাকতে হয়েছে। এমনকি প্রথম ৩/৪ বছর মিউজিক প্লে করতে হতো আমাকে। কারণ সহকারিরা বুঝতো না। পরবর্তীতে শুধু রিডিংয়ে যেতাম আর বাড়ি বসে মিউজিক করে সহকারিকে বুঝিয়ে দিলেই হয়ে যেত।

পণ্ডিত দিশারী বলেন, প্রথম থেকে যখন কাজ শুরু করলাম তখন থেকে আমি খুবই সচেতন ছিলাম এ ব্যাপারে। আমার পূর্ববর্তী যারা মিউজিক করতেন তারা টাইম অ্যান্ড স্পেস নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামাননি। কিন্তু আমি খুব বেশি সিরিয়াস ছিলাম। এতে সুবিধা হলো, আপনি যেখানে যে অবস্থাতে নাটক দেখবেন একই রকম লাগবে। স্টেজে চাইলেও কেউ ইম্প্রুভাইজ করতে পারে না বা নাটক নিয়ে হেলাফেলা করতে পারে না। অনেক সিনিয়র আর্টিস্টরা মাঝে মধ্যেই মনে করেন কো-আর্টিস্টদের ডায়ালগ শুনে ডায়ালগ বললেই হয়ে যাবে। কিন্তু আমার মিউজিকের ক্ষেত্রে তা হবে না। এখানে ডায়ালগ এবং মুভমেন্টের সময় নির্ধারিত। তাই নিজের মতো ডায়ালগ দিলে মিউজিকে গন্ডগোল হয়ে যাবে।

তৃতীয় হলো অ্যাপ্লিকেশনস অব টেকনোলজি সাইন্স। প্রাচীনকাল থেকে থিয়েটারে ভীষণভাবে একটা পৌরানিক পদ্ধতিতে মিউজিক করা হতো। সাধারণত টেপরেকর্ডার বা সিডি বাজানো হতো। আমি ২০০৫ সালে প্রথম থিয়েটারে মিউজিক করতে আসি। তখন থেকেই আমার নিজস্ব পদ্ধতি চালু করেছি। কম্পিউটারাইজড পদ্ধতিতে রেকর্ডিং করা, থিয়েটার দেখে দেখে ছোট ছোট লুপ তৈরি করা। তারপর সেগুলো জুড়ে পরিপূর্ণ মিউজিক তৈরি করা। মিউজিক ডিজাইন একটা সাবজেক্ট। যদি ফিল্মের ক্ষেত্রে হতে পারে, তাহলে থিয়েটারের ক্ষেত্রে নয় কেন? সুতরাং আমি সেই জায়গা থেকে মিউজিক ডিজাইনকে থিয়েটারে অ্যাপ্লাই করার চেষ্টা করেছি। প্রথম দিকে আর্টিস্টদের বোঝাতে সমস্যা হতো। তারা তাদের এতদিনের তৈরি করা পথ থেকে সরে আসতে রাজী হতেন না। এর অবশ্য কারণ আছে। বাংলা থিয়েটার জগতে যত বিখ্যাত নির্দেশক, নাট্যকার বা অভিনেতা আছেন তারা অনেকেই মনে করেন, থিয়েটার স্কুল থেকে পড়ালেখা করেছি, আমি অনেক কিছুই জানি।

পণ্ডিত দিশারী জানান, তবে একটা কথা বলতে চাই,  থিয়েটার স্কুলে কখনোই মিউজিক ডিজাইন নিয়ে পড়ানো হয় না। যার কারণে থিয়েটারে মিউজিকের ব্যবহার বেশ অবহেলিত। বিশেষ করে বাংলা থিয়েটারে। আমি বোঝাতে সক্ষম হলাম, থিয়েটারে মেকআপ, লাইট, কস্টিউম সবকিছুতে যদি ডিজাইন থাকে তাহলে মিউজিক ডিজাইন কেন থাকবে না। আমার পূর্ববর্তী যারা থিয়েটার মিউজিক করেছেন তারা শুধু মিউজিক কম্পোজ করতেন। আমি ‘ফিল্ম এবং অডিও মিউজিক’ নিয়ে ফিল্ম ইনস্টিটিউটে পড়ালেখা করে তখন সদ্য এসেছি। কখনো ভাবিনি থিয়েটারে মিউজিক করবো। এসময় বিখ্যাত অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের অভিনীত এবং নির্দেশক বিপ্লব বন্দোপাধ্যায়ের একটি নাটকে মিউজিক করার অফার পেলাম। আমি তাদের বলেছিলাম, আমি আপনার নাটকে মিউজিক ডিজাইন করতে চাই। তবে একটা শর্ত আছে, গল্পের সঙ্গে আমি যেভাবে মিউজিক করবো, ঠিক সে অনুযায়ী অ্যাক্টিং, ডায়ালগ থ্রোয়িং এবং মুভমেন্ট করতে হবে। এভাবেই থিয়েটারে নতুনভাবে আমার মিউজিকের যাত্রা শুরু হয়। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ওয়েস্টার্ন, হিন্দি এবং বাংলা থিয়েটারে মিউজিক করে যাচ্ছি। এখন যারা নতুন করে মিউজিকে কাজ করছেন তারা চেষ্টা করছে আমার দেখানো পথে হাঁটতে।

বাংলাদেশের থিয়েটার নিয়ে পণ্ডিত দিশারী বলেন, আমি বাংলাদেশের যে কয়টি থিয়েটার দেখেছি তাতে মনে হয়েছে, বাংলাদেশ ফোক মিউজিকে সমৃদ্ধ। এ কারণে ফোক মিউজিককে কেন্দ্র করে যখন থিয়েটার নাটক তৈরি হচ্ছে তখন সেটা পাওয়ারফুল হচ্ছে। ফোক থিয়েটারে বাহ্যিক সংগীতের ব্যবহার আছে। উত্তেজনা বোঝাতে, আনন্দ বোঝাতে, কষ্ট বোঝাতে, রোমান্টিকতা বোঝাতে যে ধরনের মিউজিক দরকার তার ব্যবহার আছে। অর্থাৎ রুরাল থিয়েটার উৎরে যাচ্ছে ফোক মিউজিকের কারণে। কিন্তু আরবান গল্প অর্থাৎ শহুরে জীবন-যাপন নিয়ে যে নাটক তৈরি হচ্ছে সেখানে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মানসিক টানাপোড়েনের গল্প থাকে। এসব বোঝাতে যে ধরনের মিউজিক দরকার, সেই স্ট্যান্ডার্ডের মিউজিক হচ্ছে না। অর্ন্তদ্বন্দ্ব, আকাক্সক্ষা বোঝাতে যে ধরনের মিউজিক দরকার অর্থাৎ মনস্তাত্ত্বিক মিউজিকের অভাব আছে। মনস্তাত্ত্বিক হচ্ছে যে বিষয়টা উপস্থাপন করা হয় না অথচ উপস্থিত আছে। ডায়ালগে প্রকাশ করা হয় না, শুধু অনুভব করা যায়। সেই বিষয়টা শুধুমাত্র মিউজিকে উপস্থাপন করা সম্ভব। এখানে মিউজিক নিজেই একটা সাবজেক্ট হয়ে যায়।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 × four =