সালেক সুফী
শবে মাত্র শেষ হয়েছে বাংলাদেশ-শ্রীলংকা ক্রিকেট সিরিজ ২০২৪। এবারের সফরে দুটি দল তিন ম্যাচের টি ২০, তিন ম্যাচের ওডিআই এবং দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজ খেলেছে। এবারেই প্রথম বিদেশী কোন দল সব ম্যাচ খেলেছে ঢাকার বাইরে সিলেট এবং চট্টগ্রাম। প্রায় সমশক্তির দল দুটির টি ২০ এবং ওডিআই সিরিজে হাড্ডা হাড্ডি লড়াইয়ের পর অতিথি দল টি ২০ সিরিজ জিতেছে ২-১, বাংলাদেশ ওডিআই সিরিজ জিতেছে ২-১। অথচ টেস্ট সিরিজে বাংলাদেশের শীর্ষ স্থানীয় কিছু অপরিহার্য খেলোয়াড় না খেলায় এবং টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে বাংলাদেশের কোনো টেকসই পরিকল্পনা না থাকায় অতিথি দল টেস্ট সিরিজে একতরফা প্রাধান্য বিস্তার করে ২-০ জয়ী হয়ে ধবল ধোলাই করেছে বাংলাদেশকে।
সবার প্রশ্ন সাদা বলের ক্রিকেটে এতো ভালো খেলেও টেস্ট ক্রিকেটে কেন ভরাডুবি হলো ? কেনো বাংলাদেশ দলকে এত ছন্নছাড়া দেখা গেলো ? জবাব ক্রিকেট সংশ্লিষ্ট সবার জানা। তবু ক্রিকেট অনুরাগীদের কথা বিবেচনায় পুরো সিরিজ পর্যালোচনা করছি।
শুরুতেই বিসিবিকে বাহবা দিবো সিরিজগুলো ঢাকা শেরে বাংলা ন্যাশনাল ক্রিকেট স্টেডিয়ামের ধীর, নিচু, ঘূর্ণি উইকেটের পরিবর্তে সিলেট জাতীয় স্টেডিয়ামের সবুজ ঘাসে ঢাকা পেস বোলিং সহায়ক উইকেট এবং চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের স্পোর্টিং উইকেটে খেলা হয়েছে। এই ধরণের উইকেটে ঘরোয়া ক্রিকেট সচরাচর খেলা না হলেও এখানে খেলায বাংলাদেশ ক্রিকেটে দীর্ঘস্থায়ী শুভ প্রভাব সৃষ্টি হবে।
সিলেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত টি২০ সিরিজে বাংলাদেশ ১-২ ব্যাবধানে সিরিজ হেরে গেলেও বাংলাদেশ তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি করে। ভাগ্য সহায় হলে ফলাফল বাংলাদেশের অনুকূলে ২-১ হতে পারতো। এবাদত, সাকিব, মুশফিক দলে ছিল না। তবুও বাংলাদেশের পেস বোলিং সহায়ক উইকেটে ভালো বোলিং করেছে। তবে টপ ব্যাটসম্যানরা কাঙ্খিত নৈপুণ্য প্রদর্শনে ব্যার্থ হলে মিডল অর্ডার এবং লেট্ অর্ডারে প্রচন্ড চাপে পড়ে। নতুন নির্বাচক মন্ডলী জাকের হোসেন অনিককে দল ভুক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়। লেট্ অর্ডারে মাহমুদুল্লাহর সঙ্গে মারকুটে ব্যাটসম্যান জাকের আলী অনিক যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশের দীর্ঘ দিনের একটি সমস্যা সমাধানের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কিছু আগে বিপিএল শেষ হওয়ায় বাংলাদেশ টি ২০ সিরিজের জন্য প্রস্তুত ছিল। নতুন অধিনায়ক দল পরিচালনায় দক্ষতা দেখায়। সিরিজে দুই দলের মাঝে খুব একটা ব্যাবধান দেখা যায় নি।
চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ওডিআই সিরিজে বাংলাদেশ যোগ্য দল হিসাবেই ২-১ সিরিজ জিতেছে। সবাই জানে সাদা বলের ওডিআই ফরম্যাটে বাংলাদেশ অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দল। দেশের মাটিতে বাংলাদেশ এই ফরম্যাটে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দলের বিরুদ্ধে জিতেছে। তবুও বলবো দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান লিটন উপর্যুপুরি ব্যার্থতার কারণে বাংলাদেশের টপ অর্ডার ভালো সূচনা দিতে পারেনি। নির্বাচকরা তৃতীয় ম্যাচের আগে লিটনকে দল থেকে ছেটে ফেলে। সিরিজে প্রথম সুযোগে তানজিদ তামিম ভালো খেলে। তবে যদি সিরিজে এবং টি ২০ সিরিজে আবিষ্কার ছিল লেগ স্পিনিং অলরাউন্ডার রিশাদ হোসেন।দুই সিরিজে দুটি বিধংসী ইনিংস খেলে নিজেকে নতুন ব্লাস্টার হিসাবে উপস্থাপন করে। উপযোগী উইকেটে চমৎকার বোলিং করে বাংলাদেশের পেস বোলারসরা।
সাদা বলের সিরিজ দুটি সিরিজ শেষে কোন ধরণের প্রস্তুতি এবং পরিকল্পনা ছাড়াই অপেক্ষাকৃত নবীন অনভিজ্ঞ দল নিয়ে পুরোপুরি প্রস্তুত ভারসাম্যপূর্ণ শ্রীলংকা দলের বিরুদ্ধে খেলে বাংলাদেশ। তাসকিন, শরিফুলকে বিশ্রাম দেয়া হয়, খালেদের সাথে নবীন নাহিদ রানাকে এবং হাসান মাহমুদকে সুযোগ পায়। মুশফিক ওডিআই সিরিজে আহত হওয়ায় টেস্ট সিরিজ থেকে ছিটকে পড়ে। এমনিতেই বাংলাদেশ লাল বলের ক্রিকেটকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়না। ঘরোয়া ক্রিকেট হয় আন্ডার প্রিপেয়ার্ড উইকেটে দায় ছাড়া ভাবে। এমতাবস্তায় ভালো ফর্মে থাকা অধিক ভারসাম্য পূর্ণ শ্রীলংকা দলের সঙ্গে ব্যাবধান ছিল বিস্তর। সিরিজে দুই টেস্টে চার ইনিংসের তিনটিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং শোচনীয় ভাবে বার্থ হয়। সিলেটের বোলিং সহায়ক উইকেটে বাংলাদেশ দায়িত্ব হীন ভাবে ব্যাটিং করে। দুটি ইনিংসে বাংলাদেশের নড়বড়ে ব্যাটিং ২০০ রান করতেও বার্থ হয়। টেস্ট স্পেশালিস্ট মোমিনুল ছাড়া অন্য সবাই শোচনীয় ভাবে ব্যার্থ হয়। নৈশ প্রহরী তাইজুল ব্যাট হাতে যত টুকু লড়াই করেছে তার ছিটেফোঁটা দেখা যায়নি বাংলাদেশ টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানদের মাঝে। পেস সহায়ক উইকেটে আতঙ্কগ্রস্ত মনে হয়েছে। কিছু আউটের ধরণ ছিল রীতিমত লজ্জাজনক। খালেদ, রানা, মিরাজ ভালো বোলিং করলেও বেশ কিছু ক্যাচ ফস্কালে ৩৩৮ রানের বিশাল ব্যাবধানে জয়ী হয় শ্রীলংকা। দুই দলের টপ অর্ডার একই ভাবে ব্যার্থ হলেও ব্যাবধান গড়ে দেয় দুই ইনিংসে যুগল শতরান করা ধনঞ্জয়া ডি সিলভা এবং কামিন্দু মেন্ডিস। অথচ প্রথম ইনিংসে শুন্য রানে কামিন্দুকে ফিরিয়ে দেয়ার সুযোগ এসেছিলো।
চট্টগ্রাম টেস্টে অভিজ্ঞ চৌকষ খেলোয়াড় সাকিব আল হাসান যুক্ত হলে তিন স্পিনার,দুই পেসার নিয়ে দল সাজায় বাংলাদেশ। দুর্ভাগ্য জনক ভাবে টস হেরে বোলিং করতে হয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ বোলাররা ভালো বোলিং করে চাপ সৃষ্টি করলেও ৬-৭ ক্যাচ ফস্কে যায়। শ্রীলংকার ছয় ব্যাটসম্যান ৫০ উর্দ্ধ স্কোর করলেও কেউ শতরান করতে পারেনি। ৫৩১ রান করে অতিথি দল বাংলাদেশকে কোনঠাসা করে ফেলে। উইকেটে সিলেটের মত সহায়তা ছিলো না বোলারদের জন্য। কিন্তু তবুও বাংলাদেশ ব্যাটিং প্রথম ইনিংসে আনাড়ীর মত ব্যাটিং করে ১৭৮ রানে গুটিয়ে যায়। লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটে অনভিজ্ঞতা নিদারুন ভাবে ফুটে ওঠে। এই ইনিংসে জাকির হাসান (৫৪) এবং মোমিনুল (৩৩) ছাড়া কেউ দাঁড়াতেই পারেনি। আসিথা ফের্নাদো (৪/৩৪), লাহিরু কুমারা (২/১৯), বিশ্ব ফের্নাদোর (২/৩৮) কুশলী বোলিং মোকাবিলায় আনাড়ির মত ব্যাটিং করে বাংলাদেশ। ৫৩১ রানের মোকাবিলায় ১৭৮ রান করে বলা যায় টেস্ট থেকে ছিটকে পরে বাংলাদেশ।
দ্বিতীয় ইনিংসে টেস্ট অভিষিক্ত হাসান মাহমুদ (৪/৬৫) এবং খালেদ (২/৩৪) সংহারী মূর্তিতে আবির্ভুত হলে শ্রীলংকা দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৭/৭ ইনিংস করে। সিরিজে এটি ছিল বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম সময়। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গাছে প্রথম ইনিংসে ৩৩৩ রানে পিছিয়ে থাকায় বাংলাদেশের সামনে ছিল ৫১১ রানের পাহাড়। সিরিজের শেষ ইনিংসে ব্যাটসম্যানরা দায়িত্ব নিয়ে খেলায় প্রথম বারের মত ২০০, ৩০০ পেরিয়ে সম্মানজনক পরাজয়ে ইনিংস শেষ করে। প্রায় সবাই ভালো শুরু করেও মিরাজ, মোমিনুল ছাড়া কেউ ইনিংস বড় করতে পারেনি। এখানেও লংগার ভার্সন ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতার কারণে। দেশের মাটিতে ২-০ টেস্ট সিরিজ হেরে লজ্জাজনক ধবল ধোলাইয়ের কলঙ্ক তিলকে বরণ করে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ দুঃখজনক হলেও ২৪ বছর টেস্ট ক্রিকেট খেলেও টেস্ট সংস্কৃতি গড়ে তুলতে পারেনি। ঘরোয়া লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেটের নিম্নমান এই পরিস্থির জন্য প্রধানত দায়ী, লঙ্গার ভার্সন ক্রিকেট নিয়ে বিসিবির পরিকল্পনা প্রশ্ন সাপেক্ষ। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট হয় আন্ডার প্রিপেয়ার্ড উইকেটে দায় ছাড়া গোছের। সেখানে জাতীয় দলের খেলোয়াড়রা কালেভদ্রে খেলে। ঘরোয়া ক্রিকেটে পেস বোলার বা লেগ স্পিনারদের জন্য সুযোগ থাকে না. সহজ ব্যাটিং উইকেটে থাকে রানের বন্যা। তদুপুরি ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রমাণিত সফল অনেক ব্যাটসম্যানকেই সুযোগ দেয়া হয়না জাতীয় দলে। এবারের জাতীয় দলটি ছিল তারুণ্য নির্ভর। স্পোর্টিং উইকেটে খেলতে এসে মুষড়ে পরে অনভিজ্ঞ নবীন খেলোয়াররা। চট্টগ্রাম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে কোনো অজানা কারণে আগের ইনিংস গুলোতে আতঙ্ক গ্রস্ত ছিল। বোলাররা প্রতিটি ইনিংসে ভালো বোলিং করেছে। কিন্তু অত্যন্ত নিম্ন মানের ফিল্ডিংয়ের কারণে বোলারদের কৃতিত্ব ম্লান হয়ে গাছে।
মনে পড়ছে কিংবদন্তি ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটার স্যার গর্ডন গ্রিনিজের কথা। বাংলাদেশ টেস্ট স্টেটাস অর্জনের প্রাক্কালে বলেছিলেন “টেস্ট ক্রিকেট খেলার জন্য প্রস্তুত নয় বাংলাদেশ” দুই দশক পরে দেশে বিদেশে প্রচুর ক্রিকেট খেলেও কি বাংলাদেশ টেস্ট ক্রিকেট খেলতে কী যোগ্য হয়েছে?
আশা করি নতুন নির্বাচক মন্ডলী, ক্রিকেট অপারেশন্স টেস্ট ক্রিকেটে টেকসই উন্নয়নের জন্য বাস্তব সম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। মেধাবী তরুণদের নিয়ে গড়া দল স্পোর্টিং উইকেটে খেললে প্রথম দিকে ব্যার্থ হবে। কিন্তু এদের উপর আস্থা রাখলে দুই তিন বছর পর ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ। তবে ঘরোয়া দীর্ঘ পরিসর ক্রিকেটের অনেক গুণগত সংস্কার করতে হবে। তিন ফরম্যাটের জন্য তিন ধরণের দলের নিউক্লিয়াস গড়ে তুলতে হবে। নাজমুল হোসেন শান্ত কে তিন ফরম্যাটে দলনায়ক বানানো হয়েছে। ওকে সময় দিতে হবে। আন্ডারডগ দলকে নেতৃত্ব দেয়া সহজ নয়। তবে অন্তত টেস্ট ক্রিকেটে মমিনুলকে দলনায়কের দায়িত্বে ফিরিয়ে এনে মেহেদী মিরাজকে সহ অধিনায়কের দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
সাফলক সূফি, ক্রীড়া বিশ্লেষক