অনলাইনে পার্ট টাইম কাজের নামে প্রতারণার ফাঁদ

আশফাক আহমেদ

তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছেন দেশের হাজারো তরুণ-তরুণী। শুধু তাই নয়, সময় ও কর্মস্থলের বাধ্যবাধকতা না থাকায় এবং দক্ষতা ভেদে অর্থ উপার্জনের সুযোগ থাকায় অনলাইনে বিভিন্ন কাজে যুক্ত হচ্ছেন নানাবয়সী নারী-পুরুষ। অনলাইনে কাজের পরিসর ও জনপ্রিয়তা যেমন বাড়ছে পাশপাশি বাড়ছে প্রতারকদের দৌরাত্ম্য। নতুন নতুন উপায়ে আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে মানুষের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। বের করছে অভিনব সব প্রতারণার ফাঁদ।

সম্প্রতি দেশে অনলাইনে কাজ দেওয়ার নামে নতুন করে নানা ধরনের প্রতারণার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। এরমধ্যে অন্যতম পার্ট টাইম কাজের লোভনীয় প্রস্তাব দিয়ে হোয়াইটস অ্যাপে যোগাযোগ করতে বলা। পরবর্তীতে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। কিছুদিন আগে এধরনের ঘটনা নিজের সাথে হয়েছে। যদিও প্রতারণার ফাঁদে পা দেইনি তবে কিছুটা ধারণা হয়েছে। নিজের উপলব্ধি থেকে অনলাইনে কাজ করেন কিংবা কাজে আগ্রহী কয়েক জনের সাথে কথা বলি। জানতে পারি তাদের সাথেও নানা কায়দায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

এবার নিজের ঘটনায় আসা যাক। ফেইসবুকে রিল দেখা অনেকেরই অভ্যাস বা বাজে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যাই হোক রিল দেখার সময় বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপন আসে যেখানে লেখা পার্ট পাইম কাজের সুযোগ। যোগাযোগ করতে হবে হোয়াটস অ্যাপে। লিংকে ক্লিক করলে সেখান থেকে একটি হোয়াটস অ্যাপ নম্বর আসে। সেখানে আগ্রহ প্রকাশ করে কাজের বিষয়ে জানতে চাই। মেসেজে জানানো হয়, বয়স হতে হবে কমপক্ষে ২২ বছর, প্রতিদিন ১ থেকে ৩ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। তারা অ্যামাজন, দারাজের মতো বিভিন্ন ই-কমার্স প্লাটফর্মে পণ্য বিক্রিতে সহযোগিতা করতে হবে। যাকে বলা হয় ভার্চুয়াল শপিং। কাজ বা বিক্রিত পণ্য ভেদে ১ হাজার থেকে ৩৮ হাজার টাকা পর্যন্ত আয়ের সুযোগ রয়েছে।

এমন আকর্ষণীয় অফার, কারই বা আগ্রহ জন্মাবে না। জানতে চাইলাম পেমেন্ট সিস্টেম কি? এখানে এসেই ধরা পড়ে প্রতারণার ফাঁদ। মেসেজে জানানো হলো আগে নিজের অর্থ দিয়ে অর্ডার সম্পন্ন করতে হবে। এরপর কমিশনসহ অর্থ অ্যাকাউন্টে পাঠানো হবে। এই মেসেজের পর সরাসরি বললাম, বুঝতে পেরেছি এটা আরেকটি স্ক্যাম, ধন্যবাদ। এরপর ওই হোয়াটস অ্যাপ নম্বর থেকে আর কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। এই ঘটনার পরে এই ধরনের পার্ট টাইম কাজের বিজ্ঞাপন আসা বেড়ে যায়। ঘটনা যাচাইয়ের জন্য আরো দু’একটি জায়গায় হোয়াটস অ্যাপে যোগাযোগ করলে একই ধরনের মেসেজ মিলে।

নিজে যখন বিষয়টি নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি একই সময়ে সহকর্মী, বন্ধু ও পরিচিত কয়েক জনের সাথে প্রসঙ্গক্রমে এই বিষয়ে কথা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজন জানান, তারাও এই ধরনের মেসেজ পেয়েছেন। শুধু তাই নয়, দুই জন জানান তাদের সরাসরি বিদেশি একটি নম্বর থেকে ফোন করে পার্ট টাইম কাজের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যদিও তারা কখনো এই ধরনের কোনো কাজের জন্য আবেদন বা যোগাযোগই করেননি। ফোন করে তাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে অজ্ঞাত ব্যক্তি। জানতে চাওয়া হয় ইংরেজি ভাষায় পারদর্শিতা সম্পর্কে। মজার বিষয় হলো নম্বরগুলোতে পাল্টা ফোন করলে বিপরীত প্রান্তে কাউকে পাওয়া যায় না। অর্থাৎ প্রতারক চক্রের সদস্যরা নিজেদের সুবিধা মতো যোগাযোগ করা বা না করার সব ব্যবস্থা পাকাপোক্তভাবে করেই মাঠে নেমেছে।

বিষয়টি নিয়ে রিসার্চ করতে গিয়ে দেখা গেলো, অনেকেই এধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন।  তবে বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ডিজিটাল নিরাপত্তা সংশ্লিষ্টদের নজরে হয়তো এখনো সেভাবে তুলে ধরা সম্ভব হয়নি বা নজরে আসেনি। কেননা এ ধরনের প্রতারণার শিকার ব্যক্তিরা সাধারণত থানায় অভিযোগ দায়ের করেন না। এর অন্যতম কারণ কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করবেন। জানাইতো নেই কে বা কারা তার সাথে প্রতারণা করেছে। অনলাইন প্রতারক চক্ররা সাধারণত লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে, নকল পরিচয় ও যোগযোগ নম্বর ব্যবহার করে এ ধরনের প্রতারণা করে থাকে। সোজা কথা অজ্ঞাত। অনেক ক্ষেত্রে যদি কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচয় দেওয়া হয়ে থাকে সেটাও ভুয়া।

অনলাইনে কাজ খোঁজা ও কাজ করার ক্ষেত্রে সময় এসেছে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হওয়ার। যাতে সময়, মেধা, পরিশ্রম বা অর্থ কোনটাই বৃথা না যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হতে না হয়। এক্ষেত্রে একটি উপায় হলো পরিচিত বা জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মগুলোতে কাজ করা ও সুযোগ তৈরি করা। যেমন: আপওয়ার্ক, ফাইভার ইত্যাদিতে অ্যাকাউন্ট খুলে পোর্টফলিও সাজিয়ে নিজের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অনুযায়ী কাজ করতে পারেন। নতুন প্ল্যাটফর্ম বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে ভালোভাবে যাচাই করে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে অনলাইন বা অফলাইন শর্টকাটে, খুব সহজে অর্থ উপার্জনের যে কোনো পথ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুফল বয়ে আনে না। অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তও হতে হয়।

বর্তমানে অনলাইন জনপ্রিয় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ডিজিটাল মার্কেটিং। আরো আছে কন্টেন্ট রাইটিং, গ্রাফিক ডিজাইনিং, ভিডিও এডিটিং, ইউজার ইন্টারফেইস ডিজাইনিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডাটা এন্ট্রি, ব্লগ লেখা, পেইড সার্ভে, ইউটিউবিংসহ নানা কাজ। কিন্তু এই কাজগুলো করার ক্ষেত্রে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। যেই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা প্ল্যাটফর্ম কাজ দিচ্ছে এবং কাজ করে দেওয়া ব্যক্তির মধ্যে যোগাযোগ স্পষ্ট থাকা খুবই জরুরি। যে জায়গায় মনে হবে এমনটা হচ্ছে না, সেখানেই সন্দেহ বা মনে প্রশ্ন জাগা উচিত। কয়েকজনের সাথে কথা বলে যতোটা জানতে পারলাম, অনলাইনে পণ্য কেনাবেচায় লোভনীয় আয়ের প্রস্তাব দিয়ে প্রতারণার বিষয়টি খুব বেশি ছড়িয়েছে। না বুঝে বা লোভে পড়ে এই ফাঁদে পা দিচ্ছেন অনেকে।

অনলাইনে কাজ শুরুর আগে প্ল্যাটফর্মটি যে প্রতারণার ফাঁদ নয় তা যাচাইয়ের সহজ দুটি পথ হলো, প্ল্যাটফর্মটির বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অর্থ লেনদেনের ব্যাপারটি নিশ্চিত করা। মাথায় রাখতে হবে, যে ওয়েবসাইট বা ব্যক্তির সাথে কাজ করবেন, সে সম্পর্কে সঠিত তথ্য থাকা। যাতে কাজের বিপরীতে ভালো মজুরির আশ্বাস দিলেও শেষমেশ প্রতারণার শিকার না হতে হয়। বিদেশি সাইটে পেমেন্ট মেথড হতে পারে পেওনিয়ার, সরাসরি নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এমনকি বিকাশেও অর্থ পেতে পারেন। এসব কিছুর পাশপাশি আরেকটি বিষয় মাথায় রাখা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হলো ইমেইল আইডি, পাসওয়ার্ড সেট করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নাম্বারের মতো ব্যক্তিগত কোনো তথ্য কাকে বা কোথায় দিচ্ছেন তা নিয়ে অনেক বেশি সতর্ক থাকা। যাতে বিপদ না বাড়ে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − 5 =