নিরাপদ স্যানিটেশন: ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ভাবনা

জুবায়েদুর রহমান/পিআইডি ফিচার

দুই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস এই রাজধানী ঢাকায়। হাজার বছরের পুরানো এই শহরে সময়ের সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে সবকিছুতেই ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। পরিকল্পনা থেকে মহাপরিকল্পনা যেমন হয়েছে, তেমনি  অবকাঠামোগত পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনও হয়েছে। মানুষের ভবিষ্যতের প্রয়োজন ও চাহিদার কথা মাথায় রেখে  আগামী বিশ- ত্রিশ বছরের পরিকল্পনা যেমন করা হয়েছে বা হচ্ছে , তেমনি আরো দীর্ঘ মেয়াদি শতবর্ষের ব- দ্বীপ পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এসব করা হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের জন্য।

টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার বিভিন্ন ধরণের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে চলেছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি ৬. নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্হাপনা শতভাগ  লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হবে। যা এ পর্যন্ত শতকরা ৩৮ শতাংশ অর্জিত হয়েছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে অন্যান্য সকল মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সাথে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সহযোগী হিসাবে এ দায়িত্ব পালন করছে। এ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ তথ্য অধিদফতর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ বেতার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সকল নাগরিকের জন্য  নিরাপদ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। তবে মানসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্হা নিশ্চিত করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। গ্রামীণ অঞ্চলে অধিকাংশ মানুষ পিট ল্যাট্রিন ব্যবহার করে। তাদের পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্হা খারাপ না। তবে প্রধান সমস্যা হলো শহরগুলোতে। এখানে নানাধরণের মানুষ বসবাস করে।  সিটি কর্পোরেশনগুলোকে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে হবে। এক্ষেত্রে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ঢাকা শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্হাপনার দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। নতুন পরিকল্পনায় নাগরিকের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি কর্পোরেশনকে। এরই ধারাবাহিকতায় সিটি কর্পোরেশন বাসাবাড়ির বর্জ্য ( ফিকেল স্লাজ) ব্যবস্হাপনাকে তাদের দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছে। কঠিন বর্জ্য ব্যবস্হাপনার পাশাপাশি পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্হাপনা ঢাকা মহানগরীর পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ। একটি দৃশ্যমান,অন্যটি সবার অগোচরে জলাশয় ও নদী দূষণ করে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে হুমকিতে ফেলছে। নগরবাসী যদি এ বিষয়টি গুরুত্ব ও ভয়াবহতা অনুধাবন না করে তাহলে এ মহানগরীর নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্হা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে।

ঢাকা শহরের পয়ঃবর্জ্য একেবারেই অপরিকল্পিত ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে নিষ্কোশিত হচ্ছে। ফলে শহরের উন্মুক্ত জলাশয়ের পানি ও পরিবেশ দূষণের স্বীকার হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে হাতিরঝিল, গুলশান ও বনানীলেক আমাদের সামনেই আছে। একসময় হাতিরঝিলের দুর্গন্ধে এর চারপাশ দিয়ে হাঁটা যেত না।এখনো এ সমস্যা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি, পানি থেকে দুর্গন্ধ আসে। ঢাকা শহরে দুই ধরনের স্যানিটেশন ব্যবস্হা রয়েছে। এর একটি সুয়ারেজ পদ্ধতি। বাসার টয়লেট থেকে সরাসরি সুয়ারেজ সিস্টেমে সংযোগ দেওয়া হলে সুয়েজ বা পয়ঃবর্জ্য পানি সুয়ার নেটওয়ার্ক দিয়ে ট্রিটমেন্ট প্লান্টে বা শোধনাগারে চলে যায়। সেখানে প্রয়োজনীয় শোধনের পর পরিশোধিত পয়োবর্জ্য পানি নদী বা পরিবেশে নিষ্কাশিত হয়। আর একটি পদ্ধতি হলো অনসাইট স্যানিটেশন পদ্ধতি অর্থাৎ  সেপটিক ট্যাংক সিস্টেম। সেপটিক ট্যাংক পয়ঃবর্জ্য থেকে কঠিন পদার্থকে আলাদা করে। এটা স্লাজ হিসেবে  ট্যাংকের তলায় জমা হয়।আর স্লাজবিহীন পয়ঃবর্জ্য পানি কিছুটা শোধন হয়ে সেপটিকের মাধ্যমে মাটি শুষে নেয়। ট্যাংকের তলার জমাকৃত স্লাজ নির্দিষ্ট সময় পরপর খালি করে পয়ঃবর্জ্য শোধনাগারে পরিশোধিত করতে হয়। একটা সুয়েজ ট্রিটমেন্ট প্লান্টে পয়ঃবর্জ্য পানি যতটুকু শোধন হয়,এর প্রায় অর্ধেক শোধন হয় সেপটিক ট্যাংকে।

প্রায় একচতুর্থাংশ ঢাকা শহরের মানুষ সুয়ারেজ সিস্টেমের সাথে যুক্ত আছে। ঢাকার সুয়ারেজ নেটওয়ার্কের সঙ্গে ২৫ টি সুয়েজ লিফট আছে। এগুলো যখন ঠিকমতো কাজ করে না তখন সুয়েজ লিকেজ হয়ে পানি ও পরিবেশকে দূষিত করে। ঢাকা শহরের একমাত্র সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট রয়েছে পাগলায়। এ প্লান্টের শোধন ক্ষমতা এক লাখ বিশ হাজার ঘনমিটার। নানারকম সমস্যার কারণে এ প্লান্টটি সক্ষমতা অনুযায়ী পয়ঃবর্জ্য শোধন করতে পারেনা। ঢাকা ওয়াসার মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী আরো চারটি সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি করা হবে। এর মধ্যে দাশেরকান্দিতে পাঁচ লাখ ঘনমিটার পয়ঃবর্জ্য পরিশোধন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি বড়ো ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরি হচ্ছে। পাগলায় ট্রিটমেন্ট প্লান্টের শোধন ক্ষমতা বৃদ্ধি করে পাঁচ লাখ ঘনমিটারে উন্নীত করা হবে। ট্রিটমেন্ট প্লান্টে সুয়েজ প্রবাহের জন্য প্রয়োজনীয় সুয়ার নেটওয়ার্ক তৈরি করতে হবে। এটি অনেক বড়ো একটি কাজ। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের নাগরিকদের নিরাপদ স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়।শহরের বস্তি, দ্বীপাঞ্চল, পাহাড়ি ও উপকূলীয় এলাকার জলাভূমিতে টেকসই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমস্যা আছে। উন্মুক্ত স্হানে মলত্যাগ বন্ধে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। বাংলাদেশে একই টয়লেট একাধিক ব্যক্তি ও পরিবারের ব্যবহারের হার অনেক বেশি এবং বস্তিগুলোতে এ হার সবচেয়ে বেশি। শিশুর মল-মূত্র ঠিকমতো সরিয়ে ফেলার হার এখনো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত হয়নি। মল-মূত্রের নিরাপদ ব্যবস্হাপনা না থাকলে অসুস্থতার ঝুঁকি থাকে। এমনকি শিশুর মৃত্যু ও হতে পারে। পয়ঃনিষ্কাশনের সাথে শিশুর ডায়রিয়া ও খর্বকায়ত্বের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। ধনী দরিদ্র ভেদে পয়ঃনিষ্কাশনের সুবিধাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থা ও লৈঙ্গিক ভিত্তিতেও এ ব্যবধান রয়েছে।২০১০ সালে জাতিসংঘ বলেছে, পয়ঃনিষ্কাশন হলো মানবাধিকার। নাগরিকদের মনোজগতে শহর পরিচ্ছন্ন রাখার ভাবনা ঢুকিয়ে দিতে হবে।তাহলে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে বর্জ্য অপসারণের জন্য সবাই সচেষ্ট হবে। এটা নাগরিকদের প্রথম দায়িত্ব।

সমাজের সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে।ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের নাগরিকদের সচেতন করার পাশাপাশি বেশ কিছু সুযোগসুবিধা ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছে, যেগুলো সম্মানিত নগরবাসীর মধ্যে নতুন করে চিন্তার খোরাক যোগাবে। ইতিপূর্বেই ঘোষণা করা হয়েছিল যারা ছাদবাগান করবে, তাদের রিবেট দেওয়া হবে।এটা চলমান রয়েছে। এবার  মেয়র মহোদয় বলেছেন, যারা বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করবে,তাদের শতকরা দশভাগ রিবেট দেওয়া হবে। এছাড়াও,  উত্তর সিটি কর্পোরেশন তাদের এলাকায়   যেখানে রাস্তা হবে,সেখানে রিচার্জিং স্টেশন নির্মাণের পরিকল্পনা করছে। বর্জ্যের উৎসস্হলেই ডায়লুট করার পরিকল্পনা রয়েছে। এজন্য সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসা, রাজউক, স্হনীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সকলে মিলে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আধুনিক বিশ্বের সাথে তালমিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে এসডিজি প্রোগ্রেস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। এসডিজির সকল লক্ষমাত্রা পূরণে বাংলাদেশ সচেষ্ট রয়েছে। মুজিব বর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এ উদ্যোগ নগরবাসীর জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরাপদ স্যানিটেশন নিশ্চিত করতে সকলে সচেতনভাবে এগিয়ে আসবে এটাই জনপ্রত্যাশা।

 

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

four × four =