হাসান নীল
আল্পনায় রঙিন অল ওয়েদার রোড
বাড়ির উঠানে আলপনা আঁকা বাঙালি নারীর চিরায়িত ঐতিহ্য। আজকাল এর প্রচলন কম। তবে বিশেষ দিনে আলপনা আঁকে বাঙালি। পহেলা বৈশাখে এদেশের মানুষজন যেমন নতুন পোশাকে নিজেদের সাজায় তেমনি চারপাশ রাঙায় আলপনায়। এবারের বৈশাখে তা যেন ছিল আরও বর্ণিল। দিনটি উপলক্ষ্যে হাওড়ের অল ওয়েদার রোড রাঙানো হয়েছে আলপনায়। দেখে মনে হচ্ছিল সড়কটিকে রঙিন শাড়ি পরানো হয়েছে। দুই পাশে থৈথৈ জলরাশি আর মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া শাড়ি পরা সড়ক। সে এক অন্যরকম সৌন্দর্য। যা দেখতে ঢল নেমেছিল মানুষের। রঙিন সড়ক ও দুই পাশে হাওড়ের জল, এক চোখ ধাঁধানো জলছবি হয়ে ধরা দিয়েছিল।
তবে সড়কটি শুধু হাওড়ের সৌন্দর্যই বাড়ায়নি, এই অঞ্চলের মানুষের জন্যও হয়ে দাঁড়িয়েছে স্বস্তির বিষয়। বছরে ৫-৬ মাস জলে পরিপূর্ণ থাকে হাওড়। এক সময় নৌকা ছাড়া এখানে বিকল্প কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ছিল না। পানি নেমে গেলে বাকি সময়টুকু সবুজ হয়ে ওঠে হাওড়। শুকনা মৌসুমে যাতায়াতের জন্য পায়ে হাঁটা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ ছিল না হাওড়বাসীর। এ কারণে বলা হতো, জলে নাও শুকনায় পাও। এর অর্থ জলে হাওড়ের একমাত্র যাতায়াত ব্যবস্থা নৌকা। অন্য সময়টুকু পায়ে হেঁটে চলতে হয় পথ। তবে প্রচলিত এই ব্যবস্থা বদলে দিয়েছে হাওড়ের এই সড়ক। ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম গ্রাম তিনটিকে এক সুতায় বেঁধে দেওয়া এই অল ওয়েদার রোড তৈরি হয় ২০২০ সালে। ৮৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে হাওড়ের মাঝ দিয়ে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রাস্তাটি নির্মাণ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের ঐকান্তিক ইচ্ছায় হয়েছিল এই সড়ক।
সড়কের গায়ে লেগে আছে হাওড়
অল ওয়েদার রোডের গায়ে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে মিঠামইন ও নিকলী হাওড়। আর মিঠামইনের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে আছে নিকলী হাওড়। সৌন্দর্যে এরা কেউ কারও চেয়ে কম না। হাওড়ের অন্যতম সৌন্দর্য এর বিস্তীর্ণ জলরাশি। সকাল বিকাল সন্ধ্যায় রূপ বদলায় জল থই থই এই হাওড়ের। জলের বুকে ভেসে আছে জেলেদের নৌকা আর আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিদের দল। মাঝে মাঝে জেগে আছে একটি দুটি গ্রাম। সেগুলোকে মনে হয় এক একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দেখে মনে হয় যেন বিশাল ক্যানভাসে শিল্পীর হাতে আঁকা একটি চিত্রকর্ম। যেখানে মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য। শুধু মিঠামইন-নিকলী নয় কিশোরগঞ্জের সবগুলো হাওড়ের চিরায়ত দৃশ্য এমন।
মিঠামইন হাওড়
কিশোরগঞ্জের হাওড়গুলো নামকরণ করা হয়েছে এলাকার নাম অনুসারে। এ জেলার একটি উপজেলা মিঠামইন। এলাকার নাম থেকেই হাওড়ের নাম রাখা হয়েছে মিঠামইন। এ নামের আলাদা একটি ইতিহাসও রয়েছে। শোনা যায় এই অঞ্চলের পাশেই ছিল খাগড়ার বন। খাগড়া গাছ থেকে পাওয়া যেত মিষ্টি রস। সেখান থেকে অঞ্চলটির নাম ছিল মিঠাবন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মিঠাবন হয়ে যায় মিঠামন। পরে মিঠামইন। এই হাওড়ের উত্তরে রয়েছে ইটনা ও আজমিরগঞ্জ উপজেলা। দক্ষিণে অষ্টগ্রাম। আর পূর্বে পাশাপাশি মিলেমিশে আছে বানিয়ারচং ও অষ্টগ্রাম উপজেলা। পশ্চিম দিক থেকে একে ঘিরে আছে করিমগঞ্জ ও নিকলী উপজেলা।
মিঠামইনে হাওড় ছাড়াও রয়েছে দেখার মতো বেশকিছু স্থান। এর একটি মালিকের দরগা। দিল্লির সুফি সাধক হযরত শাহজালাল রহমাতুল্লাহ আলাইহির সঙ্গে সিলেট এসেছিলেন ৩৬০ জন সহচর। তাদেরই একজন ছিলেন শাহ লতিফ। তাকে সবাই মালিক বাবা বলে ডাকতেন। মিঠামইনের ভরা ঘাগড়া গ্রামে তার সমাধিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে একটি দরগা। তার নাম অনুসারে ওই দরগাকে বলা হয় মালিকের দরগা।
কিশোরগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থানগুলোর আরেকটি হলো দিল্লির আখড়া। এটি মিঠামইন উপজেলার কাটাখাল ইউনিয়নে অবস্থিত। শোনা যায়, দিল্লির সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে সাধু নারায়ণ গোস্বামী এই আখড়া প্রতিষ্ঠা করেন। যার ভেতরে রয়েছে ধর্মশালা নাট মন্দির, সাধক নারায়ণ গোস্বামী ও তার অন্যতম শিষ্য গঙ্গারাম গোস্বামীর সমাধি। এছাড়া রয়েছে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের বাড়ি এবং শত বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী মসজিদ। যা দেখতে দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসে মানুষজন।
নিকলী হাওড়
মিঠামইনের গা ছুঁয়েই অবস্থিত নিকলী হাওড়। নিকলী একটি উপজেলার নাম। উৎপত্তিস্থল হওয়ায় হাওড়ের নাম রাখা হয়েছে নিকলী হাওড়। তবে এর বিস্তৃতি শুধু এক উপজেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি ছুঁয়ে গেছে মিঠামইন অষ্টগ্রাম ও ইটনা উপজেলা। বর্ষায় দেখতে অনেকটা সাগরের মতো লাগে। তবে নদীর সাথেও রয়েছে এর নিবিড় যোগাযোগ। নিকলীর ঠিক মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে পুরানো ব্রহ্মপুত্র নদ। তবে স্থানীয়রা একে এই নামে ডাকেন না। তারা ঘোড়াউত্রা নাম দিয়েছেন নদীটির। এই নামের কারণ বা অর্থ কোনোটাই খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকের ধারণা হাওড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর সৌন্দর্য দর্শনার্থীদের বিমোহিত করে। তা থেকেই হয়তো নাম হয়েছে ঘোড়াউত্রা। নদীটির মাঝখানে চর জেগে উঠেছে। নাম মনপুরা চর। তবে এই নদী বছরে ছয় মাস দেখা দেয় না। হাওড়ের যৌবনকাল বর্ষায় যখন দুকূল ছাপিয়ে ওঠে জলে তখন নদী মিলিয়ে যায়। হাওড়ের জলে মিলেমিশে একাকার হয়।
নিকলীর সৌন্দর্য মনভরে উপভোগ করতে হলে আপনাকে বেছে নিতে হবে জলপথ। জলের বুকে ভেসে বেড়াতে ঘাটে বাঁধা অসংখ্য বোট ও ট্রলার। বোট ধরে যাত্রা শুরু করলে যেতে হবে স্রোতের বিপরীতে। ফলে তুলনামূলকভাবে যাত্রা হবে ধীর গতির। এতে অবশ্য সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন দুচোখ ভরে। যেতে যেতে প্রথমেই নজর কাড়বে ছাতির চর।
ছাতির চরে ডুবে আছে বিস্তৃত সবুজ বন। জলের স্তরে স্তরে সবুজের সমারোহ। বর্ষায় বুক সমান পানি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ছাতির চরের গাছগুলো। যা দেখে মনে পড়ে যায় রাতারগুলের কথা। সে কারণেই ছাতির চরকে নিকলীর রাতারগুল নামে ডাকেন অনেকে। সৌন্দর্য উপভোগ করতে দর্শনার্থীদের বোট এখানে এসে সাময়িক বিরতি নেয়। হাওড়ের সৌন্দর্য কানায় কানায় উপভোগ করতে চাইলে ছাতির চরের পানিতে গা ভেজাতে ভুলবেন না। আর সে সময় যদি বৃষ্টি আসে তবে যেন হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। টুপটাপ বৃষ্টিতে গা ভেজানো মুহূর্তকে আনন্দঘন করে তোলে।
প্রতিদিনই অসংখ্য দর্শনার্থীর ভিড়ে মুখরিত হয়ে ওঠে ছাতির চর। তাদের কথা চিন্তা করে এখানে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট ভাসমান দোকান। স্থানীয়দের কেউ কেউ নৌকায় করে বিক্রি করেন দেশি ফলমূল। সেইসঙ্গে রাখেন গাড়ির টিউব। জলের বুকে কিছু সময় গা ভেজাতে নামা দর্শনার্থীদের সময়টা উপভোগ্য করে তুলতে টিউবগুলো ভাড়া দেন তারা। ছাতির চরে কিছুটা সময় কাটিয়ে বোট আপনাকে নিয়ে ছুটবে। এবার আপনার যাত্রা মিঠামাইন অষ্টগ্রাম ও ইটনাকে এক সুতায় বেঁধে দেওয়া অল ওয়েদার রোড। জলে ভেসে হাওড়ের অপূর্ব সৌন্দর্য দেখতে দেখতে ছুটে যেতে পারবেন। সঙ্গে স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে কিছু মুহূর্ত করতে পারেন ফ্রেমবন্দি। বেড়িবাঁধ থেকে অল ওয়েদার রোডে পৌঁছাতে সময় লাগবে এক ঘণ্টা। রাস্তায় দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করতে পারেন রাস্তার দুপাশে এসে আছড়ে পড়ছে মুহুর্মুহু ঢেউ। যা দেখে মনে হতে পারে সমুদ্র সৈকতের কথা।
কীভাবে যাবেন নিকলী-মিঠামইন
ঢাকা থেকে বাস বা ট্রেন দুভাবেই যাওয়া যায় নিকলী হাওরে। যদি বাসে যেতে চান তাহলে যেতে হবে মহাখালী কিংবা সায়দাবাদ। এখানে বেশকিছু বাস রয়েছে যা আপনাকে নিয়ে যাবে কটিয়াদী পর্যন্ত। প্রায় তিন ঘণ্টার পথ। এজন্য ভাড়া গুনতে হবে ২০০ টাকার মতো। কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ড নেমেই দেখবেন আপনাকে নিকলী নিয়ে যেতে দাঁড়িয়ে অসংখ্য সিএনজি অটো রিকশা। সেখান থেকে কোনো একটি রিজার্ভ করে চলে যেতে হবে নিকলী হাওরে। ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকার মধ্যেই রিজার্ভ সিএনজি পাবেন। তবে দাম দরের ক্ষেত্রে একটু সচেতন থাকবেন। কেননা ৫০০ টাকা পর্যন্ত হাঁকায় সিএনজি চালকরা।
ট্রেনে যেতে হলে আপনাকে চেপে বসতে হবে ১১ সিন্দুতে। কমলাপুর কিংবা বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ধরতে পারবেন ট্রেনটি। শ্রেণিভেদে ১৫০ টাকা থেকে ভাড়া গুনতে হবে। গচিহাটা স্টেশনে ট্রেন থামলে আপনি নেমে পড়বেন। এরপর সিএনজি যোগে সোজা চলে যাবেন নিকলী হাওরে। অন্যদিকে মিঠামইন যেতে হলে নামতে হবে কিশোরগঞ্জ। প্রথমে যেতে হবে একরামপুর সিএনজি স্টেশনে। সেখান থেকে সিএনজি অটোরিকশা আপনাকে নিয়ে যাবে চামড়া বন্দর ঘাটে। এই ঘাট থেকে নৌকা নিয়েই ঘুরে আসতে পারেন মিঠামইন হাওড় থেকে।
বাসে যেতে চাইলে কিশোরগঞ্জের বাস ধরতে হবে। মহাখালী, সায়েদাবাদ কিংবা গোলাপবাগ থেকে পেয়ে যাবেন কিশোরগঞ্জের বাস। ২০০ টাকার মতো ভাড়া লাগবে। বাস বা ট্রেন যে যানেই আসুন নামতে হবে কিশোরগঞ্জ।
কখন যাবেন
মিঠাইমইন কিংবা নিকলী যেখানেই যান না কেন, কখন যাবেন সেটি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও বিভিন্ন ঋতুতে রূপ বদলায় হাওড়। তবে উপযুক্ত সময় বর্ষাকাল। এসময় হাওড়ের সৌন্দর্য পূর্ণতা পায়। তাই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বর্ষাকালে চেষ্টা করবেন হাওড় দেখতে যেতে।
কোথায় থাকবেন
মিঠামইনে গেলে রাতে থাকার বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ওই অঞ্চলে রাতে থাকার মতো ভালো হোটেল নেই বললেই চলে। যা আছে তা সাধারণ মানের বোর্ডিং। এক্ষেত্রে ভরসা উপজেলা ডাকবাংলো। তাও সবসময় পাওয়াটা ভাগ্যের ব্যাপার। অবশ্যই আগে থেকে যোগাযোগ করে নেওয়া উচিত। এছাড়া থাকার জন্য কিশোরগঞ্জ শহর বেছে নিতে পারেন। এখানে ভালো মানের বেশ কয়েকটা হোটেল রয়েছে। মিঠামইনের মতো নিকলীতেও একই অবস্থা। নেই থাকার জন্য ভালো কোনো হোটেল। উপজেলার ডাকবাংলোই ভরসা। কিংবা কিশোরগঞ্জে গিয়ে ভালো মানের কোনো হোটেলে থাকতে হবে আপনাকে। চাইলে নৌকায় কিংবা ক্যাম্পিং করেও রাত পার করতে পারবেন। তবে তাতে কিছুটা ঝুঁকি থাকে।
কী খাবেন
থাকতে অসুবিধা হলেও নিকলীতে খাবার দাবারে কোনো সমস্যা হবে না আপনার। মোটামুটি মানের বেশকিছু হোটেল আছে। যেখানে ১০০-২০০ টাকায় খাবার পাওয়া যায়। মিটামইন বাজারেও স্থানীয় খাবার হোটেলে হাওড়ের বিভিন্ন তাজা মাছের পদসহ প্রয়োজনীয় খাবার পাবেন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: কোথায় কি