ব্যস্ত থাকতে ভালোবাসেন মিথিলা

নাহিন আশরাফ

সর্বগুণে গুণান্বিত রাফিয়াত রশিদ মিথিলা। অভিনয়ের পাশাপাশি গান, নাচ এবং উন্নয়ন কর্মী হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। শুধু বাংলাদেশ নয় তার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়েছে ভারতেও। এপার বাংলা ওপার বাংলা দুই জায়গায় তিনি নিজের গুণের পরিচয় দিয়েছেন। মার্জিত বাচনভঙ্গি ও গুছিয়ে চলার জন্য অনেকেই তাকে বেশ পছন্দ করেন। মিডিয়ায় কাজ করার পাশাপাশি ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্টের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। মিথিলা ঢাকার স্কলাস্টিকা ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের ইংরেজি সাহিত্য ও ভাষা অনুষদে ছিলেন। তিনি ২০১৭ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের প্রারম্ভিক শৈশব উন্নয়ন বিভাগে অতিথি প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি নর্দান ইউনিভার্সিটিতে ইংরেজি ভাষা এবং ফাউন্ডেশন কোর্সের প্রভাষক ছিলেন। মিথিলা বর্তমানে ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনালের প্রারম্ভিক শৈশব উন্নয়নের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।  তিনি আফ্রিকার কিছু দেশে ব্যাপকভাবে কাজ করেছেন। তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ওয়েস্ট বেঙ্গল কমিশন ফর প্রোটেকশন অব চাইল্ড রাইটস অ্যান্ড স্বয়ম-এর সক্রিয় কর্মী। তিনি এশিয়া-প্যাসিফিক রিজিওনাল নেটওয়ার্ক ফর আর্লি চাইল্ডহুড  এবং সাউথ এশিয়া ফোরাম অফ আর্লি চাইল্ডহুড ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনালস।

ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখার দিকে ঝোঁক ছিল মিথিলার। ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় বেড়ে উঠেন তিনি। মিথিলা পরিবারের চার ভাই বোনের মধ্যে বড়। তিনি লিটল জুয়েলস স্কুলে প্রাথমিক, ভিকারুননেসা নুন স্কুল এন্ড কলেজে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রারম্ভিক শৈশব বিকাশে দ্বিতীয় মাস্টার্স সম্পন্ন করে স্বর্ণপদক জিতে নেন। তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএড ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি ২০১০ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজ অব এডুকেশন অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টে ‘শিক্ষাক্রমের সমসাময়িক নির্দেশনা এবং মূল্যায়ন’ অধ্যয়ন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরও পড়াশোনার জন্য যান। একাডেমিক কাজের পাশাপাশি, মিথিলা বেনুকা ইনস্টিটিউট অব ফাইন আর্টসের ড্যান্স একাডেমিতে কত্থক, মণিপুরি এবং ভরতনাট্যম নৃত্য অধ্যয়ন করেছেন। তিনি হিন্দোল মিউজিক একাডেমিতে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান নিয়ে প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। তিনি নন্দন স্কুলে শিল্পকলা অধ্যয়ন করেন। দৃক গ্যালারি গ্রুপ প্রদর্শনীতে তার আঁকা তৈলচিত্র প্রদর্শিত হয়। তিনি পিপলস থিয়েটার, বাংলাদেশের শিশু অভিনেতা ছিলেন।

মিথিলা ২০০২ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় ফ্যাশন হাউস নীলাঞ্জনা পল্লীর মডেল হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০০৬ সালে টেলিভিশনে ‘একজন রেডিও জকির গল্পো’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু হয়। তিনি বেশকিছু টিভি বিজ্ঞাপন করেছেন এবং অনেক পণ্যের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরও হন। তিনি মিউজিক ভিডিওতে মডেল এবং বিভিন্ন নাটক ও টেলিফিল্মেও অভিনয় করেছেন। ২০২২ সালে তিনি ‘অমানুষ’ এ অভিনয় দিয়ে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন। পরে তিনি ভারতের পরিচালক সৌভিক কুন্ডুর ‘আয় খুকু আয়’ সিনেমায় প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে অভিনয় করেন। মিথিলা বাংলাভিশনে সেলিব্রেটি টক শো ‘আমার আমি’ হোস্ট করেন। তার সুবিশাল ক্যারিয়ারে অভিনয় দিয়ে বরাবর ভক্তদের ভালোবাসা ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

ছোটবেলা থেকে পড়াশোনার পাশাপাশি অন্যান্য কাজের সাথে যুক্ত থাকলেও পড়ালেখা নিয়ে কখনো আপোষ করতেন না। পড়ালেখাই ছিল তার জীবনের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। ছোটবেলায় থিয়েটারেও যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য থিয়েটার করা বন্ধ করে দেন। পরে আর থিয়েটারের সাথে যুক্ত হননি মিথিলা। ছোটবেলায় মা চেয়েছিলেন মিথিলা বড় হয়ে ডাক্তার হবেন, কিন্তু মায়ের সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি। এক সাক্ষাৎকারে মজার ছলে বলেন, যেহেতু ডাক্তার হতে পারিনি তাই পিএইচডি করার চেষ্টা করছি যাতে নামের আগে ডক্টর লেখা থাকে। এছাড়া ছোটবেলায় খুব ভালো ছবি আঁকতেন। কিন্তু সময়ের অভাবে ও নানা কাজে যুক্ত হয়ে যাবার কারণে ছবির আঁকার চর্চা ধরে রাখতে পারেননি। ছোটবেলায় মা চাকরি করার কারণে ঘরের অনেক দায়িত্ব পালন করতেন বাবা। মিথিলা শৈশবে স্মৃতিচারণ করে বলেন, সকালে স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা চুলে বেণী করে দিতেন। অনেক সময় বেণী পছন্দ না হলে কান্নাকাটি শুরু করলে বাবা ধৈর্য সহকারে আবার নতুন করে বেণী করে দিতেন। বাবা ভীষণ গোছালো মানুষ। সকালের নাস্তা বানানো, মশারি টানিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সব ধরনের কাজই মিথিলার বাবা করতেন। মিথিলা বলেন, মা-বাবার অনুপ্রেরণাতেই আজ এই অবধি আসতে পেরেছি। মা ছোটবেলা থেকে  নাচ-গানের সাথে তাকে যুক্ত করে দেন।

মিথিলার ব্যক্তিগত জীবন নিয়েও রয়েছে অনেক আলোচনা সমালোচনা। অনার্স তৃতীয় বর্ষে থাকা অবস্থায় তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন বিখ্যাত গায়ক ও অভিনেতা তাহসানের সাথে। মিথিলা-তাহসান জুটি অনেক জনপ্রিয় ছিল, তাদের আদর্শ দম্পতি বলা হতো। ২০১৩ সালে মিথিলা ও তাহসানের কন্যা সন্তান পৃথিবীতে আসে। কিন্তু তারা তাদের ১১ বছরের সংসার জীবনে সমাপ্তি টানেন। তাদের এই বিচ্ছেদ ভক্তরা সহজে মেনে নিতে পারছিলেন না। পরবর্তীতে মিথিলা ২০১৯ সালে ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন।

বর্তমানে তিনি বেশ প্রশংসিত হয়েছেন ‘কাজল রেখা’য় কঙ্কন দাসী চরিত্রে অভিনয় করে। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। এক সাক্ষাৎকারে মিথিলা বলেন, তিনি বরাবরই অভিনয়কে পেশা হিসেবে না দেখে ভালবাসার জায়গা হিসেবে দেখেছেন। তাই বেছে বেছে এমন সব চরিত্রে অভিনয় করেন যেখানে তাকে একটু আলাদা লাগবে। ‘কাজল রেখা’য় তার কাজ করার একটাই উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নধর্মী গল্প ও চরিত্র। এ সিনেমার মাধ্যমে দর্শকের ভালোবাসা পেয়ে তিনি বেশ আনন্দিত।

মিথিলা সবসময় নিজেকে নানা কাজে ব্যস্ত রাখতে ভালোবাসেন। তিনি করোনা মহামারীর মধ্যে প্রথম তার কলকাতার বাড়িতে যান। যেহেতু তখন লকডাউনের সময় এবং নতুন জায়গা সেখানে নিজেকে মানিয়ে নিতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছিল। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন বাড়ির ছাদে বাগান করবেন। প্রথমে অল্প কিছু গাছ দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে পুরো ছাদ তিনি বিভিন্ন ধরনের গাছে ভরিয়ে দেন। গাছের রক্ষণাবেক্ষণ ও যত্ন নিয়ে লকডাউনের সময়টা তার বেশ ভালো কাটে। বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত থাকার কারণে মিথিলাকে নানা রকমের প্রতিকূলতা ও বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। তার সফল ক্যারিয়ারে তিনি কখনোই কারো পরামর্শ নেননি। যখন যে কাজ ভালো লেগেছে করেছেন। তার কন্যার বয়স যখন এক বছর তখন থেকেই সিঙ্গেল মাদার। সন্তানের দায়িত্ব ও নিজের ক্যারিয়ার ব্যালেন্স করা সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র পরিবারের কারণে। সমাজকর্মী হিসেবে কাজ করার কারণে প্রায়ই তাকে অনেক ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকতে হতো। তখন তার সন্তানের দেখাশোনা করতেন তার বাবা-মা। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের মেয়ে হিসেবে যেকোনো পেশায় কাজ করাটাই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কর্মক্ষেত্রে সফল হতে তার পরিবার যেমন সহযোগিতা করেছে তেমনই অফিস কলিগ ও কাজের জায়গায় সহকর্মীরাও তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছে। পরিবার ও সহকর্মীদের সহযোগিতায় তার জীবন কিছুটা সহজ হয়েছে। মিথিলা তার মেয়েকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন সে একজন ভালো মানুষ হবে। মেয়ের প্রতিটি স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করতে চান। মিথিলাকে নিয়ে অনেকে অনেক ধরনের নেগেটিভ মন্তব্য করেন। কিন্তু সেসব তিনি কখনোই মাথায় নেন না। কারণ সবাই তার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে না জেনে মন্তব্য করেন। সুতরাং যারা তাকে চেনেন না তাদের কোনো কথা গায়ে মাখতে তিনি রাজি নন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সেলিব্রেটি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nineteen − 18 =