রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার হলো যেভাবে

গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত

প্রতিবছর ২৬ জুন বিশ্ব ফ্রিজ দিবস উদযাপন করা হয়। আপনি খানিকটা অবাক হবেন এটা জেনে ফ্রিজ কিন্তু আধুনিক যুগের কোনো স্মার্ট গ্যাজেট নয়। আজ থেকে ৩০০ বছর আগে আবিষ্কার হয়েছিল ফ্রিজ। মূলত খাবার সংরক্ষণের জন্যই ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার হয়। বর্তমানে প্রায় প্রতিটি বাসায় খাবার ভালো রাখতে এবং দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে ফ্রিজ ব্যবহার করা হয়। কাঁচা সবজি থেকে শুরু করে মাছ, মাংস, রান্না করা খাবার সবকিছু সংরক্ষণ করে রাখা হয় রেফ্রিজারেটরে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই যন্ত্রটি আবিষ্কারের গল্পটা জেনে আসা যাক।

শুরুতেই একটা বিষয় নিয়ে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া যাক। অনেকেই একটা বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়েন, ফ্রিজ এবং রেফ্রিজারেটর পার্থক্য কি? ফ্রিজ ও রেফ্রিজারেটর মধ্যে প্রধান যে ভিন্নতা সেটি হলো সাধারণত ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটরে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় ঠান্ডা হয়। কিন্তু ফ্রিজার বা ডিপ ফ্রিজে তাপমাত্রার ক্ষেত্রে কোনো সীমা নেই। এটি ধীরে ধীরে অনেক বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়। যার কারণে পানি বরফে পরিণত হয়। সাধারণ রেফ্রিজারেটরের মধ্যেও ফ্রিজার থাকে তবে সেটি ছোট পরিসরে। বর্তমানে রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ নামের যন্ত্রটি কৃত্রিমভাবে খাবার ও পানি ঠান্ডা রাখা এবং সংরক্ষণে সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকর উপায়।

ফ্রিজে চলে বাষ্পীভবন আর ঘনীভবনের চক্র। খাবারকে জীবাণু থেকে দূরে রাখতে হলে তা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে ব্যাকটেরিয়া-ছত্রাক মোটামুটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। বংশবিস্তার করতে পারে না। কিন্তু তাপমাত্রা ৪ থেকে বাড়লেই তা হয়ে ওঠে অণুজীবদের জন্য আদর্শ। নষ্ট হয় খাবার। ফলে তাপমাত্রা কমিয়ে খাবার বেশকিছু সময় সংরক্ষণ করা সম্ভব। আধুনিক রেফ্রিজারেটর বাষ্পীভবনের মাধ্যমে ঠান্ডা রাখে সবকিছু। এই বাষ্পীভবনের প্রক্রিয়া নির্ভর করে একটি তরলের ওপর। যে তরল বাষ্পীভবনের মাধ্যমে রূপান্তরিত হয় গ্যাসে।

চীনের লোকেরা ১০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে বরফ কেটে তার ভেতর খাবার সংরক্ষণ করে রাখতো। এর ৫০০ বছর পর মিশরীয়রা হিমায়ন পদ্ধতি আবিষ্কার করে। তারা বরফ তৈরির জন্য রাতে মাটির পাত্র বাইরে রেখে দিত। এরপর তার ভেতর অন্যান্য খাবার রাখত দিনের পর দিন সংরক্ষণ করার জন্য। ১৮ শতকে, ইউরোপীয়রা লবণাক্ত বরফকে ফ্ল্যানেলে মুড়িয়ে মাটির নিচে রেখেছিল। তবে যখন বরফ থাকত না তখন তারা পানির নিচে জিনিসপত্র রাখত। আধুনিক রেফ্রিজারেটর বহু বিজ্ঞানীর অনেক বছরের পরিশ্রমের ফসল। শুরুটা হয়েছিল স্কটিশ আবিষ্কারক উইলিয়াম কুলেনের হাত ধরে। উইলিয়াম কুলেন একজন স্কটিশ চিকিৎসক, অধ্যাপক, রসায়নবিদ ও কৃষিবিদ ছিলেন। ১৭৪৮ সালে তিনি গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কৃত্রিম হিমযন্ত্র প্রদর্শন করে। তিনি তার তত্ত্বে বলেন, দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যাবে, এমন এক ধরনের গ্যাস ব্যবহার করেই খাদ্যবস্তু ও পানীয় ঠান্ডা রাখা সম্ভব। তবে তিনি এ ধারণাকে কাজে লাগিয়ে আর এগোতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে টমাস মুর ১৮০২ সাল নাগাদ এক ধরনের আইসবক্স তৈরি করেন তার ডেইরি পণ্য ঠান্ডা রাখার জন্য। তিনি এই কুলিং সিস্টেমের নাম রাখেন ‘রেফ্রিজারেশন’। এরপর ১৮০৩ সালে মুর প্রথম ‘রেফ্রিজারেটর’ নামে পেটেন্ট নেন। মার্কিন সিভিল যুদ্ধের পর ১৮৩০ সাল থেকে এই রেফ্রিজারেটরের চাহিদা বাড়ে এবং সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য এ ধরনের যন্ত্রপাতির ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ১৮৩৫ সালে মার্কিন আবিষ্কারক জেকোচ পারকিনস বাষ্পীভবনের চক্র ব্যবহার করা রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার করেন। কুলেনের কাজ থেকেই অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তিনি। পাশাপাশি নকশায় সাহায্য করেন আরেক আবিষ্কার অলিভার ইভানস। এখানে রেফ্রিজারেন্ট ছিল অ্যামোনিয়া। ১৮৪২ সালে জন গরিরি প্রথম হিমায়ন পদ্ধতি তৈরি করেন, যা বরফ তৈরি করতে সক্ষম হয়। যদিও এই পদ্বতি বেশি ফলপ্রসু হয়নি। এরপর ১৮৫৬ সালে জেমস হ্যারিসন প্রথম ব্যবহারিক কম্প্রেশন হিমায়ন সিস্টেম তৈরি করেন। ১৯১৩ সাল নাগাদ ফ্রেড ডব্লিউ উলফ সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য প্রথম বৈদ্যুতিক রেফ্রিজারেটর আবিষ্কার করেন, যার বিবর্তন শেষে বর্তমানে আমরা আধুনিক রেফ্রিজারেটরের সুবিধা ভোগ করতে পারছি। ১৯২০ সালের দিকে অনেক জায়গায় রেফ্রিজারেন্ট হিসেবে ক্লোরো-ফ্লুরো-কার্বন (সিএফসি) ব্যবহৃত হতো।

মিথেন বা ইথেনের ক্লোরিন ও ফ্লোরিনের জাতকসমূহকে সিএফসি বলা হয়। গন্ধহীন, অদাহ্য, অবিষাক্ত এবং নিম্ন গলনাঙ্ক ও স্ফুটনাঙ্ক বিশিষ্ট এসব যৌগের বাণিজ্যিক নাম ফ্রেয়ন। যেমন ঈঈষ৩ঋ একটি সিএফসি যৌগ, যা ঈঋঈ-১১ বা ফ্রেয়ন-১১ নামে পরিচিত, যেখানে ১১ হলো ঈঋঈ বা ফ্রেয়ন নম্বর। এটি রেফ্রিজারেন্ট তৈরিতে গ্যাসীয় অগ্নি দমন ব্যবস্থা এবং দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এর আগে ব্যবহৃত গ্যাসগুলো ছিল দাহ্য ও বিষাক্ত। সে তুলনায় সিএফসি বেশ নিরাপদ বিকল্প। তবে মানবদেহের ক্ষতি কমাতে গিয়ে ক্ষতি হলো পরিবেশের। রেফ্রিজারেটর নষ্ট হলে বা ধ্বংস করা হলে অবমুক্ত হয় সিএফসি গ্যাস। গ্যাসগুলো বায়ুমণ্ডলের ওজোনস্তরে অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে ওজোনস্তরে গর্তের সৃষ্টি করে। সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মি থেকে আমাদের রক্ষা করে ওজোনস্তর। তাই ওজোনস্তরের ক্ষতি হওয়ার মানে সুখকর নয়। ব্যাপারটা টের পাওয়ার পর ১৯৭৪ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এর ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েটের মিশিগানের নাথানিয়েল বি ওয়েলস ১৯১৪ সালে বৈদ্যুতিক শক্তিতে কাজ করতে পারে এমন একটি রেফ্রিজারেশন ইউনিটের ধারণা দেন। এরপর আলফ্রেড মেলোয়েস ১৯১৬ সালে ক্যাবিনেটের নিচে স্থাপন করা একটি কম্প্রেসার দিয়ে রেফ্রিজারেটরের নকশা তৈরি করেন। তার ধারণা কিনে নিয়ে ১৯১৮ সালে ফ্রিজিডেয়ার কোম্পানি রেফ্রিজারেটর বাজারজাত করতে শুরু করে। একই বছরে কেলভিনেটর কোম্পানি রেফ্রিজারেটর তৈরি শুরু করে। ১৯২৩ সালের মধ্যে বাজারের ৮০ শতাংশ চলে যায় বৈদ্যুতিক রেফ্রিজারেটরের দখলে। সেই থেকে প্রতি বছর ২৬ জুন পালন করা হয় বিশ্ব রেফ্রিজারেশন দিবস।

বাংলাদেশে প্রায় দুই দশক ধরে ফ্রিজের বাজার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। পণ্যটি ব্যবহারের হার শহরের চেয়ে গ্রাম ও উপশহরগুলোয় এখন অনেক বেশি হারে বাড়ছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশের ফ্রিজের বাজার বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো নিয়ন্ত্রণ করত। দেশে ফ্রিজের বাজার সম্প্রসারণে প্রথম পদক্ষেপ নেয় ওয়ালটন গ্রুপ। দেড় দশক আগে দেশে ফ্রিজ উৎপাদন শুরু করে তারা। এর আগ পর্যন্ত পণ্যটি ছিল মূলত আমদানিনির্ভর। ফলে তা কিনতে দামও বেশি দিতে হতো। ওয়ালটন সেই হিসেবে তুলনামূলক কম দামে পণ্যটি সরবরাহ করায় তা অনেকের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে চলে আসে। পরে ধীরে ধীরে দেশে ফ্রিজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ে। ২০১৪ সালে ফ্রিজের ব্যবসা শুরু করে প্রাণ-আরএফএল কোম্পানি। দেশে তাদের বাজারজাত করা ফ্রিজের ব্র্যান্ডটির নাম ভিশন। এছাড়া ভারত ও নেপালে ফ্রিজ রপ্তানিও শুরু করেছে তারা। ২০২১ সালে প্রকাশিত মার্কেটিং ওয়াচ, বাংলাদেশের (এমডব্লিউবি) এক গবেষণা বলছে, দেশের ফ্রিজের বাজারের বেশিরভাগই দেশীয় ব্র্যান্ডের দখলে। এর মধ্যে এককভাবে দেশি ব্র্যান্ড ওয়ালটনের দখলে অধিকাংশ অংশ। বাকিগুলো যমুনা, মার্সেল, ভিশন, মিনিস্টারসহ অন্যদের দখলে। আর বিদেশি ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে কনকা, সিঙ্গার, শার্প, স্যামসাং, এলজি, হিতাচি উল্লেখযোগ্য। জেলা শহর থেকে শুরু করে একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন ফ্রিজের চাহিদা বাড়ছে। ২০১৯ সালে দেশে প্রায় ৩২ লাখ ফ্রিজ বিক্রি হয়েছে। এছাড়া গড়ে প্রতিবছর ৩০-৩৫ লাখ ফ্রিজ কিনছে ক্রেতারা। ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক ফ্রিজ উৎপাদকের দেশে রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ। ওয়ালটন উন্মোচন করেছিল জায়ান্টটেক সিরিজের এআইওটি বেজড স্মার্ট নতুন তিন মডেলের রেফ্রিজারেটর। এরমধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম উৎপাদনকৃত ফোর-ডোর রেফ্রিজারেটর এবং বিশ্বের প্রথম ৮রহ১ কনভার্টিবল সাইড বাই সাইড ডোর ফ্রিজ।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে রেফ্রিজারেটর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইন আর দারুণ সব ফিচার দেখা যায় এতে। অদূর ভবিষ্যতে আরো অত্যাধুনিক রেফ্রিজারেটর তৈরি হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 − 5 =