বাংলাদেশে বেদে সম্প্রদায় ও তাদের এগিয়ে চলা

প্রিয়াংকা আচার্য্য

মানবজাতির ইতিহাস ঘাঁটলে এক দীর্ঘ যাত্রাপথের পদরেখা দেখতে পাওয়া যায়। সভ্যতার সুতিকাগার আফ্রিকা থেকে বের হয়ে যেখানেই মানুষ থিতু হয়েছে সেখানেই গোড়াপত্তন হয়েছে নতুন এক সভ্যতার। আজও জীবনের অন্বেষণে, রুজির খোঁজে যাদের পথচলা অব্যাহত আছে, তেমনই এক জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের বেদে সম্প্রদায়।

স্থানীয়ভাবে যারা বাইদ্যা, বাদিয়া নামে পরিচিত। ঢাকা, মুন্সীগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, গাজীপুর চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, ফেনী, বরিশাল, খুলনা ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বেদেদের বসবাস। তাদের ঠেট, ঠের বা ঠার নামে নিজস্ব ভাষা আছে। নিজেদের মধ্যে তারা এই ভাষায় কথা বলে। ঠার ভাষার সঙ্গে আরাকানিদের ভাষার  মিল আছে, তবে অধিকাংশ শব্দই বাংলা ভাষার আদিরূপ প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত।

বাংলাদেশে বেদেরা কোথা থেকে কীভাবে এসেছে তা নিয়ে নানা মত রয়েছে। অনেকের ধারণা, প্রাচীনকালে মিশর থেকে বেদুইন জনগোষ্ঠীর কিছু সদস্য এখানে এসেছিল। সেই বেদুইন থেকে বেদে শব্দের উৎপত্তি। আর বেদে সমাজে জনশ্রুতি রয়েছে, ভারতে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার পান্ডুয়ায় বেদেরা এক সময় রাজত্ব গড়ে তুলতে পেরেছিল। তবে শত শত বছর ধরে বেদেরা এ দেশে আছে এবং এখানকার সমাজ-সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘দুরন্ত আশা’ কবিতায় বাঙালির বালখিল্য স্বভাবকে তীর্যকভাবে ব্যঙ্গ করে আরব বেদুইনদের সাহসের প্রশংসা করে লিখে গেছেন:

ইহার চেয়ে হতেম যদি

আরব বেদুয়িন!

চরণ-তলে বিশাল মরু

দিগন্তে বিলীন।

আমাদের দেশের বেদেদের জীবনে মরুর বদলে আছে নদী। এ দেশের নদীকে ঘিরেই তাদের জীবন-জীবিকা। দলবদ্ধভাবে নৌকার বহরে তাদের চলাচল ও বসবাস। মূলত ফসল তোলার মৌসুমে তারা গ্রামগঞ্জে ঘুরে ঘুরে অর্থ উপার্জন করে। টাকার জন্য এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যাওয়ার এই পরিভ্রমণকে বেদেরা বলে ‘গাওয়াল’। নারীরাই বেশি গাওয়ালে যায়। নৌকা ও তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ীভাবে বসবাস করে।

মূলত কাজের ধরন অনুযায়ী বেদেদের গোত্র ভাগ করা। সাপ খেলা দেখানো ও কেনাবেচাকারীদের সাপুড়ে, যারা ঝাড়ফুঁক করে তারা মিশ্চিয়ারি, যারা জাদু দেখায় তারা মাদারি, যারা শারীরিক কসরত দেখায় তারা চামরিয়া, কাঁচের চুড়ি ও মালা বিক্রেতাদের সান্দার, যারা মাছ ধরে তারা মানতা এবং যারা হাঁড়িপাতিলসহ সাংসারিক জিনিসপত্র বিক্রি করে তারা সওদাগর গোত্রভুক্ত। এছাড়া ধবাইলা গোত্রের বেদেরা তাবিজ-কবজ বিক্রি করে। এদের গ্রামগঞ্জ ও পাড়া-মহল্লায় বেশি দেখতে পাওয়া যায়। এ ধরনের আরও কয়েকটি গোত্র রয়েছে, যারা বিভিন্ন নামে পরিচিত।

একসময় বেদেরা জমিতে কায়িক পরিশ্রম করাকে অমর্যাদার কাজ বলে মনে করতো। তাই নির্দিষ্ট কোনও ভূখণ্ড ঘিরে তাদের কোনও জনপদ গড়ে উঠেনি। তাদের ছিল না স্থায়ী আবাস। নিরক্ষরতার অন্ধকারে ঢাকা ছিল প্রায় সবাই। তবে সময়ের আবর্তে প্রাচীন ধ্যান ধারণা থেকে তারা ধীরে ধীরে বের হয়ে আসছে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশের বেদেরা ভোটাধিকার অর্জন করে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৭.৮০ লাখ বেদে রয়েছে। এদের শতকরা ৯৯ ভাগ মুসলমান এবং ৯০ ভাগই নিরক্ষর। বর্তমানে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানা সুযোগ সুবিধা দেওয়ায় তারা এক জায়গায় বসবাস করতে পারছে। ফলে লেখাপড়ার সুযোগও পাচ্ছে। আর তাদের আদি পেশা পরিবর্তন করে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলও হতে পারছে। এছাড়া ব্যাপক হারে পরিবেশ দূষণে এদেশের বহু নদীনালা খালবিল মরে যাওয়ায় তারা যাতায়াত ও জীবিকার জন্য এখন আগের মতো নদীনির্ভরও থাকতে পারছে না।

সরেজমিনে সাভারের বংশী নদীর পাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা উত্তরণ পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, সরকার তাদের থাকার জন্য ৫৯টি ঘর করে দিয়েছে। এছাড়া তাঁবুতে আরও ৩৫টি পরিবারের মতো থাকে। বেদে কাঁলাচান ওঝার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমি সাপ খেলা দেখাই সেই ছোটকাল থেকে। দেশের নানা জায়গায় এমনকি ভারত গিয়েও আমি সাপ খেলা দেখিয়ে আসছি। সাপকে কেন্দ্র করেই আমাদের জীবন। আমরা নিজেদের সন্তানের মতোই সাপকে যত্ন করি। আগে সাপ খেলা দেখানোর পাশাপাশি মাছ ধরে উপার্জন করতাম। এখন আর তা সম্ভব হয় না। আশপাশের মিল ফ্যাক্টরির বর্জ্য মিশে এই বংশী নদীর পানি কুচকুচে কালো হয়ে গেছে। দূষণে মাছ ঝিনুক শামুক কিছুই এখানে আর হয় না। সাকার নামে এক ধরনের মাছ এই পানিতে পাওয়া যায় যেটা কেউ খায় না।’

‘আমরা তো নদীর লোক। নদী থেকে নদীতে ঘুরে ঘুরে করে খাই। এখন তো অনেক নদীই শুকিয়ে গেছে। সাপও পাওয়া যায় না আগের মতো। তাই আমাদের ছেলেপিলেরা আর এই পেশায় থাকতে চায় না। তারা স্কুল কলেজে গিয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি বাকরি করছে। আর এ সুযোগটা আমাদের করে দিয়েছেন ঢাকার বর্তমান পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তার জন্যই আমরা এখানে নিজস্ব বসত ঘর পেয়েছি।’

বেদে ফুলবানু বলেন, ‘হাবিব স্যার আমাগো কাছে ফেরেস্তার মতো। আমরা তো ঘুইরা খাইতাম, স্যারের কারণে আমরা এখন এক জায়গায় বসতি গড়তে পারছি। সরকার আমাদের বিল্ডিং কইরা দিসে। আমাগো পোলাপানদের নানারকম প্রশিক্ষণ দিয়া তাদের চাকরির ব্যবস্থা এই স্যারই করসে।’

‘তাছাড়া আমাগো মধ্যে মেয়েরা কখনও সাপ খেলা দেখায় না। এইটা পুরুষের কাজ। শহরের রাস্তায় যে মেয়েরা সাপ খেলা দেখানোর নামে চান্দা তুলে, মানুষরে ধোকা দেয়, সেইসব ধোকাবাজদেরও স্যারের লোকজন ধরসে। তাই রাস্তাঘাটে এদের অত্যাচার এখন কিছুটা হইলেও কমসে।’

সাভার ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রমজান আহমেদ বলেন, ‘আমি নিজেও বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ। এজন্য যখন স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের সঙ্গে কেউ বসতে চাইতো না, বন্ধুত্ব করতে চাইতো না। এমনকি স্কুলেও আমরা সহজে ভর্তি হতে পারতাম না। পাড়া মহল্লার চায়ের দোকানে অন্য আর সবার সঙ্গে চা খেতে গেলেও আমাদের সম্প্রদায়ের মানুষকে হেয় করা হতো।’

‘এখানকার ৫টি গ্রামে ১৪ হাজারের মতো বেদে বসবাস করে, যাদের মধ্যে ভোটার হতে পেরেছে মাত্র ৬ হাজার। ভোট দেওয়ার মতো সক্ষম হলেও শিক্ষার অভাবে বেদেদের অনেকেই বিশেষত যারা বয়স্ক তারা নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র বা ভোটের গুরুত্ব এখনও ঠিক বুঝতে পারেনি। তবে ধীরে ধীরে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এর শুরুটা আজ থেকে ঠিক এক দশক আগে।’

‘২০১৪ সালে তখনকার ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান স্যার (বর্তমান ডিএমপি কমিশনার) আমাদের দুরবস্থা সচক্ষে দেখে যান। এরপর আমাদের আর পেছনে তাকাতে হয়নি। তিনি আমাদের থাকার ব্যবস্থা, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। আগে আমাদের সঙ্গে অন্যায় হলে আমরা প্রতিবাদ করতে পারতাম না। কিন্তু এখন পারি। কারণ আমরা জানি, আর কেউ আমাদের কথা না শুনলেও হাবিব স্যার শুনবেন। এটা আমাদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে।’

‘শুধু তাই নয় তার প্রতিষ্ঠিত উত্তরণ ফাউন্ডেশন আমাদের সন্তানদের শিক্ষার ব্যবস্থা করছে, কারিগরি শিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে তাদের নানা কাজে নিযুক্ত করছে। শুধু এখানেই নয় দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা বেদেদের প্রয়োজনীয় ত্রাণসহ তাদের জীবনমান উন্নয়নে নানারকম কাজ করে যাচ্ছে।’

মানবসেবায় উত্তরণ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছে উত্তরণ কোচিং সেন্টার, উত্তরণ কম্পিউটার সেন্টার, উত্তরণ ফ্যাশনসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে বিনাবেতনে বেদে জনগোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মদক্ষ করে তাদের কাজের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।

উত্তরণ ফাউন্ডেশনের পরিচালক এম এম মাহবুব হাসান বলেন, ‘দেশের ৫৬টি জেলায় বসবাসকারী অনগ্রসর বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মস্থানের জন্য নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে এই প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাদের আত্মনির্ভর করতে প্রতিনিয়ত কর্মসূচি বৃদ্ধি করা হচ্ছে।’

‘একসময় বেদেদের মধ্যে বাল্যবিয়ের হার খুব বেশি ছিলো, এটি কমাতে আমাদের প্রতিষ্ঠাতা বর্তমান পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে বর্তমানে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।’

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: নিবন্ধ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

five × 1 =