সালেক সুফী
স্বল্প সময়ের ব্যাবধানে দুইবার ভারত সফর শেষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী চীন সফর করে দেশে ফিরেছেন। বাংলাদেশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে উন্নয়ন সহযোগী দেশ চীন সফর ছিল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সফরকালে চীনের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়েছে।
সফরের শেষ দিন বুধবার বিকেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিংয়ের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর তাদের উপস্থিতিতে ২১ সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি সই করে বাংলাদেশ ও চীন। এছাড়া সাতটি ঘোষণাপত্র সই করে দুই দেশ।
সমঝোতা স্মারক থেকে চুক্তি দীর্ঘ পথ। দুই দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অনেক সমঝোত স্মারক স্বাক্ষর হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে চুক্তিতে রূপান্তরিত হয় না। সেই বিবেচনায় দ্বিপাক্ষিক সমযোতা সমঝোতা নিয়ে উচ্ছসিত হওয়ার যৌক্তিক কোন কারণ দেখি না।
বাংলাদেশের বিদ্যমান অবস্থায় ১ বিলিয়ন ইউয়ান আর্থিক সহায়তা প্রদানের অঙ্গীকারকে আমি বড় অর্জন বলবো। ওপর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল রোহিঙ্গা সমস্যা নিষ্পত্তিতে চীনের অগ্রণী ভূমিকা। এই বিষয়ে আলোচনা হলেও অর্জন খুব একটা হয়েছে বলে মনে হয় না।
ভারত এবং চীন বাংলাদেশের দুই প্রভাবশালী বন্ধু দেশ। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মূল সহায়ক দেশ। জন্ম লগ্ন থেকেই ভারত নানা ভাবে বাংলাদেশের সকল ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করে। চীন মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করলেও বাংলাদেশের উন্নয়নযজ্ঞের অন্যতম প্রধান অংশীদার।
পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দেশকে বাংলাদেশের উন্নয়নে সম্পৃক্ত রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে বাংলাদেশ কখনো কখনো বেসামাল হয়ে পড়ে। শুধু ভারত চীন নয় বাংলাদেশের উন্নয়নে রাশিয়া, জাপান, কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশগুলো, মধ্যপ্রাচ্যকে সম্পৃক্ত রাখার দুরূহ কাজটি করছেন শেখ হাসিনা।
সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো কোন বিশেষ দেশকে অতিরিক্ত সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো গভীর ভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে মন্দের ভালো কাজ করে চলেছেন শেখ হাসিনা।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ একমাত্র দেশ ভারতের সাথে বড় ধরনের সংকট হয়নি। চারিদিকে ভারত পরিবেষ্টিত দেশ হয়ে ছাড় দিয়ে হলেও সুসম্পর্ক বজায় রাখায় দোষের কিছু নেই। আর ভারত, চীনের মত দুই পারস্পরিক বৈরী দেশকে একই সঙ্গে আস্থায় রেখে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো আদৌ সহজ কাজ নয়।
বর্তমান সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে গঙ্গা চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, সাগর সীমানা বিরোধ নিস্পত্তি সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি নিষ্পত্তি করেছে। ঝুলে আছে তিস্তা সহ অভিন্ন নদীগুলোর ন্যায় ভিত্তিক পানি বণ্টন, চিকেন নেক দিয়ে নেপাল ভুটানের জল বিদ্যুৎ আমদানির ট্রানজিট, সরাসরি বাণিজ্য করার সুযোগ।
বাংলাদেশ অবশ্য ভারতকে রেল সড়ক ট্রানজিট দিতে সম্মত হয়েছে। চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা বন্দর ব্যবহার করতে দিতেও আপত্তি নেই। অনেকেই এই বিষয়গুলোকে একপক্ষীয় বলে বিবেচনা করে ভুল করেছে বলে মনে হয় না।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে উভয় দেশ নিজেদের স্বার্থ বিবেচনায় রেখেই অপর দেশকে সুযোগ সুবিধা প্রদান করে থাকে। ভারতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যতটুকু উদার ভারত এযাবৎ সেই উদারতা দেখায়নি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ভারসাম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ট্যারিফ নন ট্যারিফ বাধা অপসারণ না করায় বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে।
স্বাধীনতার পর থেকে বিশেষত ১৯৭৫ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকে উদারভাবে বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারিত করেছে চীন। বাংলাদেশের অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে আর্থিক এবং কারিগরি সহায়তা দিয়ে চলেছে চীন।
রেল সংযোগ সহ পদ্মা বহুমুখী সেতু, কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণ, অনেক সেতু এবং সড়ক নির্মাণ, যৌথ উদ্যোগে পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ সহ অনেক প্রকল্পে চীনের সহযোগিতার নজির আছে। ভারতের বাধা না থাকলে হয়তো সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হত চীনের সহায়তায়।
ভারতের আর্থিক সহায়তায় বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে, হচ্ছে। তবে বুঝতে হবে আর্থিক সহায়তা প্রদানে চীনের মত সক্ষমতা নাই ভারতের। বুঝতে হবে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে কোন দেশ নিজের স্বার্থ ছাড়া অন্য দেশকে সহায়তা করে না।
একটি দেশ নিজের দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করলে পারস্পরিক সম্পর্কে শক্তিশালী দেন দরবার করতে পারে। বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমা শক্তির চাপ মুক্ত থাকতে ভারত, চীন, রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হচ্ছে।
আমি মনে করি প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে অর্জন কম হয়নি। বর্তমানে আর্থিক সংকট, চলমান উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, জ্বালানি সংকট মোকাবিলা বাংলাদেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। দেখতে হবে চীনের সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারকগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কতটুকু সহায়ক হয়।
চীন কিন্তু একক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। তিস্তা নদীর পানি সংরক্ষণে ভারত চীন যৌথভাবে কাজ করলে বাংলাদেশ উপকৃত হবে।