পরিবেশসম্মত ও জ্বালানিদক্ষ শিল্পপণ্য রপ্তানি বাজারে টিকে থাকবে…

মুশফিকুর রহমান

বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে দ্বিতীয় প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৪% শতাংশের যোগান এ খাত থেকে আসে। ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পখাতের প্রধান কর্মসংস্থানের কৃতিত্ব তৈরি পোশাক শিল্পের। দেশের দ্রুত ও অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং তুলনামূলক উন্নত জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী শ্রমিক পরিযায়নের প্রধান ইন্ধনও তৈরি পোশাক শিল্পের কারণে ঘটেছে। তৈরি পোশাক শিল্পে কাজের সুবিধার্থে শহরতলী এলাকাগুলোতে নিম্ন আয়ের শ্রমিক ও অন্যান্য পেশার মানুষের বসবাসের জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বিভিন্ন অপ্রাতিষ্ঠানিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও এ সকল এলাকায় আকৃষ্ট হয়েছে। নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠির দ্রুত ঘনত্ব বৃদ্ধির ফলে এলাকাগুলোর স্বাস্থ্যসম্মত পানি সরবরাহ, স্যানিটেশন সুবিধা এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ সামগ্রিক বসবাসের পরিবেশে চাপ তৈরি হয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোর মানুষের জীবনমানের যেমন হ্রাস পেয়েছে, একই সাথে সংলগ্ন পরিবেশের অবনতি এবং সামাজিক অস্থিরতাও বেড়েছে।

বৈশ্বিক পোশাক শিল্পের সরবরাহ বাজারে বাংলাদেশে তৈরি সস্তা ও নির্ভরযোগ্য পোশাক রপ্তানি যোগ্যতা এ খাতের বিকাশের সাথে পরিবেশের জন্য যে চ্যালেঞ্জগুলো হাজির করেছে, সেগুলো অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত বিষয়। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে গুরুত্ব, কর্মসংস্থানজনিত গুরুত্ব বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের সাথে সম্পর্কিত পরিবেশ দূষণের আলোচনাকে প্রায়শ উপেক্ষার বিষয় হিসেবে বিবেচনা উৎসাহিত করে। কিন্তু টেক্সটাইল ও তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠান যে সকল শহরতলীতে গড়ে উঠেছে, তার আশে পাশের জলাভূমি, নদ-নদীর বদলে যাওয়া পানির রঙ এবং রাসায়নিক বর্জ্যরে উপস্থিতি, কারখানাসংলগ্ন জায়গাগুলোতে স্তুপীকৃত কঠিন বর্জ্যরে ভাগাড়, বাতাসের দূষণ মান উদ্বেগের কারণ না হয়ে পারে না। প্রাথমিকভাবে পোশাক কারখানার বর্জ্য পচনশীল বা বায়োডিগ্রেডেবল মনে হতে পারে; কিন্তু সিন্থেটিক পলিয়েস্টারসহ পেট্রোকেমিক্যাল উৎস থেকে উৎপাদিত কাপড় ও পোশাক তৈরির বিভিন্ন উপাদান কঠিন বর্জ্যরে ভাগাড়ে ক্রমশই বেশি মাত্রায় জমা হচ্ছে। সেই সাথে  কাপড় তৈরি, রঙ করা, তার আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়ায় যে বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে তার পরিমাণও পরিবেশে বাড়ছে।

বাংলাদেশের টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস শিল্প যে বিপুল পরিমাণ পোশাক উৎপাদন করছে তার গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশ্ববাজারের শীর্ষ ফ্যাশন ব্রান্ড রিবক, টম ফোর্ড, ডিকেএনআই, এইচঅ্যান্ডএম, পুমাসহ আরও অনেকের চাহিদার যোগান দিচ্ছে। সম্প্রতি লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ (আগস্ট ১, ২০২৪) এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে বিশ্বের শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান সমূহের ‘কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য কোনো প্রকাশিত পরিকল্পনা নেই’। মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠানের কার্বন নিঃসরণ হ্রাস সম্পর্কিত পরিকল্পনা জাতিসংঘের নির্ধারিত সূচকের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতি দিয়ে পত্রিকার উক্ত প্রতিবেদনে ২৫০টি শীর্ষ ফ্যাশন ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের উপর পরিচালিত জরিপ থেকে তাদের কার্বন নিঃসরণ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের লক্ষ্যমাত্রা, সাপ্লাই চেইন সম্পর্কিত স্বচ্ছতার বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়েছে। এর মধ্যে শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি ব্র্যান্ড কোম্পানির কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রার অগ্রগতি শূন্য। সাপ্লাই চেইনে যে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডিকেএনআই, টম ফোর্ড এবং রিবক এর মতো শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান পোশাক সংগ্রহ করে, সেখানে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করবার জন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিকল্পনা অপর্যাপ্ত। আরবান আউটফিটার্স এবং ডলসে গাবানা’র অর্জিত (কার্বন নিঃসরণ হ্রাস পরিকল্পনা প্রসঙ্গে) সূচক মাত্র ৩%। সেই দিক থেকে পুমা, গুচি এবং এইচঅ্যান্ডএম ব্র্যান্ড এর টেকসই পরিবেশ সংক্রাস্ত পরিকল্পনা সূচক যথাক্রমে ৭৫%, ৭৪% এবং ৬১%। জরিপ ফলাফল থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, ২৫০টি ব্র্যান্ড এর মধ্যে ১১৭টির কার্বন দূষণ মুক্ত হবার কোনো লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেনি। ১০৫টি প্রতিষ্ঠান এ সম্পর্কিত অগ্রগতি কতটুকু হয়েছে তা জানিয়েছে। অপরদিকে প্রতিষ্ঠানগুলোর জ্বালানি ব্যবহারের প্রবণতা থেকে জীবাষ্ম জ্বালানিনির্ভরতা স্পষ্ট। ৯৪% প্রতিষ্ঠানের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে কোনো প্রকাশিত তথ্য নেই। মাত্র ৪৩% প্রতিষ্ঠানের ব্যবহৃত জ্বালানির উৎস সম্পর্কে তাদের কয়লা, প্রকৃতিক গ্যাস বা নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের স্বচ্ছ তথ্য জানার সুযোগ রয়েছে। পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের  অধিকারের প্রতি সুবিচারের অবস্থান অনুসন্ধানে উল্লিখিত জরিপে হতাশার চিত্রই উঠে এসেছে। বড় ব্র্যান্ড কোম্পানিগুলোর মাত্র ৩% জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্থ এবং প্রধান প্রধান তৈরি পোষাক উৎপাদনকারী দেশের শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা দেবার ক্ষেত্রে তাদের অবস্থান জানিয়েছে ।

বৈশ্বিক ক্রেতাদের, বিশেষত প্রধান প্রধান ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর পরিবেশ সংরক্ষণে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার এবং আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বন নিঃসরণে নেওয়া বাস্তব পদক্ষেপের চিত্র পশ্চিমা প্রভাবশালী সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে অনেকটুকু বোঝা সম্ভব। যদিও বাংলাদেশসহ প্রধান তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশগুলোর ‘নেট জিরো’ কার্বন নিঃসরণে পদক্ষেপকে আরও ত্বরান্বিত করা কেন প্রয়োজন, সে সম্পর্কে  তৈরি পোশাক ক্রেতা ও ভোক্তা দেশগুলোকে উচ্চকণ্ঠে নিয়মিত বলতে শোনা যায়। তাছাড়া তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে সেগুলো যে পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রস্তুত করা হয়েছে, নীতি নৈতিকতা মেনে ভোক্তাবাজারের জন্য সংগৃহীত হয়েছে ক্রেতারা তা দেখতে চান। একইভাবে তারা দেখতে চান যে তৈরি পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ নিরাপদ, শ্রমঅধিকার রক্ষিত ও পরিবেশবান্ধব ।

সাভারের রানা প্লাজার মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমনিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশ উন্নয়নে ইতিমধ্যে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তাছাড়া কারখানার সবুজায়ন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে (প্রধানত রুফটপ সোলার ফটোভোল্টাইক সেলনির্ভর সৌর বিদ্যুৎ) বাংলাদেশে তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কারখানা তরল বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থা স্থাপন, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে কার্বন নিঃসরণ  হ্রাস, উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত কাঁচামালের সর্বোত্তম ব্যবহার, ন্যূনতম পরিমাণ পানি ও রাসায়নিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হচ্ছে। ফলে উৎসে হ্রাস পাচ্ছে দূষণ। উৎপাদন ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নের ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমদক্ষতা বাড়ছে, পরিবেশসম্মত উৎপাদন এবং কারখানা শ্রমস্বাস্থ্যের উল্লেখযোগ্য  অগ্রগতি হয়েছে বলে ক্রেতাদের আস্থাও বাড়ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের ২২০টি ‘লিড’ সার্টিফিকেটধারী তৈরি পোশাক কারখানা রপ্তানি বাজারের জন্য পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ করছে। আরও কয়েকশ তৈরি পোশাক কারখানা ‘লিড’ সার্টিফিকেট অর্জনের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, কোনো কারখানা ভবন দক্ষ জ্বালানি ব্যবহার ও পরিবেশ দায়বদ্ধতা মেনে পরিচালিত ভবনে কারখানা পরিচালনার জন্য ‘লিড’ সাটিফিকেট পাবার যোগ্যতা অর্জন করে।

তৈরি পোশাক কারখানাসমূহ বাংলাদেশে এখন কেবল সস্তা পোশাক উৎপাদন নিয়ে নিজেদের বৃত্তাবদ্ধ করে নেই, সেই সাথে পণ্যের বহুমুখীকরণ, দামী ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোর জন্য নির্ভরযোগ্য আস্থার পোশাক উৎপাদক ও সরবরাহকারী হিসেবে তাদের জায়গা নিশ্চিত করেছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: পরিবেশ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

11 − five =