হাবিব রহমান
জাহান আফরোজ থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। প্রতি গ্রীষ্মে তিনি আম কিনতে সুপার শপে যান এবং সেখানে তিনি বেশিভাগই থাই আম খুঁজে পান। তিনি কিছু সেরা জাতের বাংলাদেশি আম খেয়ে বড় হয়েছেন। ফলে তিনি সেখানে যে আম পান সেগুলো তার পছন্দ না।
জাহান আফরোজ ফোনে বলেন, ‘বাংলাদেশের আমের তুলনায় এগুলো আমই নয়। এগুলো শুধু আমের মতো আকৃতির। এগুলো থেকে কোনো গন্ধ নেই বা কোনো রসও নেই।’
শুধু জাহান নন, প্রায় সব প্রবাসী বাংলাদেশি একই রকম মনে করেন। তারা বিদেশে বাংলাদেশের আম চান। আর তাদের সঙ্গে একমত আম রপ্তানিকারকরাও।
লি এন্টারপ্রাইজ ফ্রুট এক্সপোর্টার্সের সত্তাধিকারী আবুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের আমের খোসা ছাড়ালে মিষ্টি সুগন্ধ পাওয়া যায়। আপনি থাই বা চাইনিজ আমের কোনো গন্ধ পাবেন না। তাই বিদেশিরাও আমাদের আম পছন্দ করে।’
আবুল হোসেন আরও বলেন, ‘আমাদের আম রপ্তানির পরিসংখ্যান অবশ্য ভিন্ন গল্প বলে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ মাত্র ২ হাজার ৭০০ টন আম রপ্তানি করে। আম রপ্তানিকারক শীর্ষ ১০টি দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশ নেই। অথচ বাংলাদেশ অষ্টম বৃহত্তম আম উৎপাদনকারী দেশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২ হাজার ৭০০ টন রপ্তানির বিপরীতে আমের উৎপাদন ছিল ১৪ মিলিয়ন টন।
প্রশ্না হলো, এতো চাহিদা এবং এত বেশি উৎপাদন থাকা সত্ত্বেও আমাদের আম রপ্তানি এত কম কেন? বিশ্বব্যাপী আমের বাজার কয়েক বছর ধরেই বাড়ছে। বিজনেস রিসার্চ গ্রুপের মতে, আমের বাজারের আকার ২০২৩ সালে ৬৩ দশমিক ৬৫ বিলিয়ন থেকে ২০২৪ সালে ৬ দশমিক হারে ৬৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আমের স্বাদ বাংলাদেশেরটা ভালো। তারপরও প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ড আমাদের চেয়ে বাণিজ্য ভালো করছে।
চলতি বছরে রপ্তানি নেমেছে অর্ধেকে
বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের প্রায় ৩৮ দেশে আম রপ্তানি হয়। গত বছরে আম রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টন। এ বছর রপ্তানি চলমান থাকলেও এখন পর্যন্ত হয়েছে মাত্র ৮৭৯ টন। গত বছরের এ সময়ে আম রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৮৫৮ টন। অর্থাৎ গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এ বছর আম রপ্তানি অর্ধেকের বেশি কমেছে।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, একদিকে বেড়েছে বিমান ভাড়া। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে বেড়েছে জাহাজ ভাড়াও। ফলে পাঠানোই অনেক ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ফ্রুটস, ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএফভিএপিইএ)-এর উপদেষ্টা কৃষিবিদ মো. মনজুরুল ইসলাম বলছেন, রপ্তানি কমার অন্যতম কারণ বিমান ভাড়া বেড়েছে। গত বছর প্রতি কেজি আম ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে ৩২০-৩৩০ টাকা করে। এ বছর সে আম পাঠাতেই খরচ পড়ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা করে।
এক প্রশ্নের জবাবে মনজুরুল ইসলাম বলেন, ‘এয়ারলাইন্সগুলো আকাশপথে পরিবহনে গার্মেন্টস পণ্যকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে সবজি, ফলমূলকে কম সুযোগ দিচ্ছে। ইউরোপের জন্য মাত্র একটি ডেডিকেটেড স্ক্যানিং মেশিন রয়েছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায় মেশিন চলে না। তখন রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) বলছে, গত বছর বিশ্বের ৩৮ দেশে ৩ হাজার ৯২ টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ এবং আগের বছরের তুলনায় ৭৩ শতাংশ বেশি। গত বছরের ১৪ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫৮ টন আম রপ্তানি হয়েছিল। এ বছর এখন পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ৮৭৯ টন।
আম উৎপাদনে অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ, রপ্তানিতে পিছিয়ে
সংশ্লিষ্টরা জানান, আম রপ্তানিতে পিছিয়ে থাকলেও উৎপাদনে বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২২ লাখ ২৯ টন। রপ্তানি হয় মাত্র ৩১০ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৮ লাখ হেক্টর জমিতে।
২০১৯-২০ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৬৮ টন এবং রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ২৮৩ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৮৯ লাখ হেক্টর জমিতে।
২০২০-২১ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৫ লাখ টন, রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৭৯১ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ১ দশমিক ৯৮ লাখ হেক্টর জমিতে।
২০২১-২২ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৩ লাখ ৫০ টন, রপ্তানি হয়েছিল ১ হাজার ৭৫৭ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৮ লাখ হেক্টর জমিতে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ২৭ লাখ ৭ টন, রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ১০০ টন। একই সময়ে আম চাষ হয় ২ দশমিক ০৫ লাখ হেক্টর জমিতে।
তবে চলতি বছরে গত বছরগুলোর তুলনায় আম উৎপাদন কম হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: নিবন্ধ