আশফাক আহমেদ
চলতি বছরের জুন মাসে দেশে ৭২৬টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণহানির সংখ্যা ৬৪৪, আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ হাজার ৮২ জন। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনে আরো দেখা যায়, গত মে মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৮৬ জনের মৃত্যু হয়। সংগঠনটি বলছে, অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ করণীয় হলো প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানো। মোটকথা দেশে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করার বিকল্প নেই।
নিরাপদ, টেকসই ও একটি স্মার্ট সড়ক পরিবহন অবকাঠামো ও অপারেশন ব্যবস্থা নিশ্চিতের লক্ষ্যে এরইমধ্যে আইটিএস প্রকল্প হাতে নিয়েছে সরকার। কন্ট্রোল রুম থেকে ‘ভেহিকেল ডিটেক্টিভ সিস্টেমের (ভিডিসি)’ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহনের ওপর এমনভাবে নজরদারি করা সম্ভব, যাতে চলতি পথে চালকরাও জানতে পারবেন তার বাহনের গতি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রয়েছে কিনা। নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সতর্ক হওয়ার সুযোগ পাবেন। কোনো গাড়ি নির্ধারিত গতি অতিক্রম করলে সেটিকে চিহ্নিত করা যাবে। পাশাপাশি নিয়ম ভাঙলে চালকের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া ও কোনো দুর্ঘটনা হলে তাৎক্ষণিক সহায়তায় পাঠাতে ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সময় ও জ্বালানি সাশ্রয়, যানজট ও দূষণমুক্ত, সর্বোপরি দুর্ঘটনামুক্ত দক্ষ সড়ক নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। বর্তমানে নিরাপত্তা ও আরাম নিশ্চিতে গাড়িতেও নানা রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে অটোনমাস বা স্বচালিত যানও দেশের বাজারে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা পূর্বাভাস দিচ্ছেন। অটোনমাস ড্রাইভিং ধীরে হলেও বাস্তব হয়ে উঠছে। আরও বেশি আধুনিক প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে গাড়ি ও চালক।
অনেক গাড়িতেই দেখা যায় লেন কিপিং, সোয়ার্ভিং ও ব্রেকিং অ্যাসিস্টেন্ট। স্বয়ংক্রিয় গতি নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তি ইন্টেলিজেন্ট স্পিড অ্যাসিস্ট্যান্ট নামের ডিভাইস বিল্ট-ইন-ফিচার হিসেবে সংযুক্ত হচ্ছে। গ্রাহকদের জন্য সড়কে চলাচল নিরাপদ করতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে বর্তমানে এই ফিচারটির ব্যাপক চাহিদা। ইন্টেলিজেন্ট স্পিড অ্যাসিস্ট্যান্ট এমন প্রযুক্তি, যা গাড়ির সামনে থাকা ক্যামেরা, জিপিএস বা ডেটা অথবা দুটোই ব্যবহারের মাধ্যমে রাস্তায় নির্ধারিত গতিবিধি ও গাড়ির গতি যাচাই করতে পারে। চালকের প্রোফাইল ও নির্ধারিত মডেল অনুযায়ী এ প্রযুক্তি গাড়ির নির্দিষ্ট গতিসীমার বিষয়ে জানায়। এছাড়া প্রযুক্তিটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গাড়ির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মাধ্যমে রাস্তার নির্ধারিত গতিসীমার সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে পারে। গাড়ির ইঞ্জিনের শক্তি কমিয়ে গতি কমাতেও কাজ করে।
গাড়ির ভারসাম্য বজায় রাখতে ও লেনের ভিতরে বা বাইরে শনাক্ত করতে সহায়তা করে লেন ডিপার্চার সেন্সর। এই প্রযুক্তি চালকদের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে এবং সম্ভাব্য ক্র্যাশ, রোল ওভারে প্রতিরোধে সহায়তা করে। আরও আধুনিক এবং বৈচিত্র্যময় স্বয়ংক্রিয় এবং জরুরি ব্রেকিং প্রযুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় ইমার্জেন্সি ব্রেকিং, ক্র্যাশ ইমিনেট ব্রেকিং, ডায়নামিক ব্রেক সাপোর্ট এবং পেডেস্ট্রিয়ান ইমার্জেন্সি ব্রেকিং। এই প্রযুক্তিগুলো গাড়ির সামনের যানবাহনগুলোকে শনাক্ত করে এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা শনাক্ত হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক করে। ‘ডায়নামিক ব্রেক’ এবং ‘ক্র্যাশ ইমিনেট ব্রেকিং’ প্রযুক্তি পথচারীদের শনাক্ত করতে রাডার সেন্সর ও ক্যামেরা ব্যবহৃত হয়।
ব্লাইন্ড স্পট এমন একটি প্রযুক্তি যা গাড়ির বাইরের যে এলাকা চালক তার আসন থেকে দেখতে পায় না সেদিক থেকে আসা অন্য গাড়ির বিষয়ে সতর্ক করে। ব্লাইন্ড স্পট পর্যবেক্ষণসহ বাইরের চারপাশে রাডার সেন্সর এবং ক্যামেরা স্থাপন করে। যা চালকদের তাদের আশপাশে অন্যান্য যানবাহনের উপস্থিতি সম্পর্কে সতর্ক করে। গাড়ির চালককে গতিসীমার ব্যাপারে সতর্ক করতে ব্যবহৃত আরেকটি সিস্টেম হলো স্পিড ওয়ার্নিং। সিস্টেমটি বিল্ট-ইন স্পিড সেন্সর ব্যবহার করে গতিসীমা অতিক্রম করলে ড্রাইভারকে অবহিত করে। এই প্রযুক্তি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল কিংবা কাজের জোনের গতিসীমা স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন ও ট্র্যাক করতে পারে।
আমাদের দেশে এখন চারলেন, আটলেন, ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেস হাইওয়ে, পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেল সবটাতেই আধুনিক প্রযুক্তি হয়েছে। অন্যান্য সড়ক ও রেলপথেও ভবিষ্যতে নিত্য নতুন প্রযুক্তি সংযুক্ত হবে। একইসঙ্গে গাড়ির মডেলও চেঞ্জ হবে, সংযোজিত হবে আধুনিক ডিভাইস। এজন্য দুর্ঘটনা এড়াতে ও স্মার্ট যোগাযোগ ব্যবস্থার অংশীদার হতে গাড়ির চালকদেরও এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষমতা অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ।
ধারণার চেয়ে দেড়শ কোটি বছর আগে প্রাণের সূচনা!
এতোদিন ধারণা ছিল, পৃথিবীতে প্রাণীর উদ্ভব হয় ৬৩ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে। কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির নেতৃত্বে করা সাম্প্রতিক এক গবেষণায় এরও অনেক আগের প্রাণীর বাস্তুতন্ত্র গঠনের সন্ধান মিলেছে। মধ্য আফ্রিকার দেশ গ্যাবনের নিকটবর্তী ফ্রান্সভিল বেসিন বা অববাহিকায় এ বাস্তুতন্ত্র পাওয়া গেছে। গবেষণার তথ্য বলছে, বিজ্ঞানীদের ধারণার চেয়েও প্রায় ১৫০ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে জটিল প্রাণের সূচনা হয়।
গবেষকরা বলছেন, পাথরের গভীরে ২১০ কোটি বছর আগে প্রাণী জীবনের পরিবেশগত অবস্থার প্রমাণ পেয়েছেন তারা। এই বাস্তুতন্ত্র ভূমিঘেরা এক সাগরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এরা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েনি ও শেষ পর্যন্ত সেখানেই বিলীন হয়ে গেছে। প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে প্রচলিত ধারণার সঙ্গে নতুন গবেষণার ফলাফলে মিল না থাকায় এর সঙ্গে সব বিজ্ঞানী একমত নন। বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের দাবি, পৃথিবীতে জটিল প্রাণের শুরু প্রায় ৬৩ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে।
কার্ডিফ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আর্নেস্ট চি আন্তর্জাতিক এক বিজ্ঞানী দলের সঙ্গে কাজ করেছেন। তিনি জানান, সন্ধান পাওয়া প্রাণীর গঠনে জীবাশ্ম ও অক্সিজেন রয়েছে। এজন্য প্রথম জটিল প্রাণের বিষয়টি সামনে এসেছে। প্রাণের অস্তিত্বকে সমর্থন করে কি না তা জানতে, আশপাশের পাথর খতিয়ে অক্সিজেন ও ফসফরাসের মতো উপাদানের প্রমাণ খুঁজছেন গবেষকরা। অধ্যাপক আর্নেস্ট বলেন, ৬৩ কোটি ৫০ লাখ বছর আগে ক্যামব্রিয়ান যুগে যে প্রক্রিয়া এর আগে আবিষ্কৃত হয়েছে, একই প্রক্রিয়া এখানেও দেখা গেছে। এবং এতে প্রাণের সূচনা কোথা থেকে তা বুঝতে সহায়তা হচ্ছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক গ্রাহাম শিল্ডস এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত নন। এবং এ গবেষণা থেকে আসা সিদ্ধান্তে তার কিছু আপত্তি আছে। শিল্ডস বলছেন, ২১০ কোটি বছর আগে পুষ্টি সমৃদ্ধ প্রাণী থাকতে পারে গবেষণার এ ধারণার বিরুদ্ধে নন তিনি। কিন্তু এটি জটিল জীবন গঠনের বৈচিত্র্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না। এজন্য আরো প্রমাণ প্রয়োজন। অধ্যাপক শিল্ডস ছাড়াও গবেষণার এ ফলাফলের সঙ্গে এমন আরো বিজ্ঞানী একমত নন।
এ তত্ত্বের পক্ষে আরো প্রমাণ খুঁজতে অধ্যাপক আর্নেস্ট চি ও তার গবেষণা দল গ্যাবনের পাথর থেকে খনন করা পলির একেবারে ভেতরের স্তর বিশ্লেষণ করেছেন। যা থেকে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে এ গঠন খুঁজে পাওয়ার ঠিক আগে এখানে প্রাণের জন্য এক পরীক্ষাগার তৈরি হয়েছিল। তাদের দাবি, উচ্চ মাত্রার অক্সিজেন ও ফসফরাস তৈরি হয়েছিল পানির নিচে দুটি মহাদেশীয় প্লেটের সংঘর্ষের ফলে, যা আগ্নেয়গিরির মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। এই সংঘর্ষের ফলে মহাসাগর থেকে পানির একটি অংশ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, যা ভূমিঘেরা পুষ্টি সমৃদ্ধ এক অগভীর সমুদ্র তৈরি করেছে। পানির ভরের প্রকৃতির সীমাবদ্ধতা ও কোটি কোটি বছর ধরে চলা প্রতিকূল অবস্থার কারণে এমনটি হতে পারে। গবেষকদের দাবি, এটি পৃথিবীতে জটিল জীবনের সম্ভাব্য ‘টু-স্টেপ’ বা দুই পদক্ষেপে বিবর্তনকে নির্দেশ করে। বিজ্ঞানভিত্তিক জার্নাল প্রিক্যামব্রিয়ান রিসার্চে এ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করা হয়েছে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: টেক ট্রেন্ড