‘আজব কারখানা’ একটি প্রশান্তির সিনেমা: ইমি

রোজ অ্যাডেনিয়াম

দেশের সুপার মডেলদের তালিকা করলে প্রথম দিকে থাকবে শাবনাজ সাদিয়া ইমির নাম। দেশের র‌্যাম্প ইন্ডাস্ট্রি ও মডেল ইমির ক্যারিয়ার সমবয়সী। ক্যাটওয়াকে ঝড় তোলেন। অভিনয়েও প্রমাণ করেছেন নিজেকে। বাকি ছিল সিনেমা। ক্যারিয়ারের দুই যুগ পর সেখানে যুক্ত হয়েছেন ‘আজব কারখানা’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। রঙবেরঙয়ের সঙ্গে কথোপকথনে উঠে এসেছে ইমির ক্যারিয়ারের নানা দিক।

‘আজব কারখানা’ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?

আমার সিনেমাটা করা দরকার ছিল। বন্ধু, দর্শক, সহকর্মী, আপনাদের থেকে যে সাড়া পেলাম; আমি আসলেই ভাষাহীন। জানতামই না আমি এতটা পাওয়ার যোগ্য। মনে হয় একটু পরে হলেও পারফেক্ট টাইমে পারফেক্ট রিয়্যাকশন পাচ্ছি। এটা আমার কাছে অনেক বড়। কী চলে গেছে, কী পাইনি; চিন্তা করতে গেলে সময় নষ্ট। কারণ লাইফ ইজ ওয়ান, টাইম শর্ট। হয়তো দেরি করে মুভিতে যুক্ত হয়েছি কিন্তু সময় তো ফুরিয়ে যায়নি। আমার যেহেতু ডেডিকেশন ভালো, প্র্যাক্টিস লেভেল, স্টাডি লেভেল হাই; মনে হয় সামনে সিনেমা, ওটিটি কিংবা পাশের দেশে কোনো কাজ আসে সেটা অনেক ভালো হবে।

‘আজব কারখানা’ কেন হলে গিয়ে দেখবেন দর্শক?

কারণ এটি প্রশান্তির সিনেমা। আমরা এখন বাণিজ্যিক সিনেমার জোয়ারে আছি। এর বাইরে কেউ প্রশান্তি চাইলে এই সিনেমায় পাবেন। শহর, গ্রাম দুই জীবনই দেখানো হয়েছে। সবুজ দেখতে পাবেন। শান্তির কিছু দৃশ্য দেখতে পাবেন। এটি একজন রকস্টারের জীবন কাহিনী বলতে পারি। রকস্টার যখন শিকড় খুঁজতে চায়, নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করতে যায় তখন বাংলাদেশের সংগীতের শিকড়, যে মানুষগুলো এই মিউজিক ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত, আসল পাইওনিয়ার তাদের জীবন দেখানো হয়েছে। অনেক দৃশ্য আছে যেগুলো বিশাল পরিসরে। লার্জার দ্যান লাইফ বলা যায়। এখানে অনেক ধরনের মানুষ, মানসিকতা, আবেগ আছে। নতুন প্রজন্মের জন্য এটা একটি গোল্ডেন ফিল্ম। সিনেমাটি দেখলে তারা বাংলাদেশের সংগীতের শিকড় সম্পর্কে আরও জানতে চাইবে। শবনম (শবনম ফেরদৌসি) আপা ডকুমেন্টারি তৈরি করতেন। এখানে সেই প্রশান্তি আছে। কোনো তাড়াহুড়ো হইহুল্লোড় নেই। দর্শক দেখলে বুঝতে পারবেন।

আরও আগেও তো সিনেমা করতে পারতেন। এত দেরিতে কেন?

দেরি না ঠিক, সময় নিয়েছি। ২০০১-০২ সালে আমি কাজ শুরু করি। তখন বাংলাদেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এতোটা উন্নতি করেনি। আমরা ফ্যাশন দুনিয়ায় যতটা আধুনিক ছিলাম এবং বিশ্বের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে চলছিলাম চলচ্চিত্র ততটা আধুনিক ছিল না। সেসময় সিনেমার অনেক প্রস্তাব পেয়েছি বলব না তবে সংখ্যাটা কমও না। কিন্তু করিনি। কারণ সময়টা সঠিক ছিল না। আমিও অতটা প্রস্তুত ছিলাম না। কেননা বড়পর্দা হচ্ছে ম্যাসিভ মিডিয়া। এখানে প্রস্তুতি নিয়ে জেনেশুনে, পড়াশোনা করে অর্থাৎ সবকিছু শিখে আসা উচিত। হয়তো একটু দেরি হয়ে গেছে তবে সবকিছু শিখে জেনে বুঝেই এসেছি। সঠিক জায়গা থেকে প্রস্তাবের অপেক্ষাও ছিল। কেননা দেশের মানুষ, ইন্ডাস্ট্রির মানুষ মডেলিং ইন্ডাস্ট্রিতে আমাকে যে জায়গা দিয়েছেন সেখান থেকে মনে হয় এই কাজটি দেখে সবাই যে উচ্ছ্বাস করছেন অন্য কাজ হলে উচ্ছ্বাসটা এরকম হতো না। সামিয়া জামান (সিনেমার প্রযোজক) এবং শবনম ফেরদৌসী (পরিচালক) নারী শক্তি। এটা আমাকে উৎসাহিত করেছে। মনে হয়েছে সিনেমায় নাম লেখানোর জন্য এটি আমার সঠিক সময়।

প্রথম সিনেমায় পরমব্রতকে পেয়েছেন। তার সঙ্গে অভিনয়ের পর উপলব্ধিটা কী?

কলকাতার সিনেমা বরাবরই ভালো লাগে। সবসময়ই দেখি। সেখানকার অভিনেতাদের মধ্যে পরমব্রত, আবীর চট্টোপাধ্যায় আমার পছন্দের। আবীরের অনেক কাজ দেখেছি। সুদর্শন দেখতে। তার চেয়ে ভালো অভিনয়। অভিনেত্রীদের মধ্যে পছন্দ কঙ্কনা শর্মাকে। তার সব কাজই আমার দেখা। বলিউড, কলকাতা যেখানকারই হোক। রাইমা সেন, পাওলি দামের কাজও ভালো লাগে। কলকাতার কাজগুলোর প্রতি আমার আলাদা একটি মুগ্ধতা আছে। আর আমার পছন্দের তালিকায় পরমব্রত আছেন বলেই তার সঙ্গে কাজটা ভালো হয়েছে।

আপনি যে বাংলাদেশের একজন সুপার মডেল, পরমব্রত কি জানতেন?

পরমব্রত জানতেন, তার বিপরীতে ক্যারেক্টারটা যিনি প্লে করবেন তিনি বাংলাদেশের একজন মডেল। কিন্তু চিনতেন না। আমি যেহেতু আমাদের মডেলিং ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিত্ব করি সেহেতু মনে হয় আমার সঙ্গে কাজ করে তারও কিছুটা ধারণা হয়েছে। বুঝতে পেরেছেন আমাদের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অনেক এগিয়ে। আমার মনে হয় তিনি অবাক হয়েছেন। এর আগে যাদের সঙ্গে কাজ হয়েছে তাদের বাইরে কাউকে তিনি দেখেননি। এবার দেখলেন বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির লোকজন কেমন হয়। মনে হয় তার অভিব্যক্তি ভালো হওয়া উচিত। প্রথমে হয়তো ভেবেছিলেন আমি খুব শিশুসুলভ। পরে কাজ করার সময় আস্তে আস্তে আমাকে বুঝতে পেরেছেন। শুটিংয়ের সময় যেহেতু থাকতে হয় সেহেতু সহশিল্পীকে বোঝার সময় মেলে। এদিক থেকে তার অভিব্যক্তিটা বেশ ভালো মনে করি। আর আমি খুশি যে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মতো কলকাতার একজন অভিনেতা আমাদেরও জানতে পারল।

শোনা যায়, ক্যাটওয়াকে ভবিষ্যৎ নেই। এই ট্র্যাকেই রয়ে গেলেন কেন?

ক্যাটওয়াকের ভবিষ্যৎ নিয়ে কখনও চিন্তা করিনি। আমি মনে করি ক্যাটওয়াকের অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ খুঁজলে হবে না। বাংলাদেশে একসময় র‌্যাম্প ইন্ডাস্ট্রি ছিল না। আমি এ ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠতে দেখেছি। এখন র‌্যাম্প মডেলিংয়ের জন্য মানুষ প্রশিক্ষণ নিতে আসে। ইন্ডাস্ট্রি আগেও ডেভেলপ ছিল এখন আরও হয়েছে। এই ট্র্যাকটাতে আমার হিসাবে কখনও অমিল হয় না। এখানে কঠোর পরিশ্রম, এনার্জি, ডেডিকেশন লগ্নি করে কখনও ব্যর্থ হইনি। এক সময় আমিও অনেক কাজ করেছি। নাটক, বিজ্ঞাপন করেছি। বড় বড় নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ হয়েছে। কিন্তু সব দেখে মনে হয়েছে মডেলিং ইন্ডাস্ট্রি একমাত্র জায়গা যেটা স্থায়ী ও টেকসই। আমি কখনও মডেলিংয়ে রয়ে যায়নি, আমি মডেল-ই। আমি প্রথমত আপনাদের বলা বাংলাদেশের একজন সুপার মডেল। এরপর অন্যকিছু। অতএব এখানে থেকে যাওয়ার কিছু নেই। চলে যাওয়ারও কিছু নেই। অনেক ছোটবেলা থেকে এখানে কাজ করি। স্টেজ, র‌্যাম্প আমার সেকেন্ড হোম। এখানেই বড় হয়েছি। আমার কৈশোর, তার পরের সময়— সব এখানে দিয়েছি।

এখন কি দেশে ক্যাটওয়াকে ভবিষ্যৎ আছে?

আমার মনে হয় ক্যাটওয়াকের কোনো অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নেই। এটি একটি প্যাশনেট প্রফেশন। এর প্রতি ভালোবাসা না থাকলে হবে না। শুধু সুপার মডেল হব, তারকা হব, আয় করব কিংবা কিছুদিন মডেলিং করে ওই পরিচয় অন্য সেক্টরে কাজে লাগাব এগুলো কোনো কাজেই আসবে না। ক্যাটওয়াক এমন একটি বিষয় যেটা ভেতর থেকে গড়ে উঠতে হবে। ভালোবাসা থাকলে এখানে পাস্ট প্রেজেন্ট ফিউচার কাজ করবে না।

নাম-যশ-খ্যাতি পেয়েছেন। প্রত্যাশার চূড়া ছুঁতে পেরেছেন?

হ্যাঁ, প্রথম ক্যাটওয়াকেই মনে হয়েছিল এই কাজটির জন্যই আমার হয়তো জন্ম। এই কাজটি আমার জন্য আরামদায়ক হবে। এমন কাজ করতে চাইনি যেখানে আফসোস থাকবে না অনুশোচনা থাকবে না শুধু জীবনে চালাতে করতে হবে। আমি এটাকে সবসময় ভয় পেতাম। চাইতাম এমন কোনো কাজ যেন আমাকে করতে না হয় যেখানে আমার শৈল্পিক ও সৃষ্টিশীল মানসিকতার কিছু থাকবে না, মনের খোরাক হবে না। সেলিব্রেটিদের যারাই তারকাখ্যাতি পেয়েছেন একটা সময় এসে সবাইকে নাজুক সময় দেখতে হয়। এটা চিরন্তন সত্য। প্রত্যাশার যেটা চূড়া আমি ভাবতাম তার চেয়ে অনেক বেশি পেয়েছি। আবার কখনও মনে হয়েছে যতটুকু ডিজার্ভ করি তার চেয়ে কম পেয়েছি। মানুষ ঠকিয়েছে। দুই ধরনের অনুভূতিই কাজ করেছে। তারপরও বলবো এক জীবনে মডেলিংয়ের মাধ্যমে যে সম্মান, বাহবা, অবস্থান আমি পেয়েছি তা অতুলনীয়। বলা হতো অন্য দেশ বা পাশের দেশে গেলে আরও ভালো করতে পারব। কিন্তু আমার মনে হয় যে মানুষ নিজের দেশে ভালো করতে পারে না সে কোথাও ভালো করতে পারে না। আমি চাইতাম দেশের মানুষ তালি দিতে থাকবে সেই তালির আওয়াজে আমি ইন্টারন্যাশনাল ক্যাটওয়াক, মুভি; সবকিছুতে অংশ নিতে পারব। কারণ বাংলাদেশ যদি আমাকে উৎসাহ না দেয় তাহলে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করেও আমার তৃপ্তি আসবে না।

দেশে ওয়েব কনটেন্ট নির্মাণের শুরুর দিকে অভিনয় করেছেন। এখন আপনাকে দেখা যায় না কেন?

এখন অনেক ওয়েব সিরিজ, সিনেমা হচ্ছে। অনেক ধরনের চরিত্র থাকছে। আর্টিস্টদের নিজেদের মেলে ধরার সুযোগ বাড়ছে। মনে হয় আমি পিআরে খানিকটা পিছিয়ে। একারণেই হয়তো আপনাদের ভাষ্যমতে কোয়ালিটি থাকার পরও আমাকে দেখা যায় না। এখানে অনেকগুলো বিষয় জড়িত। এক কথায় বলা যাবে না। আমি কাজ করি না যে তা না। যখন কোনো প্রজেক্টগুলো হয় তখন যেসব শিল্পী চেনেজানা, বন্ধু, পরিচিতদের নিয়ে করা হয় বলে আমার ধারণা। আমার ধারণা তো ভুল হতে পারে না। একদিনে তো আর এই ধারণা হয়নি। এখানকার সিস্টেম কী বা কীভাবে কাজ হয়, আমাকে অনেক গবেষণা করতে হয়েছে। হয়তো আমার দিক থেকে কিছুটা খামতি আছে তাদের দিক থেকেও আছে। আমার মনে হয় কাস্টিং বিষয়টা ফ্রেন্ডলি না।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 + 13 =