গানের হাত ধরে আমি হাঁটি: মৌমিতা বড়ুয়া

অপরাজিতা জামান

মৌমিতা বড়ুয়া বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মেয়ে। ছোট থেকেই সংগীতের সঙ্গে বসবাস। ২০১৭ সালে সংগীত প্রতিভা অন্বেষণমূলক অনুষ্ঠান চ্যানেল আই সেরাকণ্ঠে মেধার স্বাক্ষর রেখে জায়গা করে নিয়েছিলেন সংগীতাঙ্গনে। বলা যায় অভিষেকটা তার রাজকীয় ছিল। বর্তমানে সরব বিচরণ। ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন গানের হাত ধরে। মেধাবী এ কণ্ঠশিল্পী কথা বলেছেন রঙবেরঙ-এর সঙ্গে। শুনিয়েছেন শুরুর গল্প, বর্তমান ব্যস্ততার কথা। আঁচ দিয়েছেন ভবিষ্যতের।

আপনার শুরুর গল্পটা জানতে চাই…

আমার বাবা বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের একজন সংগীতশিল্পী। ফলে ঘরের বাইরে যেতে হয়নি। বাবার হাত ধরেই সংগীতের সঙ্গে সখ্যতা শুরু। পরে সুব্রত দাশ অনুজের কাছে উচ্চাঙ্গ সংগীতে তালিম নেই।

সংগীতাঙ্গনে যাত্রা শুরুর পর যা অর্জন তা প্রত্যাশার চেয়ে বেশি না কম?

গান নিয়ে প্রত্যাশার কথা যখন আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে তখন একটা কথাই বলি; আমি গানকে হাত ধরে হাঁটাই না, গানের হাত ধরে আমি হাঁটি। শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করি। গান আমাকে যেখানে নিয়ে যাবে আমি সেখানেই যাব। ভবিষ্যতে কী হবে আমরা বলতে পারি না। মানুষের রুচির পরিবর্তন হয়, ট্রেন্ড পাল্টায়। যে কারণে আমি চাই বেসিক ঠিক রেখে গান করতে। কারণ গান করলেই যে শ্রোতাদের ভালো লাগবে এমনটা না। শুদ্ধ সংগীতের চর্চা করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি গান গুরুমুখী বিদ্যা। কেউ কেউ বলেন, কোথাও গান শেখেননি। তারপরেও বলবো তিনি কোনো না কোনোভাবে গান শিখেছেন। সেটা হোক গুরুর থেকে কিংবা কোথাও শুনে। শোনাটাও একটা শেখার জায়গা। আমি যেহেতু জন্ম নিয়েছি সংগীত পরিবারে তাই গান আমার জন্য আবশ্যক ছিল। আমাদের পরিবারের সদস্যরা পড়াশোনার মতোই গান করবে। এটা অবধারিত। আমিও জানতাম গানকে সাথে করেই চলতে হবে। আর প্রত্যাশার জায়গাটা এভাবে বলি না কারণ প্রত্যাশা পূরণ না হলে হতাশা পেয়ে বসবে। যা একজন শিল্পীর জন্য প্রতিবন্ধকতা। সে কারণে প্রত্যাশা করে হতাশায় আক্রান্ত হতে চাই না।

প্রথম মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ানোর অনুভূতি কেমন ছিল?

সেটা অন্যরকম ছিল। সেরাকণ্ঠে নাম লেখানো আমার পারিবারিক সিদ্ধান্ত ছিল। সেখানে শেষপর্ব পর্যন্ত টিকে যাওয়াটা প্রত্যাশার মধ্যে ছিল না। হয়তো ভালো করেছিলাম। সে কারণেই বিচারকদের রায় এবং দর্শকের ভোটে শেষ পর্যন্ত ছিলাম। এরপর যখন আমি প্রথম মঞ্চে দাঁড়াই তখন একটা জিনিস খুব ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে আগে আমাকে তেমন কেউ চিনত না, সেরাকণ্ঠের পর দেখলাম সারা দেশের মানুষ আমাকে চেনে। দর্শকের প্রতিক্রিয়ায় সেটা বুঝতে পারছিলাম। ওই ভালো লাগাটা অন্যরকম ছিল।

আপনাকে প্লেব্যাকে পাওয়া যায় না। এর কারণ কী?

কারণ কিছুই না। এখন যারা সিনেমায় কাজ করছেন তারা সবাই ভালো করছেন। হয়তো আমার গান তাদের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাছাড়া আমিও হয়তো যোগাযোগের ধারাবাহিকতাটা রক্ষা করতে পারি না। এ কারণেই হয়তো হচ্ছে না।

মেধার চেয়ে যোগাযোগের গুরুত্ব কী বেশি?

বিষয়টি তা নয়। আসলে সবার তো সবার সম্পর্কে জানা সম্ভব নয়। যারা সিনেমা বানান সংগীতাঙ্গনের সবার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রাখা সম্ভব না। দেখা যাচ্ছে যারা তাদের সঙ্গে কাজ করছেন তাদের সঙ্গেই কাজগুলো হচ্ছে। হয়তো আমি চোখে পড়িনি তাদের। এমনটা হতে পারে।

শোনা যায় গানের বাজার ভালো না। আপনার কি মনে হয়?

যারা বলছেন গানের বাজার ভালো না এটি হয়তো তাদের ব্যক্তিগত অভিমত। সব প্রযোজকই যে একই কথা বলছেন তা কিন্তু নয়। আমি মনে করি গানের বাজারে আগের চেয়ে প্রতিযোগিতা বেড়েছে। পাশাপাশি আগে সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না। এখন সেখানেও প্রতিযোগিতা হচ্ছে। এছাড়া নেগেটিভ কন্টেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের টিকে থাকতে হচ্ছে। যারা বলছেন তারা হয়তো এখানে ভালো দিকটা দেখতে পাননি। তবে আমার কাছে ভালোই লাগে। ভালোর সাথে খারাপের প্রতিযোগিতা আগেও ছিল, এখনও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে। নেতিবাচক কন্টেন্টের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে আমাদের টিকে থাকতে হবে।

অরুচিকর গান শ্রোতাদের কাছে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাচ্ছে…

পৌঁছে যাওয়া আর টিকে থাকা কিন্তু এক না। দেখা যাচ্ছে যত দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে তত দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে। নেগেটিভ কনটেন্ট হয়তো ভালো লাগছে কিন্তু আরেকটি নেগেটিভ কন্টেন্ট এসে সেটা ভুলিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু যেটা ভালো কাজ সেটা টিকে থাকছে।

স্পটিফাইয়ের প্রসার কিভাবে দেখছেন?

স্পটিফাইকে আমি ইতিবাচকভাবে দেখছি। একজন সংগীতশিল্পী হিসেবে বলবো দিনশেষে গান আসলে শোনার বিষয়। তাছাড়া যাদের দেখতে ইচ্ছে করবে তারা ইউটিউব থেকে দেখে নিতে পারবেন। গান আসলে শোনার বিষয়। ওই জায়গা থেকে স্পটিফাই খুবই পজেটিভ এবং সহায়ক।

প্রত্যেক শিল্পীরই স্বপ্ন প্লেব্যাক করা। আপনার ক্ষেত্রেও কি তাই?

প্লেব্যাকের স্বপ্ন আমিও দেখি। এটি ভীষণ চ্যালেঞ্জিং সেইসঙ্গে প্রাপ্তির। প্লেব্যাক করার ক্ষেত্রে কণ্ঠশিল্পীকে অভিনয় জানতে হয়। কেননা সিনেমার ক্ষেত্রে একটি গান একটি গল্প। শিল্পী যদি তার গায়কী দিয়ে সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারেন তাহলে তো সেটি মূল্যহীন। সিনেমায় গান যেহেতু অভিনয় শিল্পীর ঠোঁটে যায় সেহেতু একজন শিল্পীকে গায়কীর মাধ্যমে তাদের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে হয়।

অডিও স্টেজ টিভি, কোন মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?

একটা সময় পর্যন্ত আমার প্রিয় মাধ্যম ছিল রেডিও। এখন অবশ্য রেডিও দেখা যায়। প্রত্যেকটি রেডিওরই ফেসবুক পেজ আছে। যখন দেখা যেত না তখন আমার ভীষণ পছন্দের ছিল। বাবাকেও প্রথম রেডিওতে শুনি। আমি নিজেও ২০১৫ সাল থেকে বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী। রেডিওর একটা ব্যাপার আমার খুব ভালো লাগত, সেটি হচ্ছে চোখে দেখছে না কিন্তু মানুষ শুনছে। আরও একটি ভালো লাগার মাধ্যম হচ্ছে স্টেজ। কেননা এখানে আমি দর্শকের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই।

আপনি বেশ ফ্যাশন সচেতন। মডেলিংয়ে আগ্রহ আছে?

মডেলিংয়ে আগ্রহ একেবারে যে নেই তা না। কিন্তু আমার ফ্যাশন সচেতনতার কারণও কিন্তু গান। আগেই বলেছি একজন গায়ক-গায়িকাকে অভিনয় জানতে হয়। যখন যে ধরনের গান গাই চেষ্টা করি নিজেকে সেভাবে উপস্থাপন করতে।  পাশাপাশি আমি দুটি ঘরানার গান করি। একটি হচ্ছে ক্লাসিক্যাল অন্যটি হচ্ছে জ্যাজ। আলাদা এই দুই ঘরানায় দুটি আলাদা ক্যারেক্টার খুঁজে পাই। ক্যারেক্টার দুটি প্লে করতেও ভালো লাগে এবং সেটি ফ্যাশনের মাধ্যমেও তুলে ধরতে ভালো লাগে। আবহ অনুযায়ী পোশাক পরলে আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত গানের মধ্যে আপনার পছন্দ কোনটি?

একটু পেছনে যেতে হবে। রোজার ঈদে মুক্তিপ্রাপ্ত প্রহেলিকা ছবির ‘হৃদয় দিয়ে গানটি’ আমার খুব পছন্দের। এতোটাই ভালো লেগেছে যে বলার মতো না। শ্রদ্ধেয় আসিফ ইকবালের লেখা। সুর ও সংগীত করেছেন কিশোর দাস। কথা ও সুর খুবই নাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। দৃশ্যায়নের সঙ্গে খুব মিলে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল যা দেখতে চাচ্ছি তাই পাচ্ছি। একটি গান তখনই টিকে যায় যখন কথা, সুর এবং দেখার মেলবন্ধন ঘটে। এই গানটিতে সেটা ছিল।

আগামী ১০ বছর পর নিজেকে কোথায় দেখতে চান?

এখন যাদের গান ভালো লাগছে তাদের গান আমি কিংবা অন্যরা গাইছেন। আমি চাই ১০ বছর পর একটি গান হলেও আমার থাকুক যেটি অন্যরা গাইবেন।

কার কণ্ঠ আপনাকে অনুপ্রেরণা যোগায়? 

শ্রদ্ধেয় শাহনাজ রহমতুল্লাহ ও সন্ধ্যা মুখার্জীর কণ্ঠ।

বর্তমান ব্যস্ততা নিয়ে কিছু বলুন…

এই মুহূর্তে আমার ব্যস্ততা স্টেজ প্রোগ্রাম এবং টেলিভিশন অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে। এছাড়া মৌলিক গানও করছি। সজীব দাসের সুরে শিগগিরই একটি মৌলিক গান আসছে আমার। আরও দুটি গানের কাজ চলছে। এরমধ্যে একটি শ্রদ্ধেয় গাজী মাজহারুল আনোয়ার স্যারের লেখা। সবচেয়ে বড় কথা গানটি উনি আমাকে সামনে বসিয়ে লিখেছিলেন। শিরোনাম ‘একটি ছেলে’। মৃত্যুর আগে যে কয়েকটি প্রজেক্ট করেছিলেন তারমধ্যে একটি। গানটির সুর করেছেন অপু আমান। অন্যটির কথা লিখেছেন আসিফ ইকবাল এবং সুর করেছেন কুমার বিশ্বজিৎ স্যার। এই গানের শিরোনাম ‘তুমি গেছো শুধু হারিয়ে’। দুটি গানেরই অডিওর কাজ শেষ হয়ে গেছে। ভিডিও সম্পন্ন হলে প্রকাশ করা হবে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে হবে ক্লিক করুন: আলাপচারিতা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − 9 =