নীল রঙ নিয়ে কিছু কথা

শিশির রহমান

পৃথিবীতে অসংখ্য রঙ রয়েছে কিন্তু সাধারণত মৌলিক রঙ তিনটি। লাল, সবুজ ও নীল। তবে এর মাঝেও কিছু পার্থক্য আছে। মৌলিক রঙের মধ্যে নীল রঙ একটি। তবে নীল রঙ নিয়ে অনেক বিষয় আছে যা এখনো আমাদের অজানা। এবারের জানা-অজানা তে নীল রঙ নিয়ে জানার চেষ্টা করবো।

নীল রঙের শহর

মরোক্কোর ‘নীল মুক্তা’ হিসেবে পরিচিত শেফচাউন শহরটি। ১৪৭১ সালে আবদুল-সালাম আল-আলামী এবং ইদ্রিস প্রথমের বংশধর মৌলে আলী আলী ইবনে রশীদ আল-আলামী এই শহরে একটি ছোট কাসবাহ (দুর্গ) প্রতিষ্ঠা করেন। আল-আলামি উত্তর মরক্কোর পর্তুগিজ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এই শহরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। বেশ কয়েকটি সিনেমার দৃশ্যে এই শহরটি হয়ত আপনি দেখেছেন! তবে তা সিনেমার সেট ভেবে অনেকেই ভুল করেছেন। বাস্তবেই এমন এক শহর আছে, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। মরোক্কোর উত্তর-পশ্চিমের একটি শহর হলো শেফচাউইন। মরোক্কোর টাঙ্গিয়ার এবং তাতোয়ান থেকেও ভেতরের দিকে শেফচাউইন অবস্থিত। এ শহরটির বিশেষত্ব হলো এর নীল রঙ। এ শহরটি একেবারেই রূপকথার রাজ্যের মতো। মনেই হবে না আপনি পৃথিবীর কোনো স্থান দেখছেন।

সত্যিই কল্পনার এক স্বর্গরাজ্য হলো শেফচাউইন। রূপকথার মতো মনে হলেও বাস্তবে এমন একটি শহর রয়েছে যার বাড়ি, ঘর, দরজা, জানালা, শহরের সবকিছুই নীল রঙে রাঙা। পুরো শহরের রাস্তা বাড়ি সকল কিছুই নীল রঙে আচ্ছাদিত। এ কারণে সারাবছর পর্যটকের আনাগোনা এখানে লেগেই থাকে। তবে গ্রীষ্মের সময় বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে শেফচাউইনে আসেন সবাই। এর মধ্যে এরচেয়ে বেশি থাকেন ইউরোপীয়রা। শেফচাউইন শহরটি নীল হওয়ার কারণ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব আছে। একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো নীল রঙ মশাকে দূরে রাখে। এ ছাড়াও বলা হয়, নীল আকাশ হলো স্বর্গের প্রতীক। নীল রঙ মনকে শান্ত করে এবং আধ্যাত্মিক জীবনের অনুস্মারক হিসেবে কাজ করে। তবে স্থানীয়দের মতে, ১৯৭০ সালে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতেই এ শহরের দেয়ালগুলোর রঙ নীল করা বাধ্যতামূলক হয়েছিল।

রহস্যময় নীলচে আলো

সমুদ্রের পাড়ে রহস্যময় নীলচে আলো জ্বলজ্বল করছে। এমন ভিডিও প্রায়শই আমরা দেখতে পাই। তবে এই দৃশ্যকে কাল্পনিক ভেবে ভুল করবেন না। বাস্তবেও চাইলে এই সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। তবে তার জন্য যেতে হবে মালদ্বীপের গ্লোয়িং বিচে। তবে প্রশ্ন আসতেই পারে এই নীল আলোর আলোর রহস্য কী? আসলে এই উজ্জ্বল নীল আলো এক ধরনের সামুদ্রিক ফাইটোপ্লাংকটনের। ফাইটোপ্লাংকটনের নাম ডিনোফ্লাজেলাটিস। এসব ফাইটোপ্লাংকটনে থাকে লুসিফেরাস নামক রাসায়নিক উপাদান, যা আলো সৃষ্টি করে। মূলত নিজেদের আত্মরক্ষা করার জন্যই এসব ফাইটোপ্লাঙ্কটন আলো বিচ্ছুরণ করে থাকে। জোনাকি, জেলিফিশের মতো অনেক জীব আছে যারা আলো তৈরির করার ক্ষমতা রাখে। জীবের আলো তৈরি করার এই ক্ষমতাকে বলে বায়োলুমিনেসেন্স।

রহস্যময় এক পরিবার, সবার শরীরই নীল

অবিশ্বাস হলেও সত্যি পৃথিবীতে এমন এক পরিবার আছে যাদের সবার শরীরই নীল। এরূপ বিচিত্র ঘটনা দেখা যায় লেক্সিংটনে। ১৯৭৫ সালে হাসপাতালে একদিন এক শিশুর জন্ম হয়। যা দেখে চিকিৎসকরাও অবাক হয়ে যান। কারণ শিশুটি দেখতে স্বাভাবিক হলেও তার শরীরের রঙ অবাক করে দেয় পুরো বিশ্বকে। শিশুটির পুরো শরীরই ছিল নীল রঙের। শিশুটির জন্মের পর চারদিকে আলোচনা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে চিকিৎসকগণ ভেবেছিলেন কোনো বিরল রোগের কারণে হয়তোবা শিশুটির শরীর নীল, তাই দ্রুত লেক্সিংটনে অপেক্ষাকৃত ভালো একটি হাসপাতালে শিশুটিকে  হস্তান্তর করা হয়। হাজারো মেডিকেল পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো পরেও কোনো ধরনের শারীরিক সমস্যা খুঁজে পাওয়া যায়নি। অবশেষে শিশুটির বাবা জানান, তার দাদির শরীরের রঙও ঠিক এমনই নীল ছিল। তিনি মৃত্যু অবধি অন্য সব মানুষের মতোই সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবেই বেঁচে ছিলেন। অবশেষে জানা যায়, বিরল জিনের প্রভাবেই শিশুটির শরীর এমন নীল হয়।

আকাশের রঙ নীল কেন

নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে সবারই খুব ভালো লাগে। খোলা আকাশটা কেমন করে যেন মন ভালো করে দেয়। আচ্ছা, এই যে আমরা নীল আকাশ দেখি, নীল আকাশের কথা বলি; কখনো কী ভেবে দেখেছে, আকাশটা কেন নীল রঙের হলো? কেন অন্য কোনো রঙের হয় না? আকাশ আসলে আমাদের বায়ুমণ্ডল। বিভিন্ন ধরনের গ্যাস ও জলীয় বাষ্প দিয়ে তৈরি এটি। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কারণে এটা চারপাশ থেকে পৃথিবীকে ঘিরে আছে। পৃথিবী ছেড়ে যত উপরে যাবে, বায়ুমণ্ডল ততই হালকা হতে থাকবে এবং আস্তে আস্তে এটা আর থাকবে না। এজন্য মহাশূন্যে কোনো বায়ুমণ্ডল নেই। এবার জানতে হবে সূর্যের আলোর কথা। আমরা সূর্যের আলোকে সোনালি রঙের দেখি, কিন্তু এটা আসলে রঙধনুর সাতটা রঙের মিশ্রণ। সূর্যের আলোয় রঙধনুর সাতটা রঙই আছে। আমরা আকাশের যে নীল রঙটা দেখি এটা মূলত সূর্যের আলোর নীল রঙ। অন্যান্য রঙের তুলনায় নীল রঙটা ক্ষুদ্রতর তরঙ্গের মাধ্যমে ছড়াতে পারে, সেজন্য এই রঙটা বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে বেশি ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু বায়ুমণ্ডলটাই আকাশ, তাই সেখানে যেই রঙ ছড়াবে, আকাশের রঙ সেটাই হবে। তাই সূর্যের নীল রঙটা বায়ুমণ্ডলে পড়ার কারণে বায়ুমণ্ডলটা নীল হয় এবং আকাশটাও নীল হয়।

জ্যোতিষশাস্ত্রে নীল রঙ

নীল রঙ তো আমরা সকলে দেখেছি, তবে আমরা কী জানি নীল রঙের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির চরিত্র সম্পর্কেও জানা যায়? জ্যোতিষশাস্ত্রে নীল রঙ-কে প্রাথমিক রঙ হিসেবে ধরা হয়। নীল রঙ-এর পোশাক পরলে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। শুধু তাই নয়, অন্য সব রঙের মধ্যে লাল রঙের পর নীল রঙই সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী হিসেবে ধরা হয়। অন্য রঙকে দমন করে রাখার ক্ষমতা থাকে নীল রঙের মধ্যে। যেখানে নীল রঙ থাকে, সেখান লালের পর নীল রঙই সবচেয়ে বেশি নজরে পড়ে। নীল রঙ শান্তি, ধর্মীয় পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত।

নীল মসজিদ

বিশ্বের প্রাচীন নগরীগুলোর মধ্যে তুরস্কের ইস্তাম্বুল শহর একটি। সেখানকার অসংখ্য স্থাপনার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ ব্লু মস্ক বা নীল মসজিদ। বিস্ময়কর এই মসজিদের স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী দেখে বিশ্ববাসী অবাক হয়ে যান। এ কারণে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের পর্যটকই ইস্তাম্বুলের নীল মসজিদ দেখতে ভিড় করেন। অটোমান ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ইস্তাম্বুলের এই মসজিদের প্রকৃত নাম সুলতান আহমেদ মসজিদ। নীল মসজিদের ৬টি মিনার, এর অভ্যন্তরীণ সজ্জা ও আলোকসজ্জা সবার নজর কাড়ে। মসজিদের অভ্যন্তরে নীল রঙের প্রাধান্য থাকায় এটি নীল মসজিদ নামেই বেশি পরিচিত।

সমুদ্রের পানি নীল

কেন সমুদ্রের পানি নীল হয় এবং নদীর বা পুকুরের পানি নীল হয় না? আসলে পানির রঙ পরিষ্কার, স্বচ্ছ, সাদা। কিন্তু সূর্যের আলোর বড় তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে লাল, কমলা, সবুজ প্রভৃতি রশ্মি সমুদ্রের পানিতে বেশি শোষিত হয় আর কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যরে নীল রশ্মি সবচেয়ে কম শোষিত হয়ে বেশ কিছুটা নীল রঙ ফেরত আসে। সমুদ্রের পানিতে প্রতিফলিত ও বিচ্ছুরিত হয়ে আমাদের চোখে নীল রঙটি পৌঁছায় বলে সমুদ্রের পানি নীল দেখায়। আকাশও নীল দেখায় ঠিক একই কারণে। এখন প্রশ্ন ওঠে, তাহলে নদীর পানি কেন নীল দেখায় না, বরং অনেকটা সাদা বা একটু ছাইরঙা? এর কারণ হলো সমুদ্রের তুলনায় নদীর পানি অনেক কম। এত কম যে পর্যাপ্ত পরিমাণ নীল রঙের বিচ্ছুরণ ঘটে না।

নীল রঙের চোখ

চোখ নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক গান তবে, সেসব গানে প্রাধান্য পেয়েছে কালো চোখ। তবে পৃথিবীতে কালো চোখ যাদের আছে বিভিন্ন ধরনের চোখ, তার মাঝে একটি নীল রঙের চোখ। নীল চোখের মানুষদেরকে সচরাচর চোখে না পড়লেও তাদের দেখা পাওয়া কিন্তু একেবারেই অসম্ভব নয়। নীল চোখের সাথে ককেশীয় বংশগোত্রের একটি অদ্ভুত মেলবন্ধন রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের চোখের রঙের ভিত্তিতে পরিচালিত এক জরিপ থেকে পাওয়া তথ্যমতে দুই ধরনের মানুষের চোখের রঙ নীল হতে পারে। সুদূর অতীত কোনো পূর্বপুরুষ থেকে জেনেটিক পরিবর্তনের ফল হিসেবে। অথবা দৃষ্টিজনিত কোনো চোখের রোগের ফলে পিগমেন্ট পরিবর্তনের কারণে।

নীল রঙ পছন্দ করা মানুষ আবেগপ্রবণ

কালার সাইকোলজির মতে, নীল রঙ পছন্দ করা মানুষ সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে থাকে। ভালোবাসার এক অবিচ্ছেদ অংশ জুড়ে এই আবেগের স্থান। ভালোবাসায় আবেগ থাকা জরুরি হলেও তবে বেশি আবেগ থাকাটা অনেক সময় মানুষকে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে সাহায্য করে। অতিরিক্ত আবেগ অনেকটা সাইলেন্ট কিলারের মতো। আপনার মনে হবে একটুই তো আবেগ দেখাচ্ছি। কিন্তু অতি আবেগী মানুষ জনকে সবাই খুব সহজে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: জানা অজানা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

9 − one =