নাঈম-শাবনাজের রঙিন অক্টোবর

মাধবী লতা

দেশীয় চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয় জুটি শাবনাজ-নাঈমের কথা মনে আছে? ১৯৯১ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘চাঁদনী’  সিনেমায় অভিনয় করেই রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন তারা। এরপর জুটি হয়ে অনেক সিনেমা উপহার দিয়েছেন। পর্দার জনপ্রিয় এই জুটি বাস্তবেও জুটি হয়ে যান। বিয়ে করে সংসারী হন তারা। রূপকথার মতো তাদের জীবনের গল্প। রাজা-রানীর রাজ্য আলোকিত করেছে দুই কন্যা। বর্তমান সময়টা তাদেরকে ঘিরেই রঙিন, ঝলমলে, সুন্দর। দীর্ঘ সময় ধরে অভিনয় থেকে দূরে আছেন শাবনাজ-নাঈম। ঢাকার উত্তরায় তাদের বসবাস। তবে চলচ্চিত্র পরিবারের মানুষদের সঙ্গে এখনো নিবিড় সম্পর্ক রেখেছেন তারা। এই তারকা দম্পতির জীবনে অক্টোবর মাসটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। তাদের জীবনের বড় বড় দুইটি ঘটনা ঘটেছে এই মাসেই। বছর ঘুরে ঘুরে আসে অক্টোবর মাস। স্মৃতিকাতর হন তারা। নাঈম-শাবনাজের জন্য বড়ই মধুর ও রঙিন এই অক্টোবর মাস।

তেত্রিশ বছর কেটে গেল

দেখতে দেখেতে তেত্রিশ বছর কেটে গেল। বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামুর রহমান পরিচালিত ‘চাঁদনী’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯১ সালের ২ অক্টোবর। এই দিনটিকে ভুলে যান না তারা। বেশ জমকালো আয়োজনে এই সিনেমার ২৫ বছর পূর্তির আয়োজন করেছিন তারা। এবারের অক্টোবরের ২ তারিখ ‘চাঁদনী’ সিনেমা মুক্তির ৩৩ বছর পূর্ণ করলো। সিনেমাটি মুক্তির ৩৩ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো লাখো ভক্তদের মনে ‘চাঁদনী’ রয়ে গেছে। এই সিনেমার পর ‘চোখে চোখে’,  ‘লাভ’, ‘অনুতপ্ত’, ‘জিদ’ প্রভৃতি সিনেমায় দেখা যায় নাইম-শাবনাজকে। পরের চলচ্চিত্রগুলোও পছন্দ করেন দর্শক।

‘চাঁদনী’ সিনেমা নিয়ে…

নাঈম বলেন, ‘চাঁদনী’র নির্মাতা আমাদের গুরু এহতেশাম সাহেব আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু আমরা দু’জনই তাকে প্রতিনিয়ত অনুভব করি। সত্যি বলতে কী বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তার যে অবদান তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। শাবনাজ বলেন, ‘আমরা দু’জনই এখন কাজ না করলেও চলচ্চিত্রকে আমরা আমাদের পরিবারের মতোই মনে করি। এখানে একজনের সাফল্যে যেমন আনন্দিত হই, অনুরূপভাবে এখানে কারো কষ্ট দেখলে নিজের ভেতরও কষ্ট অনুভব করি। আমি এবং নাঈম দু’জনই এখানে এসে একে অপরের সান্নিধ্যে এসেছি। সর্বোপরি মহান আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।’

নাঈম-শাবনাজ জুটি

নাঈম এবং শাবনাজের অভিষেকের মধ্যদিয়ে চলচ্চিত্রে জুটি প্রথার নতুন এক ধারা শুরু হয়। ঢাকাই চলচ্চিত্রে এই জুটির অভিষেকের মধ্যদিয়ে আরেক রোমান্টিক জুটির সফল যাত্রা শুরু হয়। এরপর একে একে এই জুটি দর্শককে উপহার দেন ‘দিল’, ‘সোনিয়া’, ‘চোখে চোখে’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘অনুতপ্ত’, ‘টাকার অহঙ্কার’, ‘সাক্ষাৎ’, ‘জিদ’সহ আরো বেশকিছু চলচ্চিত্র। সর্বশেষ তারা দু’জন ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ চলচ্চিত্রে জুটি হয়ে অভিনয় করেছিলেন।

চাঁদনীর পেছনের গল্প

গুণী নির্মাতা এহতেশামের হাত ধরেই ‘চাঁদনী’র মাধ্যমে রুপালি জগতে পা রাখেন নাঈম-শাবনাজ। পরে বাস্তব জীবনেও জুটি বেঁধেছেন তারা। মাঝে মধ্যেই ফেসবুক পেইজে ‘চাঁদনী’ সিনেমার স্মৃতিচারণ করেন তারা। জানা গেছে, ‘চাঁদনী’ সিনেমায় যারা অভিনয় করেছেন তখন প্রায় সবাই নতুন ছিলেন দুই একজন ছাড়া। ১৯৯০ সালে যারা এই সিনেমায় অভিনয় করেন। তাদেরকে নিয়ে একটি শিল্পী ও কলাকুশলী পরিচিতি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এই সিনেমাটি বাস্তবেও তাদের এক করে দিয়েছিল। এবার জানা যাক সেই গল্পটি।

বিয়ের ৩১ বছর

নব্বই দশকের দর্শকনন্দিত জুটি নাঈম-শাবনাজকে বাংলা সিনেমার অন্যতম আদর্শ তারকা দম্পতি বলা হয়। যাদেরকে এখনো সিনেমার পর্দায় দেখার জন্য  দর্শক আগ্রহ প্রকাশ করেন।  কিন্তু নাঈম-শাবনাজ আপাতত সিনেমায় ফিরতে চান না। সংসার নিয়ে ব্যস্ত তারা। তাদের দুই সন্তান নামিরা ও মাহাদিয়া। নাঈম-শাবনাজ বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন ৫ অক্টোবর। বিবাহিত জীবনের ৩০ বছর পেরিয়ে ৩১ বছরে পা দিলেন এ তারকা দম্পতি।

ভালোবাসার গল্প

শফিউল আলম পরিচালিত ‘বিষের বাঁশি’ সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়েই নাঈম ও শাবনাজের প্রেমের সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে। দাম্পত্য জীবন প্রসঙ্গে নাঈম বলেন, ‘আল্লাহর রহমতে আমরা বেশ ভালো আছি।’ শাবনাজ বলেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত নাঈমের মতো পরিপূর্ণ একজন মানুষকে আমি জীবন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছি। আমরা সুন্দর একটি জীবন গড়েছি, সুখী একটি পরিবার গড়েছি। বাকি জীবনও যাতে এভাবেই কাটাতে পারি – এটিই চাওয়া।’ এক গণমাধ্যমে শাবনাজ শুনিয়েছিলেন তাদের ভালোবাসার গল্প। তিনি জানান, ‘বিষের বাঁশি’ সিনেমার শুটিং করতে গিয়ে দুজনের প্রেমের শুরু। আর ‘লাভ’ সিনেমার শুটিংয়ে ভালোবাসা বাড়তে থাকে। তবে শুরুতে কেউ কাউকে নিজেদের ভালো লাগার বিষয়টি বুঝতে দেননি। শাবনাজ বলেন, ‘নাঈমের জন্য মেয়েরা তো অনেক পাগল ছিল। আমি বুঝতে পারতাম। তবে আমার যে ওকে ভালো লাগত, তা বুঝতে দিতাম না। দেখতে তো আমিও কম সুন্দরী ছিলাম না (হাসি)। আমিও ভাব নিয়ে থাকতাম। সে কথা না বললে আমিও বলব না, এমনটাই ছিল হাবভাব।’

অবশেষে বিয়ে

চাঁদনী সিনেমায় অভিনয়ের তিন বছরের মাথায় শাবনাজ ও নাঈম দুজনে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর বিয়ে হয় তাদের। বিয়ের পর দুই বছর ছবিতে অভিনয় করেন শাবনাজ। তারপর ধীরে ধীরে অভিনয় থেকে দূরে সরে আসেন।

নাঈমের বাবার মৃত্যু

১৯৯৪ সালের ৩০ জানুয়ারি নাঈমের বাবা খাজা মুরাদ ইন্তেকাল করায় মানসিকভাবে ভীষণ ভেঙে পড়েন এই নায়ক। এতে ভীষণ ভেঙে পড়েন নাঈম। সময়টায় শাবনাজকে স্বামীর পাশে থাকতে হতো সবচেয়ে বেশি। শাবনাজ বললেন, ‘সকালে ঘুম থেকে উঠেই ডাকাডাকি করে অস্থির করে ফেলত নাঈম। আমাকে ওর সামনে বসে থাকতে হতো। আমার সঙ্গটা তখন ওর বেশি দরকারও ছিল। আমরা অনেক গল্প করতাম, আড্ডা দিতাম। নাঈম কাজও কমিয়ে দেয়। আমিও হাতে থাকা কিছু ছবির কাজ করে নিজেকে গুটিয়ে নিই।’

নাঈমের ময়না

অনেকেই জানেন এখনো শাবনাজকে ‘ময়না’ নামে ডাকেন নাঈম। জানা গেছে, ‘বিষের বাঁশি’ সিনেমায় শাবনাজের চরিত্রের নাম ছিল ময়না। আর এই সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে দুজনের প্রেমের শুরু, তাই শাবনাজকে এই নামেই ডাকা শুরু করেন নাঈম। শাবনাজ বলেন, ‘যেহেতু আমাদের প্রেমের শুরু এই সিনেমায়, তাই নাঈম আমাকে ওই নামে ডাকে। এখনো ওই নামেই সে আমাকে ডাকে।’

সুখী সংসারের রহস্য

আর দশটা পরিবারের মতো তারাও মান অভিমান করেন। খুনসুটি কিংবা টুকটাক ঝগড়াও তাদের পিছু ছাড়ে না। কিন্তু ভালোবাসার কাছে এসব নেহায়েত তুচ্ছ ঘটনা। শাবনাজ-নাঈমের সুখী সংসারের রহস্য কী? শাবনাজ বললেন, ‘একটি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য সবার আগে দরকার কম্প্রোমাইজ করতে শেখা। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-সম্মানটাও জরুরি। সব সময় সবকিছু নিয়ে সুখী হওয়া কঠিন। সবকিছু চাই, এটা লাগবে, সেটা লাগবে, এমন মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কী কী বাদ দিলেও জীবন চলতে পারে, সেটা দুজনকেই শিখতে হবে। নারীরা স্বামীকে সম্মান দিতে জানেন। কিন্তু অনেক পুরুষই সেটা হয়তো সেভাবে জানেন না। নাঈমকে সব সময় দেখেছি, স্ত্রী হিসেবে আমাকে যথেষ্ট সম্মান করে।’ নাঈম যোগ করেন, ‘আনকন্ডিশনাল লাভ হতে হবে। যেখানে কোনো শর্ত থাকবে না, কোনো স্বার্থ থাকবে না। যাকে ভালোবাসি, তার ভুলকেও ভালোবাসতে হবে, ভালোকেও ভালোবাসতে হবে। কোনো দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মাপা যাবে না, কে বেশি ত্যাগ স্বীকার করছে। তবে একতরফা একজনই সব সময় ত্যাগ করবে, সেটাও হবে না। এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করলেই ভালোবাসা টিকে থাকবে, সংসারজীবন সুন্দর হবে। সম্পর্কে গিভ অ্যান্ড টেক থাকলে তাকে ভালোবাসা বলা যায় না। এটা কেন করেছ, ওখানে কেন গেলে, এমন প্রশ্ন সম্পর্কে নষ্ট করে।’

সংগীতপ্রেমী দুই কন্যা

নাঈম-শাবনাজের দুই মেয়ে অভিনয়ে যুক্ত হননি, গানের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছেন। এরই মধ্যে ছোট মেয়ে মাহাদিয়া নাইম দেশ-বিদেশের জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের একাধিক গান কাভার করেছেন।  মাহাদিয়া গেয়েছেন মৌলিক গানও। ‘দিন গুনে’ শিরোনামের এই গানের  ভিডিও চিত্র বানিয়েছেন মাহদিয়ার বড় বোন নামিরা নাইম। অভি মঈনুদ্দীনের কথা ও সুরে এই গানের সংগীত পরিচালনা করেছেন ইউসুফ আহমেদ খান। মাহাদিয়ার গাওয়া ‘দিন গুনে’ গানটি নিজের ইউটিউবের পাশাপাশি স্ফটিফাই, অ্যাপল মিউজিক ও অ্যামাজান মিউজিক প্ল্যাটফর্মে শোনা যাচ্ছে। মাহাদিয়ার গানের প্রতি অনুরাগী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বড় বোন নামিরা নাইম। মাহাদিয়াকে ছোটবেলা থেকে  গানের তালিম নিয়েছেন। শাস্ত্রীয় সংগীত ও গজলের তালিম নিয়েছেন সালাউদ্দিন শান্তনুর কাছে। নজরুলসংগীতের ওপরও তালিম নিয়েছেন মাহাদিয়া। ইংরেজি গানগুলো শুনে শুনে নিজেই শিখেছেন বলে জানান মাহাদিয়া। তবে গানের প্রতি অনুরাগী হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বড় বোন নামিরা নাইম।

শেষ কথা

একটানা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শাবনাজ। ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ ছিল সেই সময়কার সর্বশেষ সিনেমা। এরপর সংসারেই মনোযোগী ছিলেন। ১৯৯৯ সালে এসে প্রথম  টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেন। নাটকটির নাম ‘আকাশ কুসুম’। এরপর আরও কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে দীর্ঘ বিরতির পর বরেণ্য অভিনয়শিল্পী এ টি এম শামসুজ্জামানের অনুরোধে আজিজুর রহমানের ‘ডাক্তার বাড়ি’ সিনেমায় অভিনয় করেন। এরপর ছোট পর্দা-বড় পর্দা কোথাও দেখা যায়নি। তবে আগের কাজের জন্য এখনও দর্শকের ভালোবাসা পান নাঈম-শাবনাজ। আনন্দেই কাটুক তাদের প্রতিটা দিন।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

16 − five =