বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ও ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’

মাসুম আওয়াল

টানা নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশ। তরুণ প্রজন্ম সেই যুদ্ধ দেখেনি, এই কাহিনি জেনেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ে, মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে নির্মিত হয়েছে অনেক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা। তেমনই একটি চলচ্চিত্রের নাম ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’। রঙবেরঙ এর নিয়মিত আয়োজনের এবার আমার তুলে ধরতে চাই সেই চলচ্চিত্রের গল্প।

মুক্তির আলোয়

‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল ২০০৭ সালের ২৬ মার্চ। ১২০ মিনিট স্থিতিকালের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন খিজির হায়াত খান ও মিলি রহমান। বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের জীবনী ও আত্মত্যাগের কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করা হয়। এটি খিজির হায়াত খানের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র।

যাদের অভিনয়ে প্রাণবন্ত

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের জীবনী নিয়ে ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ নির্মাণ করেন পরিচালক খিজির হায়াত খান। সিনেমাটির কাহিনি লিখেছেন মিলি রহমান ও খিজির হায়াত খান। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের চরিত্রে নিজেই অভিনয় করেন পরিচালক। আর মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলির চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনেত্রী শশী। মাহিন মতিউরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মুসকান হোসেন রান্তা, তুহিন মতিউরের চরিত্রে অভিনয় করেছেন মায়াবী। সিনেমাটি খুব বেশি আলোচিত না হলেও বোদ্ধা মহলের প্রশংসা কুড়িয়েছে ও ইতিহাসের দলিল হয়ে আছে।

সিনেমার আড়ালের মানুষেরা

ডিজিটাল ফরমেটের এই সিনেমাটির প্রযোজক ছিলেন মিলি রহমান ও খিজির হায়াত খান। মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদদের উৎসর্গ করা হয় সিনেমাটি। এটির নিবেদক বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ফাউন্ডেশন ও সুফিয়া পিকচার্স। সিনেমাটি স্পন্সর করেছিলেন প্রাইম ব্যাংক লিমিট, ইকুইটি পার্টনারস লিমিটেড, রোজি কুদ্দুস, জাকিয়া সুলতানা, ক্যাপ্টেন মুক্তি। পরিচালক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রীর কাছে। বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী (যশোর মতিউর ঘাটি)  রায়পুরাবাসীর প্রতি। তৎকালিন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ এর কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সিনেমাটির চিত্রগ্রাহক ছিলেন সাইফুল ইসলাম শাহীন। স্থিরচিত্রে ছিলেন রফিকুল ইসলাম রনি। শব্দ সংযোজক ছিলেন অমিত মল্লিক। সংগীত পরিচালনা করেন অনুপ বড়ুয়া। পোশাক নির্দেশনায় ছিলেন মনসুরা রাহমাতুল্লাহ ও হেদায়েতুল্লাহ খান। টাইটেল এনিমেশন করেন খান নাসির উদ্দিন রিফায়েত। প্রধান সহকারী পরিচালক ও সম্পাদনায় ছিলেন মো. সালাউদ্দিন আহমেদ বাবু। সার্বিক ব্যবস্থাপনায় ছিলেন সরকার মোহাম্মদ খায়রুল আলম খাইর।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বলছি

সিনেমার শুরুতেই কিছু কথা ভেসে আসে। যে কথাগুলো নাড়া দেয় দর্শকের হৃদয়ে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর যেন নিজেই হাজির হয়েছেন এখানে। কথাগুলো এমন, ‘আমি মতিউর রহমান বলছি। আজ শুধু আমি মতিউর হিসেবে বলতে চাই। আমি বলতে চাই, ৭১ এ আমরা যারা এদেশের জন্য আত্মত্যাগ করেছিলাম তাদের সবার পক্ষ থেকে। আমরা সবাই চেয়েছিলাম একটা স্বাধীন দেশ হোক। মুক্ত আকাশের নিচে আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকি। এই স্বপ্নগুলোর জন্যই কিন্তু আমরা সব কিছু পেছনে ফেলে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। আমি নীলিমা ইব্রাহিমকে সেদিন অচেনা  এক ভবিষ্যতের দিকে ফেলে চলে গিয়েছি। নীলিমা আমায় তুমি ক্ষমা কর। আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আমার মতো অনেকেই সেদিন নীলিমার মতো মানুষকে বাসায় রেখে যুদ্ধে গিয়েছি। আমরা এত ত্যাগ করেছিলাম কারণ আমরা সুন্দর একটি দেশ চেয়েছিলাম। আমরা চেয়েছিলাম আমাদের কথা জাতি মনে রাখুক। ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানুক। অনেক কষ্ট হয় যখন আমরা দেখি এই দেশটার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম, সে দেশটার জন্য আমরা প্রাণ দিলাম সে দেশটার নানা ভাবে দ্বিধা বিভক্ত। ইতিহাসকে সঠিকভাবে এখানে পরিচর্যা করা হয়নি। এগুলো দেখে অনেক কষ্ট হয়। আবার আমরা আশার আলো দেখি, একটা নতুন প্রজন্ম এই সকল বাধাকে পিছনে ঠেলে সত্যের অনুসন্ধান করে। ইতিহাসকে সঠিকভাবে জানতে চাই। আমরা তাদের মাঝেই আমাদের নিজেদেরকে খুঁজে পাই। তারা এভাবে আলোর দিকে এগিয়ে যাবে। এটাই আমরা চেয়েছিলাম। নতুনদেরকে বাধা দিও না। আমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছিলাম তারা দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তোমাদের সাথে রইল আমাদের রেখে যাওয়া চেতনা। আবার কথা হবে।’

কি আছে এই সিনেমায়?

সিনেমাটির দৃশ্যায়নের শুরুতেই দেখা যায় একটা এরোপ্লেন ল্যান্ড করছে বিমানবন্দরে। দেখা যায়, প্রবাস থেকে দেশে ফিরেছেন এক মুক্তিযোদ্ধার সন্তান স্বাধীন আহমেদ। স্বাধীনের বাবা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আহত হন এবং আহত অবস্থাতে দীর্ঘদিন লড়াই করে এক সময় মারা যান। এরপর মাকে ঘিরেই স্বাধীনের জীবন চলতে থাকে। এরপর তার মা-ও মারা যান। তারপর সে দেশে ফিরে আসে তার মায়ের অনুরোধে। স্বাধীন বলে, ‘আমি দেশে ফিরে আসি মায়ের অনুরোধে। যে দেশের জন্য আমি হারিয়েছি আমার বাবাকে আর আমার মা হারিয়েছে তার সব থেকে প্রিয় ভালোবাসার মানুষটিকে। মা চেয়েছিলেন আমি যেন সেই দেশটিকে একবার দেখার ও জানার চেষ্টা করি। মায়ের শেষ ইচ্ছে পূরণ করতে আজ এত বছর পর আমি দেশে এসেছি।’

দেখা যায়, রফিক মামা তার একমাত্র মেয়েকে নিয়ে এয়ারপোর্টে এসেছেন স্বাধীনকে রিসিভ করতে। স্বাধীনের মায়ের সহপাঠী ছিলেন রফিক। ওরা বাসায় ফিরে আসে স্বাধীনকে নিয়ে। বাসার ডাইনিং টেবিলে রফিক মামার সঙ্গে স্বাধীনের গল্প জমে ওঠে। রফিক মামা জানতে চান স্বাধীনের ব্যস্ততা কী নিয়ে? স্বাধীন জানায়, আমেরিকায় ফ্রিল্যান্সিং ফটোগ্রাফি কাজ করে সে। মৌমিতার সম্পর্কেও বলেন রফিক মামা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজমের ছাত্রী মৌমিতা। সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্রী সে। কথার ফাঁকে স্বাধীন বলে, সে তার বাবার কবর জিয়ারত করতে চায়। কবর স্থানে যায় ওরা। বাবার কবর জিয়ারত করতে গিয়ে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে পায় স্বাধীন। সিনেমার আসল গল্প শুরু এখান থেকেই। পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের মৃতদেহ করাচির মাসরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণির কবরস্থানে সমাহিত করে রেখেছিল। পরবর্তীতে ২০০৬ সালের ২৪ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫ জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়। মতিউর রহমানকে নিয়ে জানতে আগ্রহী হয় স্বাধীন। মৌমিতা মতিউর রহমানের ওপর লেখা একটা বই দিতে চায় তাকে।

এরপর দেশ ঘুরে বেড়াতে শুরু করে স্বাধীন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যায় সে নদী-সবুজ তার মন কেড়ে নেয়। ফটোগ্রাফিও চলতে থাকে। সরষে ক্ষেত সূর্যোদয় সূর্যাস্ত এসব টানে। তাকে মৌমিতার দেওয়া এই বইটি পড়েই এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে যায় স্বাধীন। বইটি পড়া শেষ করে সেই বইয়ের লেখকের বাড়িতে হাজির হয় সে। সেই লেখক আর কেউ নন স্বয়ং বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী নীলিমা ইব্রাহিম। বাড়িটা যেন এক জীবন্ত জাদুঘর। অনেক স্মৃতিচিহ্ন লেগে আছে দেয়ালে দেয়ালে। নীলিমা ঘুরে ঘুরে স্বাধীনকে তার বাড়ি দেখান। অনেক ছবি দেখান। সেসব ছবির গল্প শোনান। একটা লাল শাড়ির গল্প শোনান। তার দেখানো প্রতিটা ছবির পেছনে আছে ইতিহাস ও নানা গল্প। সেসব গল্প শোনাতে শোনাতে ফ্ল্যাশব্যাকে শুরু হয় মতিউর রহমানের জীবন কাহিনি। প্রায় পুরো সিনেমাটির গল্পেই দেখানো হয় ফ্ল্যাশব্যাকে। এখনো যারা দেখেননি তারা সিনেমাটি ইউটিউব থেকেই দেখে নিতে পারবেন।

সিনেমার গান

গল্পের পাশাপাশি গানও একটি সিনেমার প্রাণ। বেশ কিছু মৌলিক দেশের গান ব্যবহার করা হয়েছে এই চলচ্চিত্রে। প্রবাস ফেরত এক যুবক দেশে ফিরে বের হয়েছে দেশকে দেখতে। গ্রাম দেখতে দেখতে নিজের অস্তিত্ব টের পায় সে। নাড়ির টান অনুভব করে দেশের সঙ্গে। সিনেমার টাইটেল গানটিতে দারুণ ভাবে ফুটে উঠেছে সেসব। গানের কথাগুলো এমন, এসেছে ফিরে আজ অনেক দূরে/ নিজেরই ভুলে যাওয়া আঙিনা/ শুনেছি বহু গান অচিন সুরে/ পেয়েছি কত গ্রাম অজানা/ হৃদয়ে বেজে যায় একটি গান/ রয়েছে প্রতীক্ষায় আমার প্রাণ/ এ প্রথম জেনেছি/ আমি শুনেছি হৃদয়ের প্রতিধ্বনি/অস্তিত্ব আমার দেশ। একদম চলচ্চিত্রের শুরুতেই শোনা যায় একটি গান। এই গানটিও বেশ সুমধুর। এই গানের সুরে সুরেই সিনেমাটির নামলিপি দেখে ফেলে দর্শক। গানের কথাগুলো এমন, আমার প্রথম দেখা নয়/ এ তো নয় প্রথম পরিচয়/ এ শোভা দেখেছি স্বয়নে স্বপনে/ এ মায়া চেয়েছি আগুনো নয়নে/ রাতের আড়ালে রাতের রাগিনি/ পুব আকাশ ছাওয়া ঘুমানো রজনী/ কুয়াশা ছড়িয়ে আঁধারে আঁধার/ ভোরের এই আলোটা ফুটবে জানি/ তারই আশায় কেটেছে প্রহর/ তারই ছায়ায় জেগেছে শহর। সবমিলিয়ে সিনেমাটির প্রতিটি গানই বেশ শ্রুতিমধুর ছিল।

এক নজরে খিজির হায়াত খান

পরিচালক খিজির হায়াত খানের অধিকাংশ চলচ্চিত্রেই দেশেপ্রেমের চলচ্চিত্র। ১৯৭৯ সালের ১২ জানুয়ারি কুমিল্লার কাপ্তান বাজারে খিজির হায়াত খানের জন্ম। তার পিতা সালামত আলী খান বাচ্চু কুমিল্লার বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক ও কলেজ শেষ করেন খিজির। উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে মিনেসোটা হ্যামলাইন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘অস্তিত্বে আমার দেশ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চলচ্চিত্র পরিচালনায় তার অভিষেক হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের সাত বীরশ্রেষ্ঠের অন্যতম বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানকে নিয়ে নির্মিত এটিই একমাত্র চলচ্চিত্র। পরবর্তীতে ২০১০ সালে খিজির হায়াত খান নির্মান করেন বাংলাদেশের প্রথম স্পোর্টস-ফিল্ম ‘জাগো’। ‘জাগো’ মুক্তির পর খিজির হায়াত খান দেশ ছেড়ে কানাডা চলে যান। সেখানে তিনি ভ্যাঙ্কুভারে মাস্টার্স ইন ডিজিটাল মিডিয়া অ্যান্ড কনসেনট্রেশন ইন ফিল্ম মেকিং কোর্সে ভর্তি হন। এ সময় তিনি ‘আই ফর অ্যান আই’ শিরোনামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন যা ২০১৫ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। পরে ‘ওরা সাত জন’, ‘মিস্টার বাংলাদেশ’ ও ‘প্রতিরুদ্ধ’ সিনেমাগুলো নির্মাণ করেন খিজির।

শেষ কথা

সবশেষে একটা তথ্য জানিয়ে রাখি, খিজির হায়াত খান সিনেমার জন্য অনেক ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়েও গেছেন। ২০২৩ সালে খিজির হায়াত খানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের অভিযোগে দুই চরমপন্থীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল। জানা যায়, ‘মিস্টার বাংলাদেশ’-এর চিত্রনাট্য লেখার কারণে চরমপন্থীরা খিজির হায়াত খানকে টার্গেট করেছিল। খিজির হায়াত খানের হাত ধরে আরও অনেক দেশপ্রেমের চলচ্চিত্র নির্মিত হোক। জয় হোক বাংলা সিনেমার।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

4 + 13 =