গোলাম মোর্শেদ সীমান্ত
পৃথিবীতে যত আবিস্কার হয়েছে তার অধিকাংশই করা হয়েছে মানুষের জীবন সহজ ও উন্নত করার জন্য। তেমনি এক আবিষ্কার হলো বালিশ। রাতে ঘুমানোর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বালিশ। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে আরামদায়ক বালিশ আমাদের সকলেরই চাওয়া। এক্ষেত্রে একেকজনের একেক বালিশ পছন্দ। কেউ পছন্দ করে শিমুল তুলার বালিশ, কেউ বা ফোমের। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসটির ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতজনই জানি। চলুন জেনে আসা যাক বালিশের আদ্যোপান্ত।
বালিশ শব্দটি ফার্সি ‘ব’লেশ’ থেকে এসেছে। ৭০০০ অব্দে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় বসবাসকারী লোকেরা প্রথম বালিশ ব্যবহার শুরু করে। তবে এই বালিশ তখনকার সময়ে কেবল ধনীরাই ব্যবহার করতো। যার কারণে তখন বালিশকে মর্যাদার প্রতীক হিসেবে ধরা হতো। একজনের যত বেশি বালিশ থাকতো তাকে সবচেয়ে সমৃদ্ধ হিসেবে গণ্য করা হতো। প্রাচীন মিশরেও বালিশ ব্যবহার করা হতো। তৎকালীন সময়ে মিশরীয়রা মৃত মানুষদের মমি করতো এবং মাথাকে জীবনের মূল ও পবিত্র মনে করতো, তাই তারা মৃতের মাথার নিচে কাঠ এবং পাথর দিয়ে তৈরি বালিশ রাখতো। তারা মনে করতো, মাথার নিচে বালিশ রাখা হলে রক্ত সঞ্চালন চালু থাকে এবং অশুভ শক্তি থেকে মৃতদেহ দূরে থাকে। সেসব বালিশের আকার ছিল অর্ধেক চাঁদের মতো।
মেসোপোটেমিয়া ও মিশরের পর প্রাচীন ইউরোপের মানুষ নরম বালিশ তৈরির কৌশল আয়ত্ত করেছিল। তারা বালিশ নরম ও আরামদায়ক করার জন্য খাগড়া, পালক, খড় ব্যবহার করতো। তবে এসব বালিশ শুধু উচ্চ শ্রেণির মানুষ ব্যবহার করতো। এছাড়াও প্রাচীন ইউরোপের মানুষ গির্জায় হাঁটু মুড়ে বসে প্রার্থনার জন্য ও পবিত্র বই রাখার জন্য বালিশ ব্যবহার করতো, যা এখনো চলমান। মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের পর বালিশ আসে এশিয়ায়। এশিয়া মহাদেশে সর্বপ্রথম বালিশ ব্যবহার হয় চীনে। তখন বালিশ তৈরি করা হতো কাঠ দিয়ে, কেননা চীনারা শক্ত বালিশ খুবই পছন্দ করতো। চীনারা বিশ্বাস করতো শক্ত বালিশ তাদের শরীরে শক্তি সঞ্চার করে। তবে এসব বালিশ তখন দুষ্প্রাপ্য এবং ব্যয়বহুল ছিল। তখনকার সময় অধিকাংশ পরিবার এসব বালিশ দেখে তাদের সন্তানদের বিয়ে দিতো। যার ফলে চীনামাটি, বাঁশ, ব্রোঞ্জ ও জেডের মতো মূল্যবান উপকরণ দিয়ে তৈরি করা শক্ত বালিশ তখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়। বর্তমানেও চীনে গ্রীষ্মে পাথরের বালিশ ব্যবহার করা হয়।
বাণিজ্যিকভাবে জনসাধারণের জন্য বালিশ তৈরি শুরু হয় ৬০-এর দশকে। বালিশের ভেতরে দেওয়া হয় ফোম, তুলা, স্টাইরোফোম পেলেট এবং কুলিং জেল। বালিশ প্রথম দিকে খড় দিয়ে তৈরি হলেও সেগুলো আরামদায়ক না হওয়ার ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা হারায়। এর পরিবর্তে বালিশ তৈরির জন্য পালক বা নরম বস্তু ব্যবহার করা হতো। যা আরামদায়ক এবং ফোম বা তন্তু বালিশের চেয়ে ব্যবহারকারীদের সুবিধা মতো আকৃতি পরিবর্তন করা সহজ। তবে অত্যধিক ব্যয়বহুল এবং এলার্জিক প্রতিক্রিয়ার জন্য তা বন্ধ করা হয়। এরপর ব্যাপক চাহিদার কথা মাথায় রেখে তুলার বালিশ তৈরি করা হয়। তুলা বেশ আরামদায়ক, এলার্জি মুক্ত এবং কম ব্যয়বহুল। সাধারণত শরীর ও মাথার সাপোর্ট এবং আরামের জন্য বালিশ ব্যবহার হয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন ধরনের বালিশ রয়েছে। বিছানার বালিশের সঙ্গে আমরা সকলেই পরিচিত। সাধারণত ঘুমানোর জন্য এই বালিশ ব্যবহার করা হয়, যা বেশআরামদায়ক হয়। তুলা দিয়ে এসব বালিশ তৈরি হয়।
এক ধরনের বালিশ রয়েছে যার নাম অর্থোপেডিক বালিশ, মূলত যাদের মেরুদণ্ড এবং গলায় সমস্যা থাকে তারা এই ধরনের বালিশ ব্যবহার করেন। এটি ‘সার্ভিকাল বালিশ’ হিসেবেও বেশ পরিচিত। অর্থোপেডিক, থেরাপেটিক এবং শল্য চিকিৎসা নেওয়া রোগীদের আরাম দিতে এ ধরনের বালিশ ব্যবহার করা হয়। আবার ‘ভ্রমণ বালিশ’ বাতাস ভর্তি এক ধরনের বালিশ। ভ্রমণের জন্য তৈরি করার কারণে এসব বালিশে বাতাস ভর্তি ও বের করা যায়, যার ফলে সহজে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়া যায়। ‘রিডিং পিলো’ নামে এক ধরনের বালিশ রয়েছে, যারা দীর্ঘসময় কাজ করেন তাদের জন্য। বালিশটি সাধারণ চেয়ারের মতো দেখতে। মেরুদণ্ডের ব্যাথা থেকে মুক্ত থাকার জন্য এ বালিশ ব্যবহার করা হয়। সাজানোর জন্য যেসব বালিশ ব্যবহার করা হয় সেসবকে শোভাবর্ধক বালিশ বলা হয়। সোফা, চেয়ার সাজানোর জন্য এসব বালিশ ব্যবহার হয়।
বালিশ নিয়ে মজার তথ্য
* ‘পিলো টক’ নামে ১৯৫৯ সালে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পায় এবং তা রীতিমতো সাড়া ফেলে দেয় চলচ্চিত্র জগতে। এছাড়াও ২০১৬ সালে পিলো টক শিরোনামের একটি গান প্রকাশিত হয়, গানটি গেয়েছিলেন জাইন মালিক। যা তখন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। শুধু সিনেমা বা গানেই নয়। বালিশ স্থান করে নিয়েছে সাহিত্যেও। পিলো বুক নামে মধ্যযুগের এক ক্লাসিক জাপানি বই আছে যা সেসময়ের প্রাসাদ রাজনীতির এক প্রামাণ্য দলিল।
* মিষ্টি কী কখনো বালিশের মতো হতে পারে। অবাক লাগছে! এমন এক মিষ্টি আছে যার নাম ‘বালিশ মিষ্টি’। নেত্রকোনায় পাওয়া যায় এই মিষ্টি। প্রায়ত গয়ানাথ ঘোষ এই মিষ্টি উদ্ভাবন করেন। কোলবালিশের মতো দেখতে হয় বলে তিনি এর নাম দেন বালিশ মিষ্টি।
* বালিশ ঘুমানো কিংবা ঘর সাজানোর জন্য দেখেছি। তবে এমন এক ধরনের বালিশ আছে যা আগুন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। আমেরিকান থ্রিমএম কোম্পানি এই ব্যাগ তৈরি করে। যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ফায়ারস্টপ পিলো’।
* যদি এমন একটি বালিশ থাকতো যে আপনাকে মোবাইল ফোনের মতো সকল তথ্য দেবে। কী স্বপ্ন মনে হচ্ছে! আসলে স্বপ্ন না। এমন একটি বালিশ রয়েছে, যার নাম ‘রোবটিক পিলো’। শ্বাস প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ধরনের বালিশ তৈরি করা হয়েছে। যাদের শ্বাসকষ্ট রয়েছে তাদের জন্য এই বালিশটি কাজ করে। বালিশটির নাম হলো ‘ব্রিদিং পিলো’।
* একটি বালিশের দাম ৬৭ লক্ষ টাকা। কী বিশ্বাস হচ্ছে না! বাস্তবে এমন একটি বালিশ তৈরি করেন ভ্যান ডের হিলস্ট। নেদারল্যান্ডের এই ফিজিওথেরাপিস্ট বালিশটির ডিজাইন করেন যার দাম ৫৬ হাজার ৯৯৫ ডলার বা প্রায় ৬৭ লক্ষ টাকা। বালিশটি তৈরি করতে ভ্যান ডের হিলস্টের প্রায় ১৫ বছর সময় লাগে। বালিশটির এতো দাম হওয়ার কারণ এতে ব্যবহার করা হয় মিসরীয় তুলা ও তুঁত সিল্ক। এছাড়া এতে যুক্ত করা হয় অ-বিষাক্ত ডাচ মেমরি ফোম। বালিশটি এতো দামি হওয়ার কারণ এতে ২৪ ক্যারেট সোনা, হীরা এবং নীলকান্তমণি দেওয়া হয়।
* বালিশ লড়াই খেলাটির সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। এই খেলাটি মজার ছলেই খেলা হয়। যেহেতু বালিশ নরম থাকে তাই আঘাত করার পরও প্রতিপক্ষের কোনো ক্ষতি হয় না। খেলাটি বেশ জনপ্রিয়। অনেক চলচ্চিত্রে বালিশ লড়াই দেখানো হয়েছে। প্রতিবছর ৬ এপ্রিল বিশ্ব পিলো ফাইট ডে বা ‘বিশ্ব বালিশ যুদ্ধ’ দিবস পালন করা হয়।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: আবিষ্কার