মৌ সন্ধ্যা
আমাদের একজন মোনালিসা আছেন। যিনি মিষ্টি হাসি দিয়েই মন জয় করে আছেন লাখো দর্শকের। তিনি আমাদের দেশের নন্দিত অভিনেত্রী মোজেজা আশরাফ মোনালিসা। দীর্ঘ সময় ধরে প্রবাসে জীবনযাপন করলেও তাকে ভুলে যায়নি মানুষ। তিনিও ভুলে যাননি তার ভক্তদের। ৫ অক্টোবর তার জন্মদিন। রঙবেরঙের পক্ষ থেকে তার প্রতি রইলো জন্মদিনের শুভেচ্ছা। জেনে নেওয়া যাক মোনালিসার কথা।
ঢাকার মেয়ে
মোনালিসার জন্ম ১৯৮৪ সালের ৫ অক্টোবর ঢাকায়। তার পিতা আশরাফ হোসেন এবং মাতা মমতাজ বেগম। ১৯৯৯ সালে তার পিতা মারা যান। তিন বোনের মধ্যে মোনালিসা সবার ছোট। তার বড় দুই বোন মুনিরা ও মারিয়া। মোনালিসার সংস্কৃতি অঙ্গনে পদচারণা শুরু হয় ১০ বছর বয়সে নাচ ও মডেলিং দিয়ে। নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি ছোটবেলাতেই রাষ্ট্রীয় সফরে তুরস্ক যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।
নাটকের সুপার হিট অভিনেত্রী
কে জানতো ছোট্ট নৃত্যশিল্পী মোনালিসা একদিন হয়ে যাবেন দেশের সুপার মডেল ও নন্দিত অভিনেত্রী। মোনালিসার বয়স যখন ২১ বছর তখন তিনি ‘কাগজের ফুল’ নাটকে অভিনয় করেন। পরে হুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত ‘তৃষ্ণা’ নাটকে অভিনয় করেন। ২০১১ সালে তিনি একপর্বের নাটক ‘বাজি’, ‘একটু ভালোবাসা’, ‘বান্দুলুম’ ও ‘রোমিওরা’ এবং ধারাবাহিক নাটক ‘অল রাউন্ডার’ ও ‘ভালো থেকো ফুল মিষ্টি বকুল’ এ অভিনয় করেন। ২০১২ সালে ঈদের বিশেষ নাটক ‘চম্পাকলি’ এবং মিনি ধারাবাহিক ‘সিকান্দার বক্স এখন বিরাট মডেল’ এ মোশাররফ করিমের বিপরীতে অভিনয় করেন। এরপর প্রবাসে পাড়ি দেন। অভিনয় ক্যারিয়ারে ছেদ পড়ে। দীর্ঘ বিরতির পর আবারও তিনি ৮টি ঈদের বিশেষ নাটকে অভিনয় করেন। তিনি মোশাররফ করিমের বিপরীতে ‘অ্যাভারেজ আসলাম’ ও ‘কিড সোলায়মান’, ইরফান সাজ্জাদের বিপরীতে ‘চিরকুট’ নাটকে অভিনয় করেন। এছাড়া ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’, ‘আন্তর্জাতিক মামা’ এবং সজল নূরের বিপরীতে ‘রোমান্টিক ফিনিক্স ফ্লাই’ নাটকে তন্বী চরিত্রে এবং ‘আমি তুমি ও সে’ নাটকে অভিনয় করেন।
বিজ্ঞাপনেও সেরা
বিজ্ঞাপন জগতের এক অনন্য নাম মোনালিসা। ‘ফেয়ার অ্যান্ড লাভলি’র বিজ্ঞাপন দিয়ে তিনি প্রথম সকলের নজর কাড়েন। এছাড়া মাহফুজ আহমেদের সঙ্গে ‘ফিজ-আপ’ এর বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। ২০১৩ সালে বিদেশে পাড়ি জমান মোনালিসা। তিন বছর পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং আবার মডেলিং ও অভিনয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এসময় তিনি যমুনা গ্রুপের ফ্যান ও ফ্রিজের বিজ্ঞাপনে কাজ করেন। এরপর লিলি কসমেটিকস আর বাংলালিংকের বিজ্ঞাপনে কাজ করে দর্শক হৃদয়ে স্থায়ীভাবে রাজত্ব করতে শুরু করেন মিষ্টি হাসির মোনালিসা।
ব্যক্তিগত জীবন
বিয়ের পর ২০১৩ সালে মোনালিসা স্বামীর সাথে নিউ ইয়র্ক চলে যান। এর তিন বছর পর আবারও দেশে ফিরে কাজে মনযোগী হয়েছিলেন। এরপর ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আবারও বসবাস শুরু করেন। আমেরিকাতে দায়িত্ব পালন করেছেন যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক বাংলা চ্যানেল টাইম টিভির প্রোগ্রাম প্রধান হিসেবে। কর্মরত ছিলেন কিকো মিলান নামের একটি কোম্পানির অ্যাসিসটেন্ট ম্যানেজার হিসেবে। মাঝে মাঝে মাতৃভূমিতে অল্প কিছুদিনের জন্য সময় কাটাতে আসেন মোনালিসা। কাজ করেন ঈদের বিশেষ নাটক কিংবা কোনো নতুন বিজ্ঞাপনে। তবে আগের মতো আর এ সেলিব্রেটিকে নিয়মিত শোবিজ অঙ্গনে দেখতে পান না দর্শক।
দেশেই মন পড়ে থাকে
এক সময়ের জনপ্রিয় মডেল, অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মোজেজা আশরাফ মোনালিসা দীর্ঘদিন মার্কিন মুলুকে বসবাস করলেও দেশেই তার মন পড়ে থাকে। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে মোনালিসা বলেন, ‘রাস্তার ধারে চটপটি, ফুচকা, আচার এগুলো, যা যা আমার ছোটবেলার স্মৃতি, যেগুলো আমি মিস করি। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি মিস করি। ভাবছি এখানে ছয় মাস থাকব, ওখানে ছয় মাস। আমি যদিও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছি। কিন্তু মনটা দেশেই পড়ে থাকে। আমি জানি এখানে আমার একটা বড় ভক্ত শ্রেণি রয়েছে। তারা আমার অনুপস্থিতিকে খেয়াল করে। আমিও তাদের মিস করি।’
দর্শকের উদ্দেশ্যে
যেখানেই থাকেন না কেনো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তদের খুব কাছাকাছি থাকেন মোনালিসা। প্রতিনিয়ত নিজের অফিসিয়াল ফেসবুকস পেইজে আবেগ উচ্ছ্বাস ও নানা বাণী শেয়ার করেন এই অভিনেত্রী। চলতি বছরের ৩ সেপ্টেম্বর একটি রিলস এর ক্যাপশনে তিনি লিখেন, ‘নম্র হও এবং নিজেকে অন্য কারো চেয়ে ভালো মনে করো না, আমরা সবাই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই কিছু না নিয়ে।’ ১৭ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে ছবি শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘কথার মূল্য তখন হারিয়ে যায় যখন তোমার কথা ও কাজের মিল নেই।’ ১২ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে ছবি শেয়ার করে ক্যাপশনে লিখেন, ‘আমি কখনো মানুষ চিনতে পারিনি, তবে মানুষের রূপ পরিবর্তন দেখেছি।’
আগস্টের বন্যায় মানুষের পাশে
২০২৪ সালের আগস্টে ভয়াবহ বন্যার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ। এই বন্যাতেও আমেরিকা থেকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন মোনালিসা। ২৪ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে বন্যা কবলিত এলাকার একটি ছবি শেয়ার করে তিনি লিখেছিলেন, ‘আমি আমার সামর্থ্য অনুযায়ী অংশ নিয়েছি, আপনিও এগিয়ে আসুন। ২২ আগস্ট এক ফেসবুক পোস্টে তিনি লিখেছিলেন, ‘অবিরাম বৃষ্টির শব্দ এখন দুঃস্বপ্ন মনে হচ্ছে, আল্লাহ বাংলাদেশের সকল বন্যাকবলিত মানুষকে হেফাজত করুন।’
ছাত্র আন্দোলনে
ছাত্র আন্দোলনের সময়ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ সরব ছিলেন মোনালিসা। প্রতিনিয়ত নানা বিষয় নিয়ে পোস্ট দিতেন তিনি। জানাতেন নিজের মতামত। গত ৪ আগস্ট পর পর বেশ কিছু লেখা ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেন তিনি। তিনি লিখেন ‘আমি রাজনীতি বুঝি না, আমি বুঝি আমার দেশের সম্মান, আর শান্তি। আমি বুঝি সাধারণ মানুষের রুজি রোজগার আর বেঁচে থাকা। আমার দেশ আজকে অনেক বেশি অস্থির, মারামারি, রক্ত, হানাহানি। মায়েরা সন্তান হারা। সবসময় উৎকণ্ঠা, ভয়। এবারে ২০২৪ এ এসে আমরা নিজেরা নিজেদের সঙ্গে লড়ছি। এটা সবচেয়ে উদ্বেগের। আমি কোনো মৃত্যুর পক্ষে নই। আমি কোনো রক্তের পক্ষে নই। আমি কোনো মা সন্তানহারা হোক, সে পক্ষে নই। আমি শান্তি চাই। আমার দেশটার শান্তি চাই। নিরাপদে থাকবেন। শান্তি ফিরে আসুক আমার দেশে। আমার বাংলাদেশ আমি তোমায় ভালোবাসি।’ ৬ আগস্ট মোনালিসা লিখেন, ‘এটা নতুন বাংলাদেশ ২.০, চলো উদযাপন করি।’ আরেকটি পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘বাকস্বাধীনতা চর্চা করুন এবং এই চর্চা আর থামাবেন না। কেউ যেন মুখের ভাষা দমন করে, ভয় দেখিয়ে কেড়ে নিতে না পারে। দেয়ালের কানের ভয়ে আর কখনো চুপ করে থাকবেন না। দেয়ালের কান কেটে দেওয়া হয়েছে। আপনি যদি এখন থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ থামিয়ে দিন দেয়ালের আবার কান গজাবে।’
মত প্রকাশের স্বাধীনতা
মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে নন্দিত অভিনেত্রী বিস্তারিত বলেন আরও একটি পোস্টে। কয়েকটি গণমাধ্যমে সেটা নিয়ে সংবাদও করে। ১০ আগস্ট মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে এক ফেসবুকে পোস্টে মোনালিসা লিখেন, ‘সারাদিন যে বিষয়টা মাথায় ঘুরছে। মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে বলে বাকস্বাধীনতা। আর সেটা সবারই থাকতে হবে। অন্যের মতামতের উপর সম্মান দিয়ে নিজ মতামত প্রদান করার অধিকার একটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার যেটা খর্ব হলে স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। আপনি যেভাবে চিন্তা করছেন একটি শিল্পী, লেখক বা অন্য কেউ ঠিক সেভাবেই ভাবতে নাও পারে। কিন্তু তারও তার মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশের অধিকার আছে। কিন্তু সেটার জন্য আপনি তাকে কটূ কথা, গালিগালাজ, বদদোয়া ইত্যাদি নানাবিধ উপায়ে হেনস্তা করতে পারেন না। এটা কোনোভাবে সুশিক্ষা ও সভ্যতার পরিচয় নয়। আমি অনেক ভালো কিন্তু দুর্বল না আমারে দুর্বল ভাবলে তার মতো মুর্খ দুনিয়াতে আর নাই! আপনার সঙ্গে আমার মতের অমিল হতেই পারে তাই বলে অন্যকে আঘাত করা অপমান করা, কটূ কথা বলার শিক্ষা কারো অধিকার নাই। আমি টক্সিক সবকিছু থেকে সবসময় দূরে থাকি হোক সেটা কোনো টক্সিক পরিবেশ কিংবা মানুষ নিজের প্রিয় মানুষ ছেড়ে আমি নির্দ্বিধায় চলে আসতে পারি যদি সম্পর্কটা বিষিয়ে যায়, আর সেখানে বাইরের মানুষ তো কোন ছাই! তুমি আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবা, আমি তোমাকে এর ১০ গুণ ভালো চেষ্টা উপহার দিবো তুমি আমার কাজের, সময়ের, সততার এবং চেষ্টার মূল্য দিবা না, অপমানজনক কথা বলবা, উদ্ধত ব্যবহার করবা, তুমি আমার জীবনের কোথাও থাকবা না সহজ এবং সোজাসাপ্টা কথা! বেয়াদব, উদ্ধত, অকৃতজ্ঞ, অবিনীত, অশালীন, অভদ্র মানুষজন আমার অপছন্দ এরা আমার জীবনের ধারেকাছেও সিম্পলি থাকার যোগ্যতা রাখে না! অপমান করা খুব সহজ যে কেউ চাইলেই করতে পারে, এর জন্যে যোগ্যতা লাগে না। কিন্তু সম্মান করতে শিক্ষার প্রয়োজন হয়। আদব, কায়দা শিখতে হয়, সম্মান দেখানো সহজ কাজ না! সব ক্ষেত্রে, শিল্পীদের, অযথা হয়রানি করবেন না। তারা দেশের সম্পদ, আপনার মতের বিরুদ্ধে গেলেই তাদের জীবন বিষিয়ে তুলবেন না। সবার জীবনে স্থিতিশীলতা আসুক। জীবনটাকে সহজ করে দেখার মানসিকতা সৃষ্টি হোক। আমাদের জীবনধারা আমাদেরকে সংজ্ঞায়িত করে আমাদের কাজে, আমাদের কথায়, মানসিকতায়, মানবিকতায় সবখানে।’
শেষ কথা
নিজের রূপ ও দক্ষ অভিনয় দিয়েই সবার মন জয় করে আছেন মোনালিসা। এখনো তিনি আছেন সেই আগের মতই। গত মে মাসে বাংলাদেশে এসেছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন তার রূপের রহস্য। অভিনেত্রী। বলেন, ‘রূপ এবং তারুণ্যের রহস্য হচ্ছে দর্শকদের ভালোবাসা। কারণ, দর্শকেরা চান না আমার বয়স হয়ে যাক, বুড়ো হয়ে যাই। তারা এত ভালোবাসেন আমাকে, মনে হয় এ কারণেই আমার বয়স বাড়ছে না।’ এভাবেই চির সবুজ থাকুক সবার প্রিয় মোনালিসা। তার প্রতিটি দিন কাটুক সানন্দে।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা