২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

মুশফিকুর রহমান

অনেক আশাবাদ নিয়ে আজারবাইজানের রাজধানী বাকু নগরীতে ১১ নভেম্বর ২০২৪ শুরু হলেও ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন ২৩ নভেম্বর ২০২৪ শেষ হয়েছে ‘আশাভঙ্গে’র হতাশা নিয়ে। অবশ্য জাতিসংঘের বাৎসরিক জলবায়ু সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিগণের সকলেই ‘আশাভঙ্গে’র বোধ নিয়ে সম্মেলনকেন্দ্র থেকে বিদায় নিয়েছেন ভাবা অনুচিত হবে। উন্নয়নগামী দেশ, বিশ্ব জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে বিপন্ন এবং বিপর্যস্ত দুর্বল অর্থনীতির যে সকল দেশ ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বড় ধরনের ‘আর্থিক’ ও কারিগরি সহায়তার প্রত্যাশা করেছিলেন, তারা নিজেদের ‘প্রতারিত’ ভেবেছেন; হতাশাও প্রকাশ করেছেন। ২৯তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বড়-সড় ‘বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল’ গঠনের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যাবে বলে সম্মেলন শুরুর আগে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যে  প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল তা সামান্যই পূরণ হয়েছে। পৃথিবীর আবহাওয়ামণ্ডলীতে শিল্প বিপ্লবের পূর্বের সূচকের তুলনায় বর্তমানে যে দ্রুততায় ‘গ্রিন হাউস গ্যাস’ সঞ্চিত হচ্ছে। ইতিমধ্যে, আবহাওয়ামণ্ডলীতে প্রায় ৪২১ পিপিএম পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড সঞ্চিত হয়েছে। অন্যান্য প্রধান গ্রিন হাউস গ্যাসের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড যোগ করলে আবহাওয়ামণ্ডলীতে মোট গ্রিন হাউস গ্যাসের উপস্থিতির পরিমাণ প্রায় ৪৭২ পিপিএম। ১৯৯০ সালের সঙ্গেও যদি তুলনা করা হয়, আবহাওয়ামণ্ডলীতে কার্বনডাই অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২০% এবং এ বৃদ্ধি প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। প্রকৃতিক উৎস ছাড়াও আবহাওয়ামণ্ডলীতে গ্রিন হাউস গ্যাসের দ্রুত বৃদ্ধি ঘটছে মানুষের কর্মকাণ্ড এবং দূষণ থেকে। আবহাওয়ার উষ্ণায়নে জলবায়ুর দ্রুত পরিবর্তন অবধারিত হচ্ছে। ফলে, পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে; মানুষের খাদ্য, পানীয় সঙ্কট, রোগ বালাইয়ের বৃদ্ধি, নিরাপদ বসবাসের জায়গা, জীবন-জীবিকা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করা, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং মানুষের খাদ্য ও নিরাপদ বসবাসের সুযোগ নিশ্চিত রাখার প্রয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমন ও ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজিত হবার জন্য আর্থিক বিনিযোগ ও পারস্পরিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

পূর্ববর্তী বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন সমূহে গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত ও প্রতিশ্রুতি থেকে বাকু’র বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের অংশগ্রহণকারীগণ সঙ্গত কারণে আশাবাদী হয়েছিলেন। জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও তার ব্যাপকতা বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ঐতিহাসিকভাবে ক্ষমতা ও ধনসম্পদে বলীয়ান দেশ সমূহের জলবায়ু সঙ্কট তীব্র করতে সিংহভাগ দায় রয়েছে। এ কারণে,  টেকসই উন্নয়নের প্রতি বিশ্বস্ত হতে অনুপ্রাণিত ও জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় অর্থ সহায়তা দিতে ধনী দেশগুলো উদ্যোগী হবে বলে আশা করা হয়ে আসছে।

২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ নিজেদের দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত প্রশমনের জন্য ‘এনডিসি’ বা জাতীয়ভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ ও তা প্রশমনের লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রস্তুত করা দলিল জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দিয়েছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে উক্ত ‘এনডিসি’ সমূহ বাস্তবায়নের জন্য অন্তত ৫.৮ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ সম্পদ প্রয়োজন হবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার জমা দেওয়া ‘এনডিসি’ ডকুমেন্টে যে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনার আবশ্যকতা তুলে ধরেছে, কেবল সেগুলো বাস্তবায়নেই বছরে অন্তত ১২.৫ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও তার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি ও ব্যবহার নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের প্রয়োজন প্রায় ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ বিনিয়োগ জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি, সবুজ উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়নে সহায়তা এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস করতে সহায়তা করবে।

অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বাংলাদেশ বছরে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার পরিমাণ সম্পদ জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবেলায় ব্যয় করছে। এটি নেহায়েৎ অপ্রতুল এবং সে কারণে, বৈশ্বিক সহায়তার দাবী নিয়ে বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে মারত্মকভাবে বিপর্যস্ত দেশগুলো বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে সমবেত হয়েছিল। বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিলে বছরে অন্তত এক ট্রিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পাবার প্রত্যাশায় বাকু সম্মেলনে প্রতিনিধিগণ সমবেত হলেও, বিত্তবান এবং জলবায়ু সঙ্কট তীব্র করতে ঐতিহাসিকভাবে দায়বদ্ধ দেশগুলো বছরে সাকুল্যে ৩০০ বিলিয়ন ডলার যোগান দেবার ঘোষণা দিয়েছে। এরমধ্যে দেশগুলোর সরকারি বাজেট সহায়তা ছাড়াও সরকারি, বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান (যেমন বিশ্ব ব্যাংক) সমূহের অংশগ্রহণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। জলবায়ু তহবিল গঠন ও তার পরিচালনার বিস্তারিত এবং গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন  হ্রাস করার ক্ষেত্রে বিশ্ব জলবায়ু তহবিল কিভাবে ব্যবহৃত হবে, কে কত পরিমাণ তহবিল সহায়তা পাবে, তহবিল সহায়তার কতটুকু  অনুদান, কি পরিমাণ ঋণ পাবে সে সম্পর্কিত প্রশ্নের বিস্তারিত এখনও চুড়ান্ত হয়নি। সে কারণে আগামী বছরে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য ৩০তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে প্রশ্নগুলো আলোচিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনে মারাত্মকভাবে বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্থ দেশ সমূহ বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল থেকে তাদের জন্য ঋণ সহায়তার চেয়ে অনুদান পেতে বেশি আগ্রহী। পক্ষান্তরে তহবিলে যোগানদাতাদের স্পষ্ট পক্ষপাতিত্ব জলবায়ু তহবিল সহায়তার সিংহভাগ ঋণ হিসেবে বরাদ্দ দিতে। অপর্যাপ্ত জলবায়ু তহবিলের জন্য অসন্তোষের পাশাপাশি এবং জলবায়ু সঙ্কট উত্তরণে জলবায়ু তহবিলের অর্থ পেতে  ঋণের জালে নিজেদের জড়াতে দরিদ্র দেশগুলো অনাগ্রহী।

জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলায় ধনী-গরিব সব দেশেরই বিনিয়োগ দরকার। কিন্তু, জলবায়ু সঙ্কটে ধনী ও গরিব দেশের  চ্যালেঞ্জের মধ্যে ব্যাপক ভিন্নতা রয়েছে। ধনী দেশের জন্য দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প কারখানা ও উন্নয়ন কৌশল থেকে দূরে সরে পরিবেশবান্ধব শিল্প ও অবকাঠামো গড়ে তোলা, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার প্রযুক্তি আহরণ ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হলো চ্যালেঞ্জ। পক্ষান্তরে, গরিব ও উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ জটিল এবং বহুমুখি। এর মধ্যে গরিব দেশের দারিদ্র্য দূরীকরণ, দুর্যোগ সহনীয় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি ও তার ব্যবস্থাপনা, দূষণমুক্ত এবং কার্যকর শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো  নির্মাণ এবং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রাধিকার। জলবায়ু পরিবর্তনের ধ্বংসাত্মক অভিঘাতে উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়ন আকাক্সক্ষা নিয়মিত হোঁচট খায়। কষ্টে গড়ে তোলা অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক ভিত্তিসমূহ হয় ভেঙে পড়ে অথবা পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। সে কারণে, উন্নয়নশীল দেশগুলো সহজ শর্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে জলবায়ু তহবিল সহায়তা পেতে উন্মুখ। পৃথিবীর সিংহভাগ গরিব ও উন্নয়নশীল দেশের পরিবেশসম্মত উন্নয়ন আকাক্সক্ষা পাশ কাটিয়ে ধনী দেশগুলো আরও বেশি সম্পদ কুক্ষিগত করার যে উন্নয়ন মডেল নিয়ে এগুতে চায় তা আবহাওয়ামণ্ডলীর গ্রিন হাউস গ্যাসের ক্রমস্ফীতি রোধ করতে কাউকে সহায়তা করবে না। পরিবেশের বৈশ্বিক বিপর্যয় ধনী-দরিদ্র সবার জন্যই চরম পরিণতি ডেকে আনবে।

কেবল বিমূর্ত আহ্বান নয়, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নয়ন এবং তার সহজলভ্যতা গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণে নতুন আশাবাদ তৈরি করছে। জীবাশ্ম জ্বালানির সঙ্কুচিত ব্যবহার এবং নবায়নযোগ্য শক্তির বহুমাত্রিক, কার্যকর ব্যবহারের নতুন নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে যৌক্তিক, ন্যায্য ও কার্যকর সহযোগিতায় আন্তরিক হলে, জলবায়ু সঙ্কট যেন বৈশ্বিক মহাবিপর্যয়ে পরিণত না হয় তার পথ নির্মাণে দিশারি হতে পারে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: পরিবেম

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

18 − seven =