শবনম শিউলী
প্রকৃতিবিদ-লেখক জন মুইর বলেছিলেন, দ্য মাউন্টেইন্স আর কলিং, ইউ মাস্ট গো। অর্থাৎ পাহাড় ডাকছে, আমায় যেতেই হবে। এভাবেই পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিতে বছরের পর বছর অনেকেই উঠেছেন পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু চূড়াটিতে। হারিয়েছেন প্রাণ, কেউ হারিয়েছেন হাত কিংবা পা। প্রকৃতির এই ডাকে সাড়া দেওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে বই কমছে না। জীবনের মহত্ব কিংবা সুখ খুঁজতে, নাম খ্যাতি যশ খুঁজতে কেউ এই বন্ধুর পথ পাড়ি দেন না। পাড়ি দেন পাহাড়ের ডাকে সাড়া দিতে। এটা একটা নেশার মতো, যে নেশা সহজে কাটে না। যে নেশা মানুষকে পেয়ে বসে, উদ্যোগী করে তোলে। মানুষ হয়ে ওঠে পর্বতারোহী, বেয়ে চলে পাহাড়, হেঁটে চলে মাইলের পর মাইল। এছাড়াও পর্বতের গুরুত্বও মানুষের জীবনে ও প্রকৃতিতে অপরিসীম। পৃথিবীর ভূ-পৃষ্ঠের প্রায় ২৭ শতাংশ জুড়ে আছে পর্বতগুলো। মানবজাতির আনুমানিক অর্ধেককে মিষ্টি জল সরবরাহ করে পর্বত।
আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস
২০০৩ সাল থেকে ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। পর্বত যে আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রাকৃতিক সম্পদ তাতে সন্দেহ নেই। এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য হলো, আমাদের জীবনে পর্বতের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি, পর্বতের উন্নয়নের সুযোগ ও সীমাবদ্ধতা তুলে ধরা এবং বিশ্বব্যাপী একটি সাধারণ জনমত তৈরি করা যা মানুষের মধ্যে পর্বতের পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ভূমিকা রাখবে। যতদূর জানা যায়, ১৮৩৮ সালে পর্বত দিবস প্রথম পালন করার আভাস পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের মাউন্ট হোলিওক কলেজের ছাত্ররা ওই অঞ্চলের পর্বতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য ক্লাস বর্জন করে হোলিওক পর্বতের দিকে যাত্রা শুরু করে। পরে ১৮৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্মিথ কলেজ পর্বত দিবস উদযাপন করে। জাতিসংঘের অফিশিয়াল ওয়েবসাইট অনুসারে, নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ ২০০১ সালের ১১ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক পর্বত বর্ষ ধারণাটির সূচনা করে। পরবর্তীতে, ২০০২ সালে টেকসই পর্বত উন্নয়ন বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সমস্যাগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক পর্বত বর্ষকে চিহ্নিত করা হয়। ২০০২ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ১১ ডিসেম্বর তারিখটিকে আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস হিসেবে চূড়ান্ত করে। এ সময় টেকসই পাহাড় উন্নয়ন নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। তারপর ২০০৩ সালের ১১ ডিসেম্বর প্রথম আন্তর্জাতিক পর্বত দিবস পালন করা হয়। প্রতি বছর, এই দিনটির জন্য একটি প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়। এগুলোতে মিষ্টি পানি, শান্তি, জীববৈচিত্র্য বা জলবায়ু পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপরে আলোকপাত করে। পর্বতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার কৌশল হিসেবে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ২০২৩ সালে এই দিবসটির থিম ছিল, পর্বত ইকোসিস্টেম পুনরুদ্ধার করা।
পর্বত কেন পাহাড় নয়
পাহাড় ও পর্বত দুইটি ভিন্ন জিনিস। পর্বত হলো পৃথিবীর ভূত্বকের একটি উঁচু অংশ, সাধারণত এর খাড়া দিকগুলো উন্মুক্ত নিরেট প্রস্তর দেখায়। একটি পর্বত একটি মালভূমি থেকে এদের চূড়ার উচ্চতার জন্য পার্থক্য করা যেতে পারে এবং সাধারণত একটি পাহাড়ের চেয়ে উঁচু হয়, সাধারণত আশেপাশের জমি থেকে কমপক্ষে ৩০০ মিটার (১,০০০ ফুট) উপরে উঠে। কয়েকটি পর্বত বিচ্ছিন্ন চূড়া, তবে বেশিরভাগ পর্বতশ্রেণিতে দেখা যায়। অন্যদিকে পাহাড়ের কোনো সর্বজনস্বীকৃত সংজ্ঞা নেই। উচ্চতা, আয়তন, ব্যবধান এবং ধারাবাহিকতা একটি পর্বতকে সংজ্ঞায়িত করার মানদণ্ড হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে একটি পর্বতকে ‘পৃথিবী পৃষ্ঠের একটি প্রাকৃতিক উচ্চতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যা আশেপাশের স্তর থেকে কমবেশি আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং একটি উচ্চতা অর্জন করে যা তুলনামূলকভাবে সন্নিহিত উচ্চতার চিত্তাকর্ষক বা উল্লেখযোগ্য।’ তিনটি প্রধান ধরনের পর্বত রয়েছে: আগ্নেয়গিরি, ভাঁজ এবং ব্লক। তিন প্রকারই প্লেট টেকটোনিক্স থেকে গঠিত হয়; যখন পৃথিবীর ভূত্বকের কিছু অংশ সরে যায়, চূর্ণবিচূর্ণ হয় এবং ডুবে যায়।
পর্বতারোহণ ও আরোহীরা
পর্বতারোহণের জন্য অভিজ্ঞতা, শারীরিক সক্ষমতা এবং কারিগরী এবং সতর্কতামূলক জ্ঞান প্রয়োজন। ইন্টারন্যশনাল মাউন্টেনারিং অ্যান্ড ক্লাইম্বিং ফেডারেশন পর্বতারোহণ বিষয়ক বিশ্ব তত্ত্বাবধায়ক সংস্থা। এই সংস্থা পর্বতারোহণ সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়, যেমন পর্বতারোহণ নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ, বরফাবৃত পাহাড়ে ওঠা ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি পালন করে থাকে। সারা পৃথিবীতে এমন অনেক ছোট বড় সংস্থা আছে যারা পর্বতারোহণকে উৎসাহিত ও সাহায্য করে। পর্বতারোহীরা অনেকেই অনেক সময় বিভিন্ন বার্তা নিয়ে আরোহণ করেন। কারণ যখন তারা সাফল্যের সঙ্গে আরোহণ শেষ করেন তখন তারা সেই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পান। এছাড়াও পর্বতারোহণ এক ধরনের খেলা, শখ বা পেশা। বিভিন্ন উঁচু পর্বতের শিখরে আরোহণের চেষ্টা থেকে পর্বতারোহণের সূচনা হয়েছিল। এটি ধীরে ধীরে একটি দুঃসাহসিক খেলা হিসেবে বিকাশ লাভ করে। তিন ধরনের পর্বতারোহণ রয়েছে: রক-ক্রাফট, স্নো ক্র্যাফট এবং স্কিয়িং। এগুলো নির্ভর করে পর্বতের পৃষ্ঠের উপর।
সামাজিক বার্তা নিয়ে পর্বতারোহণ
ওয়াসফিয়া নাজরীন প্রথম বাংলাদেশি যিনি ‘সেভেন সামিট’ অভিযানে নেমেছিলেন। তিনি তার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘আমি দুনিয়াকে দেখাতে চাই নারীরা বহুদূর যেতে পারে’। নারীর নিজস্ব সত্ত্বা ও শক্তির মাধ্যমে সারা দুনিয়ার সামনে ওয়াসফিয়া নিজেকে তুলে ধরেছেন। তার এই বার্তা সমাজকে নারীদের সক্ষমতা তুলে ধরতে সাহায্য করেছে। এমন নয় যে ওয়াসফিয়াই প্রথম নারী যিনি অভিযান করেছেন। তার বহু বছর আগেই জুনাকো তাবেই প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেছিলেন। তাদের এই জয়ের গল্পগুলো মানুষকে বাঁচতে শেখায়। নতুন করে ভাবতে শেখায়, সমাজকে চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসতে শেখায়। অরুণিমা সিনহা প্রথম নারী যিনি পা না থাকলেও মাউন্ট এভারেস্ট ও ভিনসন পর্বত জয় করেন। তারও আগে ১৯৯৮ সালে টম হুইটেকার নিজের প্রতিবন্ধী অবস্থা ছাপিয়ে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় নিজের দেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন। প্রতিবন্ধকতা কাউকে পর্বতের চূড়ায় যেতে থামাতে পারেনি।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: দিবস