শিক্ষার্থী নাফিজের ফুড কর্নার

নীলাঞ্জনা নীলা

ঢাকার মোহাম্মদপুর। রিং রোডের সঙ্গেই সূচনা কমিউনিটি সেন্টার। সবসময়ই আলোকসজ্জায় সজ্জিত থাকে। এই আলো ঝলমলে কমিউনিটি সেন্টারের পাশ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। সে পথে হাঁটতেই খানিক পর দেখা মেলে অনেক ফুডকর্নারের। রাস্তার একপাশে সারি বেঁধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেগুলো। চাকার উপর দাঁড়ানো ছোট ছোট সেসব ফুড কর্নারে রয়েছে নানান রকম খাবার। দোকান মালিকদের সবাই বিভিন্ন বয়সী। কেউ যুবক কেউ মধ্যবয়সী। এরইমধ্যে এক কিশোরকে দেখা যায় একটি দোকান তদারকি করতে।  এখনও দাড়ি গোফ ওঠেনি। দেখেই বোঝা যায় স্কুলের গণ্ডি পার হয়নি। মূলত তার খোঁজেই যাওয়া হয়েছিল সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের পাশের গলিতে। যার কথা বলছিলাম তার নাম নাফিজ আজাদ। নবম শ্রেণির ছাত্র।

ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ালেখা করে। বাবা ব্যবসায়ী, মা ব্যাংকার। তবে এসব পরিচয়ের ওপর ভর করে নাফিজের কাছে যাওয়া না। তার নিজেরও একটি পরিচয় আছে। সেটি হচ্ছে সে ওই ফুড কর্নারগুলোর একটির কর্ণধার। নিজের নামে করেছেন নামকরণ। নাফিজ ফুড কর্নার। এ কারণেই তাকে খুঁজে বেড়ানো। যে বয়সে পেট ব্যথার অজুহাত দিয়ে ছেলেরা স্কুল কামাই দেয়। কিংবা স্কুল শেষে বাসায় ফিরে বই খাতা ছুড়ে ফেলে খেলায় মন দেয়। হাত খরচের জন্য যা প্রয়োজন তার জন্য হাত পাতে বাবা-মায়ের কাছে। ঠিক সেই বয়সে নাফিজ নিজেই দাঁড় করিয়েছে ফুড কর্নার। এরইমধ্যে সে খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে। দেশের প্রথম সারির গণমাধ্যম থেকে ইউটিউব চ্যানেল সর্বত্রই তাকে নিয়ে বানানো হয়েছে কনটেন্ট। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে কৌতুহলবশত মানুষজন এসেছে নাফিজের ফুট কর্নার দেখতে। সবারই এক প্রশ্ন, এই খেলার বয়সে আয় রোজগার নেমেছে? শুনে অবাক হবেন আরও ছোট বয়সেই এরকম ইচ্ছা ছিল তার। যা বাস্তবায়ন করেছে সে কৈশোরে এসে।

নাহিদের এই উদ্যোগে সমর্থন ছিল বাবা-মায়ের। এমনকি টাকাও দিয়েছেন তারা। হাজার পঞ্চাশেক টাকা নিয়ে ব্যবসায় পথচলা শুরু নাফিজের। শুরুতে ভ্যানের উপর অল্প কিছু খাবার ও একটি চুলা নিয়ে বসেছিল নাফিজ। বেশ সাড়া পায় সে। এর কদিন পরই নেয় ফুড কর্নারটি। এক্ষেত্রে শ্রম আছে তার মায়েরও। ব্যাংকার মা শুধু টাকা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। অফিস থেকে নিয়েছিলেন ১০ দিনের ছুটি। নিজ হাতে ছেলের ফুড কর্নার তৈরি করে বসিয়ে দিয়েছেন। এখানেই দাঁড়ি টানেননি। এখনও ছেলের ফুড কর্নারে রাতের বেলা যখন খদ্দের বেড়ে যায় তখন নিজ হাতে খাবারদাবার তদারকি করেন।

সাধারণত ফুড কর্নার মানেই পকেট থেকে কয়েকশো টাকা বেরিয়ে যাওয়া। এখানেও আলাদা নাফিজ ফুড কর্নার। তার দোকানের খাবারগুলো সবই মধ্যবিত্তদের নাগালের মেেধ্য। মূল্য পরিশোধের সময় একেবারেই গায়ে লাগে না। আপনি যে খাবারই খান না কেন দাম ৫০ টাকার ভেতরে। এখানে পাওয়া যায় সুপ, নুডুলসসহ আরও অনেক কিছু। দামের তালিকাটা না হয় দিয়েই দেই। ডাবের পুডিং ৩০ টাকা। স্যুপ, নুডলস, ড্রাগন ফ্রুট বা ভ্যানিলা বাদামের জুস ৪০ টাকা। সাসলিক ও তন্দুরি চিকেন ৫০ টাকা। সাধ্যের মধ্যে দাম রাখার ব্যাখ্যা রয়েছে নাফিজের কাছে। সে মনে করে বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের কাছে এত টাকা থাকে না। তাই মন চাইলেও খেতে পারে না তারা। সেক্ষেত্রে নাফিজ ফুড কর্নার থেকে যেন তাদের ফিরে যেতে না হয় সেজন্য সাধ্যের মধ্যে রেখেছেন খাবারের দাম।

এরই মধ্যে নাফিজের এই উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে। স্থানীয়দের অনেকেই এসে ভিড় করেন নাফিজের খাবারের দোকানে। কেউ অভ্যাসবশত আসেন, আবার কেউবা দেখতে। এলাকার তরুণদেরও বেশ অনুপ্রাণিত করছে বিষয়টি। এরকম একজন বলেন, আমাদেরও ছোটবেলায় এরকম ইচ্ছা হয়েছে। কিন্তু নানা কারণে সেটি সম্ভব হয়নি। তবে নাফিজ সেটি করতে পেরেছে। হয়তো সে আমাদের ছোট। কিন্তু তার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয় এবং আমাদেরও অনুপ্রাণিত করে। তার দেখাদেখি আরও অনেকে এরকম অল্প বয়সেই স্বাবলম্বী হওয়ার চেষ্টা করবে বলে মনে করছি। তার জন্য শুভকামনা।

নাফিজও এরকমই ভাবে। সে মনে করে এই বয়সটায় অবসর সময়টুকু বসে থেকে বা খেলে কাটানোর পাশাপাশি একটু কাজে লাগানো উচিত। সে কারণেই এরকম উদ্যোগ নিয়েছে সে। তার দেখাদেখি অনেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে। তার এই উদ্যোগ যদি কাউকে অনুপ্রাণিত হয় তাহলে তার নিজেরও ভালো লাগবে।

এদিকে মনে হতে পারে ব্যবসায় নেমে পড়ালেখার বারোটা বাজাচ্ছে নাফিজ। বিষয়টি একেবারেই সেরকম না। কেননা এতে তার পড়ালেখার কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বলেও জানাল সে। সারাদিন স্কুল শেষে সন্ধ্যার পরে ফুট কর্নার খোলে সে। নয়টা-দশটা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। ছোট একটু ফুট কর্নারের পেছনে পেতে রাখা দুটি বেঞ্চে ভিড় পড়ে যায় খদ্দেরের। পাশাপাশি ফুট কর্নার ঘিরে দাঁড়িয়ে থেকেও পছন্দের খাবার অর্ডার দেয় ক্রেতারা।

এক হাতে সামলাতে পারে না নাফিজ ও তার মা। এজন্য রয়েছে অতিরিক্ত লোক। সবার হাত লাগানোয় বেশ সরগরমভাবেই চলছে না নাফিজের ফুড কর্নার।

বিষয়টি নাফিসের সহপাঠিদের মধ্যে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে এবং তার শিক্ষকদের মধ্যেও। খবর পেয়ে শিক্ষকদের  অনেকে এসেছিলেন। উৎসাহ দিয়ে গেছেন বলে জানালো নাফিজ।

নাফিজের বন্ধু মাশরুর মাহবুব আফনানের কথায়, আমার বন্ধু অনেক সাহসী। ও ক্লাস নাইনে থেকে যেটা করছে, অনেকে কলেজে-ভার্সিটিতে পড়েও এটা করতে পারে না। কারণ আমাদের সমাজ, এই জিনিসটাকে অনেকে ছোট মনে করতে পারে। কিন্তু নাফিজ এটা করতে পেরেছে।

১৭ সেপ্টেম্বর থেকে খোলা হয়েছে ফুড কর্নারটি। কেমন চলছে জানতে চাইলে নাফিজ বলে, ‘এখন পর্যন্ত রেসপন্স খুব ভালো পাচ্ছি। সবাই প্রশংসা করছে। সবার কাছ থেকে ভালো সাপোর্ট পাচ্ছি। বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাই সাপোর্ট করছে মানসিকভাবে। কাস্টমারও আসছে প্রচুর।’

নাফিজের কথায়, ‘বিদেশে তো প্রেসিডেন্টের ছেলে-মেয়েদেরকেও কাজ করে খেতে হয়। বাংলাদেশে কেউ যদি কিছু করতে চায়, অর্ধেক মানুষ নেতিবাচক মন্তব্য করে। তবে তা কানে নেওয়া যাবে না। যারা প্ল্যান করছে আমি এমন কিছু করবো, আমি তাদের বলবো শুধু প্ল্যান করলেই হবে না, কাজ শুরু করে দিতে হবে।’

সে আরও বলে, ‘আজ থেকে ১০ দিন আগেও জানতাম না আমি এই অবস্থানে আসবো। প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে পেরেছি বলেই সম্ভব হয়েছে।’

নাফিজের বাবা আবুল কালাম আজাদ একজন ব্যবসায়ী। ছেলে যখন ব্যবসার পরিকল্পনা শোনায় তিনি বলেছিলেন, যা-ই করবে, পড়াশোনা ঠিক রেখে করতে হবে। নাফিজ তাতে রাজি হওয়ায় আর দ্বিমত করেননি তিনি।

নাফিজের বাবার কথায়, বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট ভেবে দেখলাম, যে সময়টা বাইরে ঘোরাঘুরি করবে, সে সময়টা এখানে দিলে ক্ষতি নেই। সার্বিক চিন্তা করেই আমি মত দিয়েছি। দেখতে দেখতে ব্যবসা শিখে যাবে। চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরার চেয়ে যদি এটাকেই আরেকটু ডেভেলপ করতে পারে, তাহলে তো ভালো। বাবা-মা হিসেবে আমাদের সহযোগিতা সবসময় থাকবে।

জেনে নেওয়া যাক যেভাবে ভাইরাল হলো নাফিসের এই ফুড কর্নার। এরকম ইচ্ছা পোষণ করে নাফিস সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েক লাইন লিখেছিল সে। বিষয়টি নজরে পড়ে অনেকের। ভাইরাল হয় সেই পোস্ট। তাকে উৎসাহ দিয়ে নেটিজেনরা অনেকেই অনেক কথা লেখেন। তেমনই একজন লিখেছিলেন, ‘সোসাইটির মেন্টালিটিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে কিছু করার মতো সাহস আজ অব্দি জন্মায়নি বলে অনেক কিছু করবো করবো করেও করা হয়নি। আমি আপনার কারেজকে স্যালুট জানাই।”

তবে অল্প বয়সে ব্যবসায় যুক্ত হলেও ভবিষ্যতে পেশা হিসেবে যে ব্যবসা বেছে নেবে এরকম কোনো লক্ষ্য নেই তার। ইচ্ছা আছে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিদেশ পাড়ি দেবে। এরমকই স্বপ্ন তার। তবে জীবনের লক্ষ্য কিন্তু তার এটা না। অন্যরা লেখাপড়া করে ভালো চাকরি বা সুরক্ষিত জীবন কামনা করলেও নাফিস বড় হয়ে হতে চায় ভালো মানুষ। আমাদের প্রত্যাশা যেরকম ভালো উদ্যোগ নিয়ে সকলের মধ্যে অনন্য দৃষ্টান্তে স্থাপন করতে পেরেছে সেভাবেই যেন বড় হয়ে ভালো মানুষ হতে পারে নাফিজ।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: ইন্টারপ্রেনিওর

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − seven =