আলোচিত সমালোচিত বিপিএল ২০২৫ এখন ক্রান্তিলগ্নে

সালেক সুফী: অনেক পরিবর্তন এবং সংস্কারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু করা বাংলাদেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক মানের ঘরোয়া ক্রিকেট টুর্নামেন্ট বিপিএল ২০২৫ এখন ক্রান্তি লগ্নে। শিরোপাধারী বরিশাল বার্নার প্রত্যাশা মত চিটাগাং কিংসকে   সহজে পরাজিত করে পৌঁছেছে ফাইনালে।  অপরদিকে প্রথমদিকে বিবর্ণ অথচ শেষদিকে মোমেন্টাম অর্জনকরে শক্তিশালী দল খুলনা টাইগার্স প্রথম আট ম্যাচে অপরাজিত রংপুর রাইডার্সকে বিপর্যস্ত করে ফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জনের জন্য কাল লড়াই করবে চট্টগ্রাম কিংসের  বিরুদ্ধে।

মাঠের খেলায় ঢাকা মীরপুর, সিলেট, চট্টগ্রামে ম্যাচগুলোতে রেকর্ড সঙ্কট দর্শক সমাগম হয়েছে। উইকেটগুলো স্পোর্টিং ছিল, স্থানীয় ক্রিকেটাররা দুর্দান্ত পারফর্ম করেছে, আম্পায়ারিং বিশ্বমানের ছিল. কিন্তু খেলোয়াড়দের পেমেন্ট জটিলতা, ম্যাচ ফিক্সিং সহ নানা অভিযোগে কলংকিত হয়েছে বিপিএল। বাংলাদেশ ক্রিকেট এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে কালিমা লিপ্ত হয়েছে। আশা করি টুর্নামেন্ট শেষ হওয়ার পর সরকার এই বিষয়ে ইতিমধ্যে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

খেলার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বিপিএলের সঙ্গে ক্রিকেট  বিশ্বের অন্যানো ফ্রাঞ্চাইজ ক্রিকেটের পার্থক্য হলো বিপিএল এতোদিনেও নিজের ব্র্যান্ড সৃষ্টি করতে পারেনি।  ফ্রাঞ্চাইজ গুলোকে আদৌ পেশাদার বলা যাবে না. প্রতিটি আসরেই কিছু ফ্রাঞ্চাইজ মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। মালিকরা অনেক ক্ষেত্রেই দেশি বিদেশী খেলোয়াড়দের চুক্তি অনুযায়ী যথা সময়ে পাওনা পরিশোধ করে না। কিছু ম্যাচ নিয়ে কিছু খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে ম্যাচ ফিক্সিং, স্পট ফিক্সিংয়ের অভিযোগ থাকলেও টুর্নামেন্ট শেষে সবাই ভুলে যায়। কিছু মিডিয়া, কিছু কনটেন্ট ক্রিয়েট কিছু সময় হৈ হুল্লো করলেও প্রভাবশালী মহলের সম্পৃক্ততা থাকায় অভিযোগগুলো চাপা পরে যায়। এবারে কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে সরকারের উঁচু মহল বিপিএল আয়োজনে সম্পৃক্ত থাকায় ক্রিকেট প্রেমিকরা আশাবাদী ছিল পরিশুদ্ধ টুর্নামেন্ট দেখার। আপাতত সেই আশায় গুড়েবালি।

সাত দলের টুর্নামেন্টে প্রথম পর্যায়ে প্রতিটি দলকে ১২ টি করে ম্যাচ খেলতে হয়েছে। খেলোয়াড় ড্রাফটিং দেখে মনে হয়েছে শিরোপাধারী ফরচুন বরিশাল এবং খুলনা টাইগার্স এবারের টুর্নামেন্টের অধিকতর ব্যালান্সড দল করেছে। আগেই বলেছি অন্যানো ফ্রাঞ্চাইজ থেকে নানা কারণে পিছিয়ে পড়ে বিপিএল ২০২৫ খুব উঁচু মানের বিদেশী খেলোয়াড় আকর্ষণ করতে পারে নি। রাজনৈতিক কারণে খেলার সুযোগ হয় নি সাকিব আল হাসান এবং মাশরাফি মুর্তজার। অনেকটা একই কারণে বরাবরের শক্তিশালী দল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্স দল গঠন করতে পারে নাই. ঢাকার বাইরে খুলনা, বরিশাল  বা রাজশাহীতে খেলার আয়োজন করা সম্ভব হয় নাই।

সবাইকে অবাক করে অপেক্ষাকৃত দুর্বল দল নিয়েও রংপুর রাইডার্স প্রথম পর্যায়ে ৮ ম্যাচ জয় করে সবার আগে শীর্ষ চারে স্থান করে নেয়।  যদিও এর পর থেকে ওরা মোমেন্টাম হারিয়ে পর পর ৪ টি ম্যাচ হেরে কোনোভাবে শীর্ষ চার অবস্থান ধরে রাখে। অন্যদিকে শক্তিশালী ফরচুন বরিশাল গ্রুপ পর্যায়ে ৩টি ম্যাচ (দুইবার রংপুর রাইডার্সের কাছে) হেরে শীর্ষ স্থানে থেকেই গ্রূপ পর্যায় শেষ করে. খুলনা টাইগার্স প্রথম দিকে নিজেদের গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিলেও একপর্যায়ে মোমেন্টাম পেয়ে শীর্ষ চারে উঠে আসে. চট্টগ্রাম স্ট্রাইকারস একই ভাবে শেষ পর্যায়ে ভালো খেলে শেষ চারে স্থান পায়।

সবচেয়ে হতাশ করে ঢাকা কাপিটালস এবং সিলেট স্টাইকার্স। একের পর এক ম্যাচ হেরে ঢাকা শুরুতেই কোনঠাসা হয়ে পরে. একই অবস্থা ছিল সিলেট স্ট্রাইকারসদের।  স্বাভাবিক কারণেই রংপুর রাইডার্সের মত ঢাকা এবং সিলেটের দল দুটো ছিটকে পরে. ঢালিউড তারকা শাকিব খানের প্রথম মিশন সফল হয় নি।

কাল ছিল ফরচুন বরিশাল এবং চট্টগ্রাম কিংসের ফাইনালে ওঠার লড়াই। তরুণ এবং অভিজ্ঞ মান সম্পন্ন খেলোয়াড়দের নিয়ে গঠিত ফরচুন বরিশাল ( ১৫০/১) দাপটের সঙ্গে খেলে চট্টগ্রাম কিংসকে (১৪৯/৯) ৯ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে পরাজিত করে. এই ম্যাচে কাল প্রথম খেলা পাকিস্তানী বলার মোহাম্মদ আলী একাই ২৪ রানের বিনিময়ে ৫ উইকেট নিয়ে চট্টগ্রাম কিংসদের ধসিয়ে দেয়। বাট হাতে বাংলাদেশী তরুণ তাওহীদ হৃদয় অপরাজিত ৮২ রান তুলে জয় নিশ্চিত করে। চট্টগ্রাম কিংসের হয়ে শামীম হোসেনের মারকুটে ৭৯ রান বিফলে যায়।

দিনের প্রথম খেলা ছিল রংপুর রাইডার্স এবং খুলনা টাইগার্সের টিকে থাকার লড়াই। দুটি দল শেষ মুহূর্তে বিশ্ব টি২০ ক্রিকেটের ফেরিওয়ালাদের দলে ভিড়িয়েছিলো। রংপুর দলে ছিল ইংরেজ খেলোয়াড় জেমস ভিন্স, অস্ট্রেলিয়ান টিম ডেভিড এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের আন্দ্রে রাসেল। অপরদিকে খুলনার দলে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিমরন হেটমায়ার এবং জেসন হোল্ডার। কাল এসেই আসলাম, দেখলাম, জয় করলাম এমন কিছুই করতে পারে নি বিদেশী খেলোয়াড়রা।  প্রথমে ব্যাটিং করে মেহেদী মিরাজ (৩/১০) ,নাসুম আহমেদ (৩/১৬) ঘূর্ণি বলের মোকাবেলায় দাঁড়াতেই পারে নি রংপুরের ব্যাটসম্যানরা। তিন বিদেশির সম্মিলিত অবদান ছিল ১+৭+৪= ১২।  ৮৫ রানে গুটিয়ে যায় রংপুর। সেই স্কোর তাড়া করে ১০.২ ওভারে ৮৯/১ করে ৯ উইকেটের বিশাল ব্যাবধানে ম্যাচ জয় করে টুর্নামেন্ট থেকে রংপুর রাইডার্সের বিদায় ঘন্টা বাজায় খুলনা। এখন খুলনা -চট্টগ্রাম লড়াই হবে কাল ফাইনালে কোন দল মোকাবিলা করবে ফরচুন বরিশালের ?

অনেক কলঙ্ক এবং বিতর্ক সঙ্গী করে বিপিএল ২০২৫ শেষ হবার পরেই কিন্তু বাংলাদেশকে যেতে হবে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে। ঘোষিত জাতীয় দলে শেষ মুহূর্তে পরিবর্তন করার মোট কোন কারণ দেখি না. নাঈম শেখ কিন্তু টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুন ব্যাটিং করেছে। ওপর দিকে অধিনায়ক নাজমুল শান্তকে কিন্তু ফরচুন বরিশাল সুযোগ দেয় নি. ওপর ওপেনার সৌম্য ফর্মে থাকলেও হাতে আঘাত পেয়েছে।

এবারের বিপিএল ২০২৫ বিতর্কিত প্রসঙ্গগুলোর গ্রহণযোগ্য সমাধান না হলে কিন্তু বিপিএল ২০২৬ আয়োজন অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

twenty + twelve =