সহিংসতার ভেতরেই জীবন খুঁজেন ট্যারান্টিনো

নিবিড় চৌধুরী

ক্ষমতার বিভিন্ন স্তর থাকে। মানুষ তারচেয়ে ক্ষমতাবানকে সমঝে চলে এবং দুর্বলকে নিপীড়ন করে। কেবল মানুষ নয়, এটা যেন প্রত্যেক প্রাণীর সহজাত স্বভাব। আজ তেমন এক সিনেমার কথা বলা যাক শুরুতে। বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা পরিচালক কুইন্টিন ট্যারান্টিনোর ‘পাল্প ফিকশন’ ক্ষমতার রদবদল বা ‘হাতি গর্তে পড়লে পিঁপড়াও কামড়ায়’-এর দারুণ এক উদাহরণ হয়ে থাকবে চলচ্চিত্রের ইতিহাসে। ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বললে, পাল্প ফিকশন আমার দেখা সেরা মুভির একটি। এমন ডার্ক কমেডি আর কোথাও দেখিনি। বিশেষ করে, সময় ও ঘটনার হেরফেরে শহরের সবচেয়ে বড় গ্যাংস্টার মার্সেলাস ওয়ালেস যখন মলেস্টের শিকার হয় এক যৌনবিকৃত লোকের হাতে আর তাকে বাঁচায় তারই শত্রু ব্রুস উইলিস (বুচ কুলিচ)। যাকে মারার জন্য ওয়ালেস নির্দেশ দিয়েছে ভাড়াটে গুন্ডাদের। মলেস্টের (যৌন নিপীড়নের) মাঝপথে উদ্ধার হওয়ার পর ওয়ালেস অনুরোধ করেন, তার জীবনের এই করুণ কাহিনীটা যেন কুলিচ কাউকে না বলে। চিন্তা করুন তো, একটা শহরের সবচেয়ে বড় গ্যাংস্টারকে দুর্ঘটনাবশত একজন যৌন নিপীড়কের কাছে হেনস্থা হতে হচ্ছে আর সে বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে! আমার মনে হয়, ট্যারান্টিনো এই একটি দৃশ্য দিয়ে অনেক কিছু বলে দিয়েছেন। অর্থাৎ, ক্ষমতা চিরকাল একরকম থাকে না। নিজের গণ্ডিতে নিজেকে রাজা মনে করলেও বাইরের দুনিয়ায় আপনিও অন্যদের মতো সামান্য একজন। শত্রুও কখনও কখনও জীবন বাঁচিয়ে দিতে পারে। তাই কাউকে ছোট করে দেখা উচিত নয়। দুর্ঘটনা আপনাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে, সেটা ভাবতেও পারবেন না। জীবন আপনাকে ওপরে উঠিয়েও দেখবে, নামাতেও সময় লাগবে না।

ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যখন স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে তখন পতন অনিবার্য। সেটা আমরা সম্প্রতি দেখেছি বাংলাদেশে, সিরিয়ায়। শ্রীলঙ্কাতেও কি দেখিনি? পৃথিবীতে সেই হলো ক্ষমতাহীন, যে অন্যের ওপর চিৎকার চেঁচামেচি বা কোনোকিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার, ‘তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে’। নিম্নবর্গের ক্ষমতায়ন মানেই বিপ্লব। বিখ্যাত এইচবিও সিরিজ ‘গেম অব থ্রোনস’-এর অন্যতম চরিত্র সের্সি ল্যানিস্টারের ‘পাওয়ার ইজ পাওয়ার’ কথাটা মনে আছে তো? না থাকলে একটু স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। সিরিজে উপদেষ্টা (বুদ্ধিজীবী) লিটলফিঙ্গার চার সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসা সের্সিকে বিখ্যাত দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের মতো বলেন, ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’। কিন্তু সেই কথাকে সের্সি কাউন্টার দেন এভাবে, ‘তাকে বন্দী করো’। এ সময় সৈন্যরা লিটলফিঙ্গারকে ধরে ফেললে সের্সি আবার বলেন, ‘ছেড়ে দাও। পাওয়ার ইজ পাওয়ার’। সের্সি এটাই বুঝাতে চেয়েছেন, জ্ঞানের ক্ষমতা আছে বটে তবে ক্ষমতাবানের ক্ষমতার কাছে সেটা নস্যি। আদতেই কি? আপনার কি মনে হয় পাঠক? কিন্তু নিজের কারণে সের্সির সেই পাওয়ারেরও পতন হয় (ক্ষমতা যে ক্ষণস্থায়ী)। সঙ্গে জ্বলে যায় তার পুরো সাম্রাজ্য। এরপর নতুন করে সব কিছু তৈরির শপথ নিতে থাকেন পিটার ডিংকলেজ, জন স্নোরা। ধ্বংস মানে নতুনের শুরুও। তবে সেটা যেন পরে জর্জ অরওয়েলের ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ হয়ে যেন না দাঁড়ায়। যেখানে বিপ্লবের পর উপরের শ্রেণি শুধু ভোগে মত্ত আর নিচুরা কাজ করেই যাচ্ছে। পাঠক এবার অনুরোধ, সব কিছু আমাদের চারপাশের ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার।

ট্যারান্টিনোর ছবি মানেই ভায়োলেন্স (সহিংসতা) আর ক্ষমতার বিভাজন নীতিতে এগিয়েছে। চিরায়ত বলতে কিছুই নেই। সেই দৃষ্টিকোন থেকে ট্যারান্টিনো দেখিয়েছেন, কীভাবে ক্ষমতার রদবদল হয়। সেটা পাল্প ফিকশনে হোক বা রিজর্ভয়র ডগস, কিল বিল ১ ও ২, হেইটফুল এইট, জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড বা ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড। সবচেয়ে কম ভায়োলেন্স ছিল বোধহয় ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া তার সবশেষ তারকাবহুল ছবি ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন হলিউড’-এ।

পাল্প ফিকশন অনেক ডিস্টার্বিং, ভায়োলেন্সে ভরা বটে, তবে গত শতকের সেরা মুভির একটি, এই কথা অনেকের। ১৯৯৪ সালে এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর পুরো হলিউডে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠে। অবশ্য এমন ভায়োলেন্স ভরা ছবির কথা বললে আরেকটা সিনেমাকে উল্লেখ না করে উপায় নেই। কোয়েন ব্রাদার্সের ‘নো কান্ট্রি ফর ওল্ড ম্যান’। হলিউডের তুলনায় বেশ কম বাজেটের। তবে এর একটি মুহূর্তও আপনি বাদ দিতে পারবেন না। এমনকি প্রচুর ডিস্টার্বিং দৃশ্য ও ডিস্টর্টেড হলেও। বিশেষ করে, টাকার বস্তা নিয়ে সটকে পড়া ব্রোলিনকে খুঁজতে গিয়ে হাভিয়ের বার্দেম যখন এক বুড়ো দোকানির সঙ্গে কথার পর কথা কথা বলতে থাকেন; আপনার মনে হবে, মুহূর্তেই অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে, সেই অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু কিছুই ঘটছে না। কী এক টেনশন! পুরো ছবিতে সাসপেন্স আর বার্দেমের স্টোন ফেস দেখে যে কেউ ভয় পেতে বাধ্য।

একবিংশ শতাব্দীর সিনেমার জগতে কেন ট্যারান্টিনো গুরুত্বপূর্ণ? শুধু ব্ল্যাক কমেডি বা ভায়োরেন্সের জন্য? না। এসব তো এখন প্রায় ছবিতেই দেখা যায়। তবে নতুন শতকের শুরুতে ট্যারান্টিনো সেটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছেন। তিনি এমনভাবে গল্প বলতে থাকেন, মনে হবে আপনিই হয়ে উঠেছেন তার ছবির চরিত্র। প্রোটাগনিস্ট বা কেন্দ্রীয় চরিত্রের ওপর জোর দেওয়ার চেয়ে তিনি ঘটনা বা প্লটের ওপরেই জোর দেন। সেখানে সব চরিত্রই হয়ে উঠে গুরুত্বপূর্ণ। হোক সেটি ২ মিনিটের বা ২ ঘণ্টার চরিত্র। আলেহান্দ্রো ইনারিতুর মতো অনেক ঘটনা বা গল্প ট্যারান্টিনো বলেন না। তবে একটার সঙ্গে আরেকটার সামঞ্জস্য থাকে। যেন দৃশ্যমান এত সুতার সঙ্গে অদৃশ্য অনেক সুতা বাঁধা। এই কারণে মুক্তির পর রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল পাল্প ফিকশন। বিশেষ করে এই ছবির ডায়ালগ, কাস্টিং এত অনবদ্য! এতটুকু বোরিং লাগবে না। পাল্প ফিকশন এগিয়েছে আন্ডারওয়ার্ল্ডের জীবন নিয়ে। আর সেটা নিয়েন্ত্রণ করে মার্সেলাস। আর তার দুই হাত জন ট্রাভোল্টা (ভিনসেন্ট ভেগা) ও স্যামুয়েল জ্যাকসন (জুলস উইনফিল্ড) পুরো মুভিতে একের পর এক রক্তে রাঙায় হাত। অবশ্য দুজনকেও মরতে হয়। দুজনে একের পর এক কথা বলতে বলতে ঠান্ডা মাথায় যেভাবে শ্যুট করে নিরীহ বা শত্রুর ওপর সেটি অবাক করে দেওয়ার মতো।

পাল্প ফিকশনের শুরু এক প্রেমিক যুগলের কফি শপে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা থেকে। হঠাৎ কথা বলতে বলতে বন্দুক বের করে কফি শপের সবাইকে হুমকি দিতে থাকে দুজনে। তবে দুজনকেই মরতে হয় ভেগা ও উইনফিল্ডের গুলিতে। এই ছবির আরেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র উমা থারম্যান (মিসেস মিয়া ওয়ালেস), যিনি আন্ডারওয়ার্ল্ডের বস মার্সেলাসের স্ত্রী। হেরোইন নেওয়ার পর ভেগার সঙ্গে বারে থারম্যানের নাচ এই মুভির বিশেষ সংযোজন। সিনেমার ইতিহাসেও অন্যতম এক দৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। অতিরিক্ত ড্রাগ নেওয়ার রক্তাক্ত থারম্যানের সংকটাপন্ন অবস্থা, মার্সেলেসের হাত থেকে বেঁচে প্রেমিকার সঙ্গে উইলিসের পালিয়ে যাওয়া; সব কিছু এগিয়ে হিউমারে ভরা ডায়ালগের ভেতর দিয়ে। মুক্তির পরপরই বক্স অফিসে সফলতা পেতে থাকে পাল্প ফিকশন। কান ফিল্ম ফেস্টিভেলে পায় সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘পাম দি’অর’। মনোনীত হয় অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের সাতটি ক্যাটাগরিতে। তার মধ্যে আছে সেরা ছবি, ডিরেক্টিং ও ফিল্ম এডিটিং। জ্যাকসন, থারম্যান ও ট্রাভোল্টা পান সেরা অভিনেতার মনোনয়ন। আর বেস্ট অরিজিনাল স্ক্রিনপ্লের জন্য ট্যারান্টিনো পান অস্কার।

ট্যারান্টিনোর ছবি মানে জ্যাকসনের উপস্থিতি। থারম্যানকে দিয়েও বানিয়েছেন ‘কিল বিল ১ ও ২’। এক নারীর জাপানি সামুরাইদের মতো লম্বা এক তলোয়ার হাতে প্রতিশোধ নেওয়া নিয়ে এই ভল্যুয়ম সিনেমা। জ্যাকসন আছেন জ্যাঙ্গো আনচেইন্ড ও হেইটফুল হেইটে। আর ট্যারান্টিনো পরিচালক হলেও ফাঁক ফোঁকরে দেখান তার অভিনয় প্রতিভাও। তাকে ফুট ফেটিশও বলা যায়। কেন ছবিতে এত ভায়োলেন্স? এ নিয়ে ‘দ্য টক’কে ট্যারান্টিনো বলেছিলেন, ‘আমি শুধু আমার গল্পটাই বলছি এবং আমার কাজ করছি। আমি যে ধরানাগুলো (জনরা) নিয়ে কাজ করছি সেগুলোর মধ্যে চাঞ্চল্যকর, হিংসাত্মক উপাদান রয়েছে।’ মূলত হলিউডের জলো ট্যারান্টিনোর ছবিতে ওয়েস্টার্নের ছাপ পাওয়া যায় বেশি। চীন-জাপানের কুং ফু ও সামুরাইও উঠে আসে তার ছবিতে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: বায়োস্কোপ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

3 × 4 =