ঋষিকা
পাঁচবার একাডেমি পুরস্কার, নয়বার গোল্ডেন গ্লোব, সাতবার স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার ও চারবার বাফটা পুরস্কারে মনোনয়ন। এর মধ্যে একবার একাডেমি পুরস্কার, দুইবার গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, দুইবার স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড পুরস্কার লাভ। শুধু তাই নয় একবার প্রাইমটাইম এমি ও একবার ডেটাইম এমি পুরস্কার লাভ করেন তিনি। কান চলচ্চিত্র উৎসব, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব, ও ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার অর্জন করেন। চতুর্থ ব্যক্তি ও দ্বিতীয় নারী হিসেবে এই কীর্তি অর্জন করেন জুলিয়ান মুর।
জুলিয়ান মুর ১৯৬০ সালের ৩ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ট ব্রাগ, নর্থ ক্যারোলিনায় জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম ছিল জুলি অ্যান স্মিথ। তার বাবা পিটার মুর স্মিথ ভিয়েতনাম যুদ্ধ চলাকালীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর প্যারাট্রুপার ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি কর্নেল ও সেনাবাহিনীর বিচারপতির পদ লাভ করেন। মুরের মা অ্যান ছিলেন স্কটল্যান্ডের মনোবিদ ও সমাজকর্মী। অ্যানি ১৯৫১ সালে তার পরিবারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন। মুর বোস্টন ইউনিভার্সিটি থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে আসেন। এরপর তিনি একটি রেস্তোরাঁয় পরিবেশনকারী হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৫ সালে তিনি অফ-ব্রডওয়ে থিয়েটারের সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তার প্রথম পর্দায় কাজ ছিল ১৯৮৫ সালের সোপ অপেরা ‘দ্য এজ অফ নাইট’। জুলিয়ান মুরকে তার বাবার পেশাগত কারণে নয়বার স্কুল বদল করতে হয়েছিল। স্কুলজীবনে সহপাঠীদের অনেকেই তাকে ‘ফ্রেকেলফেস স্ট্রবেরি’ (স্ট্রবেরির মতো ছোপ ছোপ দাগ আছে যার মুখে) বলে খ্যাপাতো। ৮৭তম অস্কারের আসর থেকে ‘স্টিল অ্যালিস’ ছবির ‘অ্যালিস’ চরিত্রে অভিনয়ের সুবাদে অস্কার পুরস্কার প্রাপ্তির আগে কান উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন জুলিয়ান।
চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু
১৯৯৫ সালের ‘নাইন মান্থস’ এবং ১৯৯৭ সালের ‘দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড: জুরাসিক পার্ক’ চলচ্চিত্র দিয়ে নিজেকে প্রধান চরিত্রের অভিনেত্রী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন জুলিয়ান মুর। ১৯৯০ সালে স্বল্প বাজেটের হরর চলচ্চিত্র ‘টেলস ফ্রম দ্য ডার্কসাইড: দ্য মুভি’ দিয়ে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় জুলিয়ান মুরের। ‘দ্য হ্যান্ড দ্যাট রকস্ দ্য ক্র্যাডল’-এ তার অভিনয় নজর কাড়ে সমালোচকদের। অপরাধধর্মী-কমেডি ‘দ্য গান ইন বেটি লুস হ্যান্ডব্যাগ’ চলচ্চিত্রে কেন্দ্রীয় চরিত্র কুকির বোনের কিংবা ১৯৯৩ সালে জনি ডেপ-এর বিপরীতে রোমান্টিক-কমেডি ‘বেনি অ্যান্ড জুন’ চলচ্চিত্র কোনোটিতেই নিজেকে অভিনেত্রী হিসেবে ফিকে করে ফেলেননি মুর। এছাড়া তিনি সে বছরের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ‘দ্য ফিউজিটিভ’ চলচ্চিত্রেও ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করেন। মুর ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ২০০০-এর দশকের প্রথম দিকে মূলত পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে ‘বুগি নাইট্স’, ১৯৯৯ সালে ‘দি এন্ড অব দি অ্যাফেয়ার’, ২০০২ সালে ‘ফার ফ্রম হেভেন’, এবং ২০০২ সালে ‘দি আওয়ারস’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে অস্কারে মনোনয়ন পান তিনি।
পাওয়া, না পাওয়া
‘শাটার কটস’ মুরের ক্যারিয়ার উজ্জ্বল করে তোলে। এর পর ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায় ঠধহুধ ড়হ ৪২হফ ঝঃৎববঃ, যা তার চলমান টহপষব ঠধহুধ কর্মশালার একটি চলচ্চিত্র, পরিচালনা করেন লুই মাল। মুর ইড়ড়মরব ঘরমযঃং-এ তার সাফল্যের পর কোয়েন ব্রাদার্সের ডার্ক কমেডি ঞযব ইরম খবনড়ংিশর (১৯৯৮)-এর একটি চরিত্রে অভিনয় করেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তির সময়ে হিট হয়নি, তবে পরে এটি একটি কাল্ট ক্লাসিক হয়ে উঠেছে। তার চরিত্র ছিল মাউদে লেবওস্কি। যিনি একজন নারীবাদী শিল্পী এবং ঐশ্বরিক চরিত্রের নারী যে দ্য ডিউড (জেফ ব্রিজেস, ছবির প্রধান চরিত্র) এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৯৮ সালের শেষে, মুর গাস ভ্যান সেন্টের ‘সাইকো’ তে ফ্লপ করেন, যা একই নামের আলফ্রেড হিচকক ছবির রিমেক ছিল। তিনি ছবিতে লীলা কারেন চরিত্রে অভিনয় করেন, যা সমালোচিত হয়েছিল এবং ঞযব এঁধৎফরধহ ম্যাগাজিনে তার এই কাজটিকে অর্থহীন কাজগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে বলা হয়েছিল। ইড়ীড়ভভরপব ম্যাগাজিনের একটি পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল ‘একদল অত্যন্ত প্রতিভাবান মানুষ ছবিতে তাদের জীবনের কয়েকটি মাস ব্যয় করেছেন।’ মুর ২০০৩ সালে পর্দায় উপস্থিতি না দেখালেও ২০০৪ সালে তিনটি সিনেমা নিয়ে ফিরে আসেন। বছরের প্রথম দুটি ছবিতে কোনো সাফল্য ছিল না। ঞযব ঋড়ৎমড়ঃঃবহ ছবির সঙ্গে মুরের বাণিজ্যিক সাফল্য ফিরে আসে। যা ছিল একটি মনস্তাত্ত্বিক থ্রিলার। সেখানে তিনি একজন মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন যাকে বলা হয় তার মৃত ছেলে কখনও ছিল না। যদিও চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের কাছে জনপ্রিয় ছিল না, কিন্তু এটি যুক্তরাষ্ট্রের বক্স অফিসে প্রথম অবস্থানে ছিল। ২০০৯ সালে ঝরহমষব গধহ নামের সিনেমাটি আমেরিকান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ২০০৯ সালের শীর্ষ ১০টি সিনেমার মধ্যে একটি হিসেবে নির্বাচিত হয়। এতে অভিনয়ের জন্য পঞ্চম গোল্ডেন গ্লোব মনোনয়ন পান। ২০২৪ সালের ঐতিহাসিক স্যাটায়ার মিনি সিরিজ গধৎু ্ এবড়ৎমব-এ মুর অভিনয় করেছেন মেরি ভিলিয়ার্স চরিত্রে, যার বিপরীতে ছিলেন নিকোলাস গালিতজিনে যিনি জর্জ ভিলিয়ার্স চরিত্রে অভিনয় করেন। ঞযব এঁধৎফরধহ এর লুসি মুরের পারফরম্যান্সকে ‘অসাধারণ শীতল, বুদ্ধিমান এবং সবসময় ঝলমলে‘ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মুর অ্যাপল টিভি+ এর থ্রিলার সিনেমা ঊপযড় ঠধষষবু-এ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করবেন। তিনি এছাড়াও জেমস ম্যাকঅভয়-এর সঙ্গে ঈড়হঃৎড়ষ নামক একটি অ্যাকশন থ্রিলার সিনেমায় একত্রে কাজ করবেন।
পছন্দ অপছন্দ
অস্কারজয়ী অভিনেত্রী জুলিয়ান মুর এক সাক্ষাতকারে জানান, তিনি টুইটারে সময় কাটাতে ভালোবাসেন। তিনি বলেছেন, টুইটারে ব্যস্ত থাকার বিষয়টা তার কাছে এক নিষিদ্ধ আনন্দের মতো। টুইটার একটিমাত্র বিষয় যাতে আমি আসক্ত। টুইটারে তিনি অনেক কৌতুক অভিনেতা ও সংবাদমাধ্যমকে (নিউজ সাইট) ‘ফলো’ করেন বলেও জানিয়েছেন মুর। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে জুলিয়ান মুর জানান, তিনি রান্না করতে ভালোবাসেন। বিশেষ করে ‘থ্যাংকসগিভিং’-এর সময় তিনি ‘কর্নব্রেড’ বানাতে পছন্দ করেন।
মুরের সেরা ৫
১. বুগি নাইটস (১৯৯৭)
বুগি নাইটস প্রথম সিনেমা যা জুলিয়ান মুরকে অ্যাকাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন এনে দেয়। কমেডি ফিল্মটির কাহিনী লিখেছেন এবং পরিচালনা করেছেন পল থমাস অ্যান্ডারসন। জুলিয়ান মুর নিজে এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি এডি অ্যাডামসের একজন বন্ধু, এম্বার ওয়েভস। তিনি মার্ক ওয়ালবার্গ, বার্ট রেনল্ডস এবং ডন চিডলের সঙ্গে অভিনয় করেন। এক তরুণ, এডি অ্যাডামসের সম্পর্কে, যাকে একজন পর্নোগ্রাফি চলচ্চিত্র পরিচালক তার একটি ছবিতে অভিনয়ের জন্য আমন্ত্রণ জানায়। এরপর থেকেই, সে একটি সেনসেশনাল পর্নোস্টার হয়ে ওঠে। এডির কিছু বন্ধু রয়েছে যারা তার উচ্চাকাক্সক্ষা পূরণ করতে সহায়তা করে। দুর্ভাগ্যবশত, মাদক এবং তার উচ্চাকাক্সক্ষা তার ক্যারিয়ারের জন্য এক মারাত্বক হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
২. ফার ফরম হ্যাভেন (২০০২)
জুলিয়ান মুর ২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া ড্রামা ‘ফার ফরম হ্যাভেন’ সিনেমার প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন টড হেইনস, যিনি এই ছবির চিত্রনাট্যও লিখেছেন। জুলিয়ান মুর কাথি হুইটাকারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি একজন সফল স্ত্রী, মা এবং গৃহিণী। তিনি একজন সফল এক্সিকিউটিভ ফ্র্যাংককে বিয়ে করেন। তবে তাদের বিয়েতে সমস্যা তৈরি হয় যখন হঠাৎ ফ্র্যাংক গ্রেপ্তার হন। কাথি সন্দেহ করতে শুরু করেন যখন ফ্র্যাংক প্রায়ই দেরিতে বাড়ি ফিরে আসেন। এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন ফ্র্যাংককে দেখতে যাওয়ার। তিনি সেখানে কিছু খাবার নিয়ে যান। তারপর তিনি অবাক হয়ে যান যখন দেখেন ফ্র্যাংক অন্য একটি পুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ছেন।
৩. স্টিল এলিস (২০১৫)
জুলিয়ান মুরের অন্যতম সেরা সিনেমা ‘স্টিল এলিস’। এই সিনেমার জন্য তিনি সেরা অভিনেত্রী হিসেবে অ্যাকাডেমি পুরস্কার, গোল্ডেন গ্লোব পুরস্কার, ব্রিটিশ একাডেমি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডস পান। সিনেমায়, জুলিয়ান মুর আলিস হাওল্যান্ডের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি একজন ভাষাবিদ অধ্যাপক। সিনেমাটি রিচার্ড গ্লাটজার এবং ওয়াশ ওয়েস্টমোরল্যান্ড পরিচালনা করেন। লিসা জেনোভা রচিত একই নামের উপন্যাস থেকে সিনেমাটি অনুপ্রাণিত। এই সিনেমার কাহিনী আলিস হাওল্যান্ডের জীবন নিয়ে, যিনি কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির একজন ভাষাবিদ অধ্যাপক। যার জীবনে সুখ আছে, উজ্জ্বল ক্যারিয়ার আছে এবং খুবই স্নেহশীল স্বামী রয়েছে।
৪. দ্য আওয়ার্স (২০০২)
ফার ফরম হ্যাভেন সিনেমার সঙ্গে একই বছরে মুক্তি পায়, দ্যা আওয়ার্স। এই সিনেমায় তিনি মেরিল স্ট্রিপ এবং নিকোল কিডম্যানের মতো শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করেন। জুলিয়ান মুর লরা ব্রাউন চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যিনি একজন গৃহিণী। যদিও তার জীবন স্বামী ও পরিবার নিয়ে নিখুঁত মনে হয়, লরা আসলে তেমন সুখি নন। তিনি নিজের মন ভালো করতে একটি বই পড়তে শুরু করেন। এই সিনেমাটি তিনটি প্রজন্মের তিনটি আলাদা কাহিনী তুলে ধরে, তবে তাদের জীবন একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে একটি উপন্যাস ‘মিসেস ডালওয়ে’র ভেতরে, যেটি লিখেছেন ভার্জিনিয়া উলফ।
৫. ম্যাপস টু দ্যা স্টার্স (২০১৪)
জুলিয়ান মুর এমন অনেক সিনেমাতে অভিনয় করেছেন যেগুলোর থিম বেশ গুরুগম্ভীর বলা যায়। তার মধ্যে একটি হলো ২০১৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ম্যাপস টু দ্যা স্টার্স। এই সিনেমাটি একটি স্যাটায়ার ড্রামা যা সমস্যায় আক্রান্ত হলিউড অভিনেত্রী হাভানা সেগ্র্যান্ডের কাহিনি। হাভানা তার উজ্জ্বল ক্যারিয়ার পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বিখ্যাত সিনেমার চরিত্রে অভিনয় করার চেষ্টা করেন, যেটি তার মায়ের চরিত্রও। হাভানা পরে এক নতুন সহকারী নিয়োগ করেন, যিনি তার ক্যারিয়ারের জন্য বিপজ্জনক হয়ে ওঠেন। এই সিনেমার জন্য জুলিয়ান মুর কান চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রী হিসেবে পুরস্কৃত হন। তিনি গোল্ডেন গ্লোব অ্যাওয়ার্ড-এ বেস্ট অ্যাকট্রেস ইন মোশন পিকচারস হিসেবে মনোনীত হন।
মুরকে তার প্রজন্মের সবচেয়ে প্রতিভাবান এবং সাফল্যপ্রাপ্ত অভিনেত্রীদের মধ্যে এক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। অভিনয়ের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে, ২০০২ সালে একটি সাক্ষাৎকারে মুর বলেছিলেন যে তিনি পারফরম্যান্সের ৯৫ শতাংশ সেটে দাঁড়িয়ে করেন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি