আঁখি মিষ্টি গানের পাখি…

মাসুম আওয়াল

বাংলা গান যারা পছন্দ করেন তারা সকলেই চেনেন আঁখি আলমগীরকে। এ দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে শ্রোতাপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী তিনি। সুরের পৃথিবীতে মিষ্টি গানের পাখি হয়েই তিনি টিকে আছেন, টিকে থাকবেন। গানের এই পাখির জন্মদিন ৭ জানুয়ারি। সুন্দর এই দিনে প্রিয় শিল্পীর জন্য রঙবেরঙের পক্ষ থেকে রইলো ফুলেল শুভেচ্ছা। আঁখি আলমগীর তার পোশাকের জন্যও বরাবর নজর কাড়েন। বেশির ভাগ শাড়িই তার নিজের ডিজাইন করা। শখের বশেই তিনি এ কাজ করেন। হ্যান্ডমেড এক্সক্লুসিভ শাড়ি অনলাইনে বিক্রিও করছেন। সব মিলিয়ে আঁখি আলমগীর যাপন করছেন শৈল্পিক এক জীবন। জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাকে ঘিরেই এ আয়োজন।

ঢাকার মেয়ে

স্বনামধন্য অভিনেতা আলমগীর ও গীতিকবি খোশনূরের ঘর আলোকিত করে ১৯৭৫ সালের ৭ জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন আঁখি আলমগীর। তবে আঁখির আদি শহর নবীনগর উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। বাবা ও মা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের নন্দিত মানুষ। তাই দারুণ এক সাংস্কৃতিক পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। মা ছিলেন গীতিকবি। গানের আবহ খুব ছোটবেলাতেই তার মন ছুঁয়ে গেছে। বাবার দিক থেকে পেয়েছেন অভিনয় গুণ। এখন তার গায়িকা পরিচয়টিই সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে।

পথচলা শুরু অভিনয় দিয়ে

আঁখি আলমগীর মিডিয়ায় পা রাখেন অবশ্য অভিনেত্রী হয়েই। ১৯৮৪ সালে ‘ভাত দে’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন তিনি।

গানের মানুষ

‘ভাত দে’ সিনেমার পর আর আঁখি আলমগীরকে অভিনয়ে দেখা যায়নি তেমন। তিনি থিতু হয়েছেন সঙ্গীতে। শখের বশে চলচ্চিত্রে গান করতে গিয়ে সেখানে জনপ্রিয়তা পান এবং গানকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। ১৯৯৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম একক অ্যালবাম ‘প্রথম কলি’। আঁখি আলমগীরের তিন দশকের পেশাদার সঙ্গীতজীবন। ১৯টি একক অ্যালবাম তার। সব মিলিয়ে একই সঙ্গে গায়িকা, অভিনেত্রী, উপস্থাপিকা তিনি।

জনপ্রিয় হয়ে ওঠা

আঁখি ১৯৮৪ সালে আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘ভাত দে’ চলচ্চিত্রে ছোট্ট মেয়ে জরি চরিত্রে অভিনয় করেন। এতে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ শিশু শিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। আঁখি প্রথম চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেন ‘বিদ্রোহী বধু’ (১৯৯৪) চলচ্চিত্রে। তখন তিনি দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়াশুনা করতেন। ১৯৯৬ সালে আঁখি আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দেন। ১৯৯৭ সালে তার প্রথম গানের অ্যালবাম ‘প্রথম কলি’ প্রকাশিত হয়। পরের বছর তার সাড়া জাগানো ‘বিষের কাঁটা’ অ্যালবামটি প্রকাশিত হয়। এই অ্যালবামের ‘বন্ধু আমার রসিয়া’ ও ‘পিরীতি বিষের কাঁটা’ গান দুটি শ্রোতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তার আরেকটি আলোচিত গান হলো আলাউদ্দিন আলীর সুরে ‘বৈশাখী মেলা’। এছাড়া তিনি কবির বকুল রচিত এবং শওকত আলী ইমন সুরকৃত ‘ফাল্গুনে কৃষ্ণচূড়া’ গানে কণ্ঠ দেন। তিনি তার বাবা আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ চলচ্চিত্রের জন্য গাজী মাজহারুল আনোয়ার রচিত একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। গানটি সুর করেছেন রুনা লায়লা।

ক্যাসেট, সিডির যুগ পেরিয়ে

আঁখি আলমগীর জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন নব্বইয়ের দশকে ক্যাসেটের যুগে। এরপর শ্রোতা মাতিয়েছেন সিডির যুগেও। ইউটিউবের সিঙ্গেল ভিডিও গানের যুগেও সবুজ আঁখি আলমগীর। এই ডিজিটাল মিডিয়ার যুগেও কীভাবে নিজেকে এগিয়ে নিয়েছেন আঁখি আলমগীর? এমন প্রশ্নের উত্তরে এক সংবাদমাধ্যমকে আঁখি বলেন, ‘এই মাধ্যমটাকে আমি অবশ্যই পজিটিভলি দেখি। যেকোনো কিছুর সঙ্গে আপনি যদি নিজেকে আপডেট না রাখেন, তাহলে আপনি পিছিয়ে যাবেন। সেক্ষেত্রে আমি সবসময় নিজেকে আপডেট রাখি। এটা শুধু আমার কাজের ক্ষেত্রে নয়, আমার জীবন, আমার চিন্তাধারা, জীবনাচরণ সব কিছুতে আমি সবসময় আধুনিক মানুষ। আমি সবসময় নতুনকে স্বাগত জানাই। ক্যাসেট-সিডি সেগুলোর সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলেন, তাহলে বলব অবশ্যই আগের যুগ ভালো ছিল। কারণ, পরিপূর্ণভাবে একজন শিল্পীকে একটা অ্যালবামে পাওয়া যায়। একটা গানে পাওয়া যায় না, সেখানে তার একটা পার্ট পাওয়া যায়। একটা অ্যালবামে একজন শিল্পীর ১০-১২টি গানে অনেক বৈচিত্র্য ফুটে উঠত। ফলে একটি অ্যালবামেই শিল্পীকে পূর্ণাঙ্গভাবে খুঁজে পাওয়া যেত। যেমন ধরুন, ক্যাসেটের কাভারে যে ছবিটা থাকতো, সেটা আমরা খুব আয়োজন করে তুলতাম। ফটোশ্যুট করতাম, অনেক রকমের ড্রেস পরে ছবি তুলতাম। এরপর ১০০-১৫০ ছবির ভেতরে একটা ছবি নেওয়া হতো। সেটা আবার ঢাকাসহ সারাদেশে পোস্টারিং করা হতো। ব্যাপারটা খুবই সুন্দর ছিল। একটা অ্যালবাম তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকত অনেকেই। যারা অ্যালবামের কাভার ডিজাইন করত, তাদেরও একটা পেশা ছিল। কে কত ভালো করবে, কে কত সুন্দর করবে, আগের থেকে কতটা সুন্দর হবে, এবারের ড্রেসটা কি হবে, অ্যালবামের নামটা কি হবে। অনেক কিছু করার স্কোপ ছিল। আর এখন আপনি একজন শিল্পীর স্টিল ছবি ফেসবুকে দিয়ে যাচ্ছেন। এভরিথিং ইজ ইজি। সব কিছু এখন অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের এখন আর কোনো মাধ্যম নেই যে, আমরা একটা ক্যাসেট বের করব। এখন আমাদের একমাত্র রাস্তা ভার্চুয়ালি গান রিলিজ করা। ইউটিউবে গান রিলিজ করা। এছাড়া তো কোনো উপায় নেই।’

গানের ভিউ ও শিল্প মান

আগে গান শোনা হতো, এখন গান শোনা হচ্ছে দেখার মাধ্যমে। কোটি কোটি ভিউ হয় গানের ভিডিওতে। এ প্রসঙ্গে আঁখি আলমগীর বলেন, ‘ভিউ দিয়ে কিচ্ছু মাপা হয় না। এরপর আবার কখন কোন গান কি ভিউ হয় বা হচ্ছে কেউ জানে না। শিল্পী হিসেবে আমি বুঝতে পারছি না আসলে আমার গানটা কোথায় পৌঁছাচ্ছে। আমি ভিউ দেখতে পেলেও কারা আমার গান শুনছে বুঝতে পারছি না। আগে আমরা জানতাম, কোন এলাকায় আমার অ্যালবাম বেশি বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় কত হচ্ছে, ঢাকার বাইরে কত হচ্ছে। একটা পরিসংখ্যান হতো। আর এখন কোথায়, কোন ক্লাসে আমার গান বেশি পৌঁছাচ্ছে জানার সুযোগ নেই। মানে আমার শ্রোতা কে বা কারা তা আমি জানতে পারছি না। আমি বলব, আমি হচ্ছি, লাস্ট আর্টিস্ট অফ দ্যাট ইরা। ক্যাসেটের ওই যুগের সময়ের সাফল্য থেকে এই যুগের সাফল্য আমি দেখেছি। দুই মাধ্যমে আমি নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছি। ধরে রাখাটা খুব কঠিন ব্যাপার। আমার ক্ষেত্রে এটা ছিল দর্শকের ভালোবাসা আর আল্লাহর রহমত। আমাকে তো মানুষ ক্যাসেটের সময় থেকে চিনে। কাজেই আমাদের পরিচিতির ব্যাপকতাটা বেশি। অনেকের ভেতরে কপি করার প্রবণতা থাকে। কেউ কাউকে পছন্দ করে তার গায়কিটাকে কপি করতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারায়। অনেক সময় দেখা যায়, নিজেকেই হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় দেখা যায় মিক্সিংটা একই প্যাটার্নে হচ্ছে, একই রকম ভয়েস শোনা যায়।’

নতুন শিল্পীদের নিয়ে

নতুন শিল্পীদের কথা ভাবেন আঁখি। তিনি বলেন, ‘গানের ক্ষেত্রে অটো টিউন এখন একটা সিস্টেমের ভেতরে পড়ে গেছে। এখন অটো টিউনের কারণে যে কেউই গান গাইতে পারে। অবশ্য সেটা আলাদা ব্যাপার। এখন যারা গান করে, মোটামুটি যাদের নাম আমরা কমবেশি চিনি, তারা প্রত্যেকে অনেক ভালো গায়। এটা আমি বলার জন্য বলছি না। তারা আসলেই অনেক ভালো গায়। তবে নতুনদের জন্য আমার একটা বিষয় খারাপ লাগে। সেটা হচ্ছে তারা অ্যালবামের যুগ পায়নি। তারা যদি অ্যালবামের যুগটা পেত তাহলে তাদের কাজটাকে অনেক বেশি দেখাতে পারতো। কারণ, নিজেদের গান তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে না মাধ্যমের অভাবে। একটা গান দাঁড় করিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা অনেক কঠিন। একটা অ্যালবামের ১২টি গান থেকে একটা গান তখন ঠিকই হিট হয়ে যেত। তখন স্কোপটা ভালো ছিল এবং মাধ্যমটা অনেক বড় ছিল। মানুষও খুব বেশি গান শুনত। নতুনরা এখন খুবই ভালো গাইছে, কিন্তু তারা তাদের অ্যাকচুয়াল অ্যাবিলিটি হয়ত দেখাতে পারে না। কারণ, আগের মতো এত গানই তো হয় না এখন। বছরে দুইটি মৌলিক গান দিয়ে একজন শিল্পীকে মূল্যায়ন করতে পারবেন না। কাজেই বাধ্য হয়ে তাকে অন্য গান করতে হচ্ছে। তাকে কাভার সং করতে হচ্ছে।’

প্লেব্যাকে

প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও বেশ জনপ্রিয় আঁখি আলমগীর। অনেক চলচ্চিত্রের গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। তার প্লেব্যাক করা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে আছে বিদ্রোহী বধু, শুধু তুমি (১৯৯৪), কন্যাদান (১৯৯৫), নির্মম (১৯৯৬), সত্যের মৃত্যু নেই (১৯৯৬), টাইগার (১৯৯৭), মরণ কামড় (১৯৯৯), মা বাবা সন্তান (২০১৫), একটি সিনেমার গল্প (২০১৮) প্রভৃতি।

অভিনয়ে

গায়িকা আঁখি আলমগীরের পথচলা শুরু হয়েছিল অভিনয় শিল্পী হিসেবেই। সেই ছোট্টবেলাতেই অভিনয় দিয়ে সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। তবে গায়িকা হতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই বড় পর্দার জন্য গেয়েছেন কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে আর এগোননি। তবে ২০১৪ সালে অতিথি চরিত্রে তাকে দেখা যায় ‘এক কাপ চা’ সিনেমায়।

প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি

দেশের একমাত্র সঙ্গীতশিল্পী আঁখি আলমগীর যিনি গানে, অভিনয়ে দুই ক্যাটাগরিতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। আমজাদ হোসেনের ‘ভাত দে’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য তিনি অভিনয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন, আবার আলমগীর পরিচালিত ‘একটি সিনেমার গল্প’ সিনেমাতে অভিনয়ের জন্য তিনি গানে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। এছাড়াও বহু সংগঠন থেকে নানা সময়ে পুরস্কৃত হয়েছেন। দেশের বাইরে থেকেও তিনি আন্তর্জাতিক সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। কলকাতা থেকে তিনবার এবং দুবাই থেকে একবার গানের জন্য দেশের সম্মান বয়ে নিয়ে এসেছিলেন পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে।

শেষ কথা

আঁখি আলমগীর সাধারণত নিজের জন্মদিন পালন করেন ঘরোয়া আয়োজনের মধ্য দিয়ে। পরিবারের সদস্য আর সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে কেক কেটে জন্মদিন উদযাপন করেন তিনি। আঁখির প্রতিটি জন্মদিনই রঙিন কাটুক।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: শুভেচ্ছা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

17 − nine =