অলকানন্দা মালা
কিছু মানুষ আছেন, যারা প্রচারের আলোয় আসতে চান না। অন্তরালে থাকতে ভালোবাসেন। কিন্তু তাদের মেধার শক্তি এতটাই যে, পর্দার আড়াল থেকে বিচ্ছুরিত হয়ে আলোকোজ্জ্বল করে তোলেন সব কিছু। তেমন একজন মানুষ সঙ্গীত পরিচালক ইমন চৌধুরী। তার সুরে পাখিরা ডানা মেলে আকাশে। একাধারে তিনি কণ্ঠশিল্পী, যন্ত্রশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক।
সঙ্গীতের সঙ্গে সখ্যতা
সঙ্গীতের সঙ্গে ইমনের সখ্যতা পারিবারিক ভাবে। বাবা মতিউর রহমান চৌধুরী একজন সঙ্গীতশিল্পী। নরসিংদীর নজরুল একাডেমিরও ভার ছিল তার ওপর। প্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ তিনি। থিয়েটারের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। নাটকের সঙ্গীত বিভাগ দেখতেন। নির্দেশনাও দিতেন। এমন পরিবারের ছেলে ইমন সঙ্গীতের সঙ্গে বড় হবেন এটাই তো স্বাভাবিক। গানের হাতেখড়ি নিতেও যেতে হয়নি বাইরে। ইমনের কথায়, ‘যেহেতু সঙ্গীত পরিবারের সন্তান, ছোটবেলা থেকেই তাই সব ধরনের গান শোনা হতো। বাবা থিয়েটারও করতেন। নাটকের সঙ্গীত পরিচালক আর নির্দেশকও ছিলেন। হয়তো ওই ধরনের একটা পরিবেশে বেড়ে ওঠার কারণে নানা ধরনের সঙ্গীতে পারঙ্গমতা তৈরি হয়েছে। পেশাদার সঙ্গীতজীবন শুরুর পর সব সময় চাইতাম, চলচ্চিত্রের মিউজিক করব। হয়তোবা ওটা থেকেও শুরু। তা ছাড়া আমি যেহেতু ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের স্টুডেন্ট ছিলাম, এটাও অবচেতন মনে কাজ করেছে।’
বাবা যখন গুরু
বাবাকে গুরু মানেন ইমন। তার উপদেশ এখনও মেনে চলেন। সংবাদমাধ্যমকে এ নিয়ে বলেন, সব সময় একটা কথা বলেন আব্বু, “গুণকেই ঘুণে ধরে। গুণে যেন ঘুণ না ধরে সেই চেষ্টা করে যাবা।”
ব্যান্ড থেকে ব্র্যান্ড
চিরকুট ব্যান্ডে যোগ দেওয়ার আগে অন্য ব্যান্ডে বাজালেও নাম ছড়িয়েছে চিরকুটের মাধ্যমে। তেমনি তার গিটারের ঝংকারে ব্যান্ডটির গানগুলোও হয়েছে রঙিন। এর পরের গল্প তো সবার জানা। চিরকুট ব্যান্ডে ছিলেন ইমন। একসময় ব্যান্ডটির সঙ্গ ত্যাগ করেন তিনি। আমাদের দেশে ব্যান্ড সংস্কৃতিতে সাধারণত গানের কৃতিত্ব গায়ককে দেওয়া হয়। দলের অন্য সদস্যরা দিনশেষে অবহেলিত অপরিচিতই থেকে যান। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ইমন চৌধুরী। ব্যান্ডের গিটারিস্ট হিসেবে কাজ করলেও ম্লান হননি চিরকুটের দলনেতা ও গায়িকা শারমিন সুলতানা সুমির আলোয়। সুমির কণ্ঠ যেমন মুগ্ধতা ছড়িয়েছে তেমনই গিটারে ঝংকার তুলে ইমন নজর কেড়েছেন সঙ্গীতপ্রেমীদের। তাই চিরকুটের সঙ্গ ত্যাগ করেও হারিয়ে যাননি ইমন। বরং ব্যান্ড ত্যাগ করে নিজেই একটি ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। কেননা ব্যান্ড ছাড়তেই বেড়েছে কাজের ব্যস্ততা। চলচ্চিত্র নাটক বিজ্ঞাপন কোনোকিছুই ইমনের সঙ্গীত ছাড়া যেন পূর্ণতা পায় না। এ সময় চলচ্চিত্রে যেসব গান জনপ্রিয় হচ্ছে তার অধিকাংশই এ সঙ্গীত পরিচালকের। পাশাপাশি নিজেরও রয়েছে একটি গানের দল। তা নিয়ে ঘুরে বেড়ান দেশ বিদেশে। গান শুনিয়ে মুগ্ধ করেন শ্রোতাদের। সব মিলিয়ে বলা যায় ব্যান্ড ছেড়ে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়িয়েছেন ইমন চৌধুরী।
কোক স্টুডিওতে
দেশে কোক স্টুডিও বাংলা শুরু থেকেই সঙ্গীতপ্রেমীদের সন্তুষ্ট করে আসছে। লোকজ ও আধুনিক বিভিন্ন ধরনের এক্সপেরিমেন্টাল কাজ দিয়ে সব বয়সী শ্রোতাদের এক করছে তারা। এখানেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন ইমন চৌধুরী। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ‘সাদা সাদা কালা কালা’ খ্যাত গীতিকার হাসিম মাহমুদের গান ‘দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইও না’ গানটি। এর সঙ্গে ফিউশন করেছেন লোকজ গানের। গানটির মাধ্যমে তিনি নগরবাসীর সামনে উপস্থাপন করেছেন বাউল সম্রাজ্ঞী আলেয়াকে। যার সঙ্গে গলা মিলিয়েছেন আরফান মৃধা শিবলু। হাসিম মাহমুদের গানের সঙ্গে আঞ্চলিক গানের ফিউশন শ্রোতাদের তুমুল সমাদর পায়। সঙ্গে ইমনের সেতার বাজানো নতুন মাত্রা যোগ করে। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ প্রশংসিত হয় গানটি। বর্তমানে ইউটিউবে এটি দেখেছেন ছিয়াত্তর মিলিয়ন দর্শক।
সিনেমার গানে
ইমন চৌধুরীর ব্যস্ততার বেশিরভাগ জায়গা জুড়ে চলচ্চিত্র। আজকাল সিনেমার যেসব গান শ্রোতাদের মন দখল করছে দেখা যায় তার বড় একটি অংশের সুরকার ও পরিচালক ইমন। শুরুটা হয় ২০১৯ সালে ‘মায়া দ্য লাস্ট মাদার’ সিনেমার মাধ্যমে। ‘মায়ারে’ ও ‘দুই কোলে’ শিরোনামের গান দুটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। একই বছর ‘কাঠবিড়ালী’ সিনেমার গানেও সঙ্গীতের দায়িত্ব পান তিনি। ২০২২ সালে যেন আরও জাঁকিয়ে বসেন ইন্ডাস্ট্রিতে। সে বছরের সবচেয়ে প্রশংসিত ও শ্রোতাপ্রিয় গান হাওয়া সিনেমার ‘সাদা সাদা কালা কালা’, ‘আটটা বাজে দেরি করিস না’ ও ‘পরাণের ধীরে ধীরে’ গানগুলো ছিল ইমন চৌধুরীর সুর ও সঙ্গীতে। এছাড়া ‘গুনিন’ সিনেমার ‘ঘোমটা তুলে বদন খুলে’সহ আরও বেশ কিছু গানের স্রষ্টা ছিলেন তিনি। গত বছর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘কাজল রেখা’ সিনেমা ছিল ইমনের সুরসঙ্গীতে ভরপুর। সঙ্গীতভিত্তিক এই সিনেমাটির সবগুলো গানই তার করা। ময়মনসিংহ গীতিকার গানগুলো নাগরিক জীবনেও ছড়িয়েছে মেঠো পথের ঘ্রাণ ও প্রকৃতির সৌরভ। এছাড়া ‘রাজকুমার’সহ একাধিক সিনেমায় তার গান ছিল। এ বছর মুক্তি প্রতীক্ষিত ‘ঠিকানা বাংলাদেশ’ সিনেমাতেও থাকবে তার গান। এছাড়া ‘রাতজাগা ফুল’, ‘মুখোশ’, ‘অ্যাডভেঞ্চার সুন্দরবন’সহ অনেক সিনেমায় কাজ করেছেন তিনি।
কণ্ঠশিল্পী
কয়েক বছর আগে ‘আবার তোরা মানুষ হ’ নাটকের গান বেশ সুনাম অর্জন করেছিল। ‘আমার প্রাণ ধরিয়া মারো টান’ শিরোনামের সেই গানটি দিয়েই গায়ক হিসেবে শ্রোতাদের মন জয় করেছিলেন ইমন। অতনু তিয়াসের লেখা গানটি দিয়েই জানিয়েছিলেন শুধু গিটার কিংবা সেতারে নয় তার কণ্ঠেও রয়েছে জাদু।
রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
শ্রোতাদের মন জয় করেছেন ইমন চৌধুরী। সঙ্গীতাঙ্গনে তার নামটি সমীহ করেই উচ্চারণ করেন সমসাময়িক সঙ্গীত পরিচালকরা। তার সৃষ্টি শ্রোতাদের পাশাপাশি ছুঁয়ে গেছে বোদ্ধাদের। ফলে সঙ্গীতপ্রেমীদের ভালবাসার পাশাপাশি পেয়েছেন পুরস্কার। এর মধ্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ২০২০ সালে। ‘মায়া দ্য লাস্ট মাদার’ সিনেমায় শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে পুরস্কার পান তিনি।
হেলাল হাফিজের কবিতা
ইমনের সুরে উঠে আসে মাটির গন্ধ। শেকড় আবেদন ছড়ায়। তাই বলে একই গণ্ডিতে বাঁধা না তিনি। আছে সাহিত্যযোগও। গীতিকবিতায় সুর করার পাশাপাশি কবিতায় সুর করেছেন তিনি। সদ্যপ্রয়াত কবি হেলাল হাফিজের বিখ্যাত কবিতা ‘পত্র দিও’ পরিণত করে করেছেন গানে। সে সময় হেলাল হাফিজ বেঁচে ছিলেন। একদিন কবিতাটি পড়তে গিয়ে ইমন আবিষ্কার করেন সেখানে সুর কথা বলছে। ওই তাড়না থেকেই সুর বসান। সঙ্গে যোগ হয় তানজির তুহিনের কণ্ঠ। কবির প্রয়াণের পর মোবাইলে ধারণ করা গানটির একটি ভিডিওচিত্র নিজের ফেসবুকে প্রকাশ করেন ইমন চৌধুরী। সেই সঙ্গে ভাগ করেন কবির কথাও। হেলাল হাফিজের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে এই গানটি করেছিলেন তিনি। কিন্তু শোনানো হয়নি। কেননা গান যখন শেষ তখন কবি হাসপাতালে মুমূর্ষু। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেই তার সঙ্গে দেখা করার। হাসপাতালে কেউ গানটি শুনিয়েছিলেন কবিকে। শুধু সন্তুষ্টই হননি হেলাল হাফিজ। নিজের ফেসবুকে শেয়ার করে প্রশংসাও করেন ইমনের। ইমন চৌধুরী বলেন, ‘এটা আসলে কবির প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। তার কবিতার সঙ্গে পত্র দিও গানটি শেয়ার করছেন, এটা আমাদের জন্য সম্মানের। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ করেছিলাম গানটি। এ বছর ডিসেম্বরে কবি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তার মতো গুণীর চলে যাওয়া দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’
মাটির সুরের কারিগর
শহরে বসে শুধু মাটির সুরই তোলেন না ইমন চৌধুরী। বরং সেগুলো সাজাতে শেকড় থেকেই কারিগর নিয়ে আসেন। কোক স্টুডিও বাংলাসহ ইমনের বিভিন্ন গানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাজিয়ে নিয়ে আসা হয়। তাদের মেধা নিজের সুরসঙ্গীতে যুক্ত করে গান তৈরি করেন তিনি। নিজেও একাধিক বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারেন। গিটারিস্ট হিসেবে নাম করলেও সেতার, সারেঙ্গি, গিটার, ম্যান্ডেলিন সবগুলোই বাজাতে স্বাচ্ছদ্য বোধ করেন।
লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: সুরের মূর্চ্ছনা