জ্বালানি  উপদেষ্টাকে সরকারের কৌশল আরো সুনির্দিষ্ট করতে হবে

সালেক সুফী

বাংলাদেশ কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকটের মোকাবিলা করছে। সঙ্কটগুলো কিন্তু দীর্ঘদিনের ভুল কৌশল, দুরভিসন্দিমূলক কার্ক্রমের পরিণতি। রাতারাতি পাল্টানো যাবে না। জ্বালানি উপদেষ্টা বিভিন্ন সংস্থা এবং গোষ্ঠীর অনুষ্ঠানে যোগদান করে নানা আশার বাণী শুনেছেন। অনেক কথায় পূর্বসূরিদের কথার প্রতিধ্বনি।

এই যেমন কাল বললেন গ্রীষ্মকালীন বিশেষত রোজার মাসের বাড়তি গ্যাস চাহিদা মেটানোর জন্য অতিরিক্ত ৪ কার্গো এলএনজি আমদানি করছে সরকার। এই আমদানির কারণে কিন্তু জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহ বাড়বে না।

এলএনজি এভাকুয়েশনের জন্য দুটি ভাসমান টার্মিনালের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কোন পরিবর্তন হবে না। গ্যাস সরবরাহ চেনে সর্বোচ্চ ২৭০০ মিলিয়ন ঘনফুটের অধিক গ্যাস সরবরাহ হবে না। এই গ্যাসের ৪২% গ্রিড সংযুক্ত বিদ্যুৎ এবং ১৮% ক্যাপটিভ বিদ্যুতে বরাদ্দ করার কথা। কিন্তু বাস্তবে দুটির কোনটিই সম্ভব হচ্ছে না।

আর তাই একদিকে যেমন বিপুল পরিমাণ রিজার্ভ মার্জিন নিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জের বিড়ম্বনায় পড়েছে পিডিবি , অন্যদিকে শিল্পগুলোর নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদন দারুন সঙ্কটে। শিল্পের বরাদ্দ থাকার কথা ১৯%। সেখানে বর্তমানে ১০% বরাদ্দ পাচ্ছে না শিল্পগুলো।

মিডিয়া প্রতিবেদনে প্রকাশ ২০০ ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। শিপ্ল কারখানার উৎপাদন ৩০-৫০% হ্রাস পেয়েছে। বিপুল সংখ্যক শ্রমিক বেকার হয়ে গাছে। অবিলম্বে আরো অনেক শ্রমিক চাকুরি হারাবে। বেকারত্ব বেড়ে গেলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়বে।

সব শিল্প বেক্সিমকো বা এস আলম গ্রুপের মত ব্যাঙ্ক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান লুটপাট করে সম্পদের পাহাড় বিদেশে পাচার করেনি। সৎ ব্যবসায়ীদের বাঁচানোর জন্য জ্বালানি উপদেষ্টাকে কিছু বাস্তবধর্মী উদ্যোগ নিতেই হবে।

দেখা যায় গ্যাস ফ্রাঞ্চাইজি এলাকায় রান্নার জন্য ১১% গ্যাস বরাদ্দ আছে। দেশের হয়তো ১০% মানুষ পাইপ লাইন গ্যাসের সুবিধা পেয়ে থাকে। অধিকাংশ গ্রাহকের মিটার নেই। গ্যাস বিতরণ ব্যবস্থায় অনেক অবৈধ সংযোগ আছে, অনেক পুরাতন লাইন থেকে গ্যাস লিকেজ হচ্ছে।

একটি বেসরকারি প্রতিস্থান সিডিএম এবং ভেড়া প্রকল্পের আওতায় কিছু ডোমেস্টিক রাইজার মেরামত এবং সংরক্ষণ করে ৪৮-৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সংরক্ষণ করেছে। অনেকের ধারণা গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্কে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে ছিন্ন ভিন্ন বিতরণ লাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ এবং চিরুনি অভিযান চালিয়ে চুরি বন্ধ করা হলে ১৫০-২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয় করা সম্ভব।

অভিযোগ আছে কিছু অসাধু শিল্পগ্রাহক গ্যাস কোম্পানিগুলোর অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সিন্ডিকেট করেও গ্যাস চুরি করে।  গ্যাস চোরদের বিরুদ্ধে অপারেশন ডেভিল হান্টের মত অভিযান চালানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

রাজধানীতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি জ্বালানি ওয়ার্কশপে মাননীয় উপদেষ্টা বলেছেন ‘কোনো আইপিপি হবে না, কোনো বিনিয়োগকারীর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তিতে আইএ থাকবে না’।

সত্যি বলতে কি বিগত সরকার আইপিপির যথেচ্ছ ব্যবহার করে সংকট সৃষ্টি করলেও ১৯৯০ দশকের উপমাধর্মী আইপিপি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খোল নলচে পাল্টে দিয়েছে। বাংলাদেশের সফল আইপিপি মডেল বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়েছে।

আর বাংলাদেশের মত দেশে বিনিয়োগকারীদের জ্বালানি বিদ্যুৎ অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ ঝুঁকি নেওয়ার জন্য ইমপ্লেটেনশন এগ্রিমেন্ট (আইএ ) বিকল্পহীন।  উপদেষ্টাকে বিষয়গুলো নিয়ে আরো ভাবতে হবে।

প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেছিলেন কৃচ্ছতা হিসেবে বাংলাদেশে শপিং মলগুলোর ব্যাবসা সময় সংকোচন সম্ভব না। রান্নার গ্যাস ব্যবহার বন্ধ করাও যাবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিন্তু রাজনৈতিক অভিলাষ নেই। তাই এই সরকারকেই কিন্তু অজনপ্রিয় অথচ বাস্তবসম্মত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদার সিংহভাগ লাইটিং এবং কুলিং লোড। পিক সময় সন্ধ্যা ৬-১০ পর্যন্ত বিপণী বিতানগুলো খোলা থাকলে এবং বিপুল আলোকসজ্জা করলে কোনো ভাবেই রমজান মাস এবং গ্রীষ্মকালে বিদ্যুৎ লোড শেডিং এড়ানো যাবে না।

দোকান মালিকদের কাছে সংযমী হওয়ার অনুরোধ কাজে লাগবে না। কেন রবি  থেকে বৃহস্পতি সন্ধ্যা ৭-১০ দোকানপাট জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে বন্ধ রাখা যাবে না? শুক্রবার শনিবার ছুটির দিনগুলোতে অসুবিধা নেই। এছাড়া রোজার সময় প্রাথমিক, মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ছুটি দেওয়া হলে বিদ্যুৎ ব্যবহার এবং সড়কে যানজট অনেক কমবে।

জ্বালানি সংকটের কারণে বিকল্প আছে এমন ব্যবহার যেমন রান্না, সিএনজি, শিল্পে গ্যাসভিত্তিক ক্যাপটিভ জেনারেশন নিয়ে বিকল্প কিছু করতেই হবে। যে কোনোভাবে গ্যাস-বিদ্যুৎ চুরি সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আন্তে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাড়তি প্রণোদনা দিতে হবে।

জানিনা বর্তমান সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানি সংকটের গভীরতা এবং বহুমুখিতা উপলব্ধি করতে পেরেছে কিনা। কিছু ব্যতিক্রমধর্মী সিদ্ধান্ত নিতে গড়িমসি করলে সরকার জ্বালানি বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলা করতে পারবে না। বিড়ম্বনা সৃষ্টি হবে। দেশজুড়ে অস্থিরতা এবংঅরাজকতা  সৃষ্টি হবে।

জ্বালানি উপদেষ্টাকে আরো জনঘনিষ্ট কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

5 × 4 =