শত সংস্কারের মাঝে উপেক্ষিত জ্বালানি সেক্টর সংস্কার

জুলাই আগস্ট রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর থেকেই নোবেল লরিয়েট ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। জাতীয় এবং সমাজ জীবনের বিবিধ বিষয়ে সংস্কার করার জন্য সরকার দেশের এবং প্রবাসের বিষয় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রণীত সুপারিশসমূহ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমত সৃষ্টির চেষ্টা করছেন। জাতীয় নির্বাচনের আগে হয়তো সংস্কারগুলোর বিষয়ে একটি চার্টার প্রণীত হবে। দীর্ঘস্থায়ী জ্বালানি নিরাপত্তা বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের পূর্বশর্ত। সবাই জানে ভুল পরিকল্পনা, ভ্রান্ত কৌশল এবং সীমাহীন দুর্নীতির কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা এখন নাজুক। দেশের শিল্প উন্নয়ন, বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত। জ্বালানির সংকটে অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হওয়ায় বেকার সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর সংস্কারের কোন কার্ক্রম সরকার কিন্তু গ্রহণ করেনি। ৯ মাস অতিবাহিত হলেও জ্বালানি বিদ্যুৎ সেক্টর পরিকল্পনা বা ব্যাবস্থাপনায় কোনো মৌলিক সংস্কার গৃহীত হয়নি। এখন কাজ শুরু হলেও সরকারের অবশিষ্ট সময়ে কিছু বাস্তবায়ন হবে বলে মনে হয় না।

কিছু কাজ করেছে সরকার। দ্রুত বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি সরবরাহ বিশেষ আইন ২০১০ বাতিল, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন এ্যাক্ট সংশোধনী বাতিল, জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের বিপুল বকেয়া পরিশোধ প্রশংসনীয় উদ্যোগ।

কিন্তু বিরাজমান পরিস্থিতি সবার জানা। ৩১,০০০ মেগাওয়াট (গ্রিড, অফ গ্রিড) বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা নিয়েও ১৬,০০০ মেগাওয়াট জাতীয় চাহিদা মেটানো যাচ্ছে না। মূল সংকট প্রাথমিক জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা। মূলত গ্যাস নির্ভর জ্বালানি খাতের প্রধান সমস্যা গ্যাসের প্রমাণিত সঞ্চয় দ্রুত নিঃশেষ হতে থাকা। দেশে এখন গ্যাস চাহিদা ৪,২০০-৪,৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট।  অথচ নিজেদের গ্যাস এবং আমদানিকৃত এলএনজি সহ বর্তমান সরবরাহ ক্ষমতা ২,৭০০-২,৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট। দেশে মাটির নিচে পড়ে আছে বিপুল পরিমান উন্নত মানের কয়লা সম্পদ, ভূমিতে ২/৩ এলাকায় গ্যাস অনুসন্ধান হয়নি, সাগরে আছে গ্যাস তেল প্রাপ্তির বিপুল সম্ভাবনা। গ্যাস নির্ভর জ্বালানি সেক্টর মুখ থুবড়ে পড়ছে। ভুল পরিকল্পনা এবং দুর্নীতি দুষ্ট বাস্তবায়ন কৌশলের কারণে দেখা দিয়েছে গভীর অনিশ্চয়তা। ক্রমাগত আমদানী নির্ভর জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে চরম আর্থিক সঙ্কটে। শিল্প কারখানার মালিকরা হাহাকার করছে। আমলা প্রভাবিত জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে সুশাসনের অভাব।

আশা ছিল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জ্বালানি বিদ্যুৎ খাত সংস্কারে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। নিজস্ব জ্বালানি কয়লা উত্তোলনে উদ্যোগ নিবে, গ্যাস তেল অনুসন্ধানে বাস্তব সম্মত কার্যকরী কার্যক্রম গ্রহণ করবে, জ্বালানি বিদ্যুৎ ক্ষেত্র প্রশাসনকে পেশাজীবী নির্ভর করে গতিশীল এবং জবাবদিহি মূলক করবে। কাজের কাজ হয়েছে অতি সামান্য। কয়লা উত্তোলন আদৌ হবে কিনা নিশ্চিত নয়। গ্যাস অনুসন্ধান এবং উন্নয়ন কাজ চলছে গতানুগতিক ধারায়। মনে হয় না ২০৩০ নাগাদ বাংলাদেশ কাঙ্খিত জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করতে পারবে।

নিদৃস্ট সময়ের মধ্যে পেট্রোবাংলার উচ্চাবিলাসী ৫০ এবং ১০০ গ্যাস কূপ খনন পরিকল্পনা সফল হবে না অনেকটা নিশ্চিত করেই বলা যায়। বিকল্প হিসাবে এলএনজি আমদানিতেও সহসা নতুন সংযোজন অনিশ্চিত। আছে নানা চ্যালেঞ্জ। সরকার ৯ মাসেও ভোলার গ্যাস জাতীয় গ্রীডে সংযুক্তির নিশ্চিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনি। জাতীয় গ্যাস গ্রীডে ভোলার গ্যাস সংযোজন করতে হলে ইন্টেগ্রেটেড গ্রিড এনালাইসিস জরুরি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গ্যাস/এলএনজি গ্রীডে সঞ্চালিত করতে হলে কোথাও কোথাও কম্প্রেসসর স্থাপন করতে হবে, দেশ ব্যাপী গ্যাস সরবরাহের একটি নির্ভরযোগ্য মাস্টার প্ল্যান করতে হবে, গ্যাস ব্যবহার নীতিমালা করতে হবে। সর্বোপরি গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর ডিপ্লিশন প্ল্যান না থাকলে বিবিয়ানার মত একক বা কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্র নির্ভর হয়ে পড়তে হবে। খুলনা বরিশাল অঞ্চলে ভোলার গ্যাস সরবরাহ করে ব্যাপক শিল্পায়নের সম্ভাবনা আছে। ভোলা এবং তথসংলগ্ন এলাকায় বিপুল গ্যাস সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ১৯৯৭ সালের দিকে মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল নিজেদের বিনিয়োগ এবং ঝুঁকিতে ওয়েস্টার্ন রিজিওন ইন্টেগ্রেটেড প্রজেক্ট বাস্তবায়নের প্রস্তাব দিয়েছিলো। ভেবে দেখুন এখন পলিসি মেকার্সরা ভোলার গ্যাস সম্পদকে বিবিয়ানার বিকল্প ভাবছে। অথচ অগ্রবর্তী থাকা রিপ তখন অনুমোদন করা হয়নি। পেশাদারি দক্ষতার অভাবে ভোলার গ্যাস তীব্র গ্যাস সংকটের সময় কাজে লাগছে না।

দীর্ঘ সময় দিবা নিদ্রায় কাটানো পেট্রোবাংলার জন্য ৫০ এবং ১০০ কূপ খনন বাংলাদেশের বাস্তবতায় আকাশ কুসুম কল্পনা বলাই বাহুল্য। তবে প্রশ্ন জাগে কেন পার্বত্য চট্টগ্রম এলাকার সম্ভাব্য অবকাঠামো গুলোতে ২০ বছরের বেশি সময়েও উন্নয়নের উদ্যোগ নেয়া হলো না? কেন যথাযথ উদ্যোগ নিয়ে ছাতক, টেংরাটিলায় অনুসন্ধানের সমস্যা মেটানো হলো না? কেন সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান নিয়ে হেলা ফেলা করা হলো ? শুনছি এখন বাপেক্স নিজস্ব ৫ টি রিগ এবং ঠিকাদারদের ৫ টি রিগ ব্যবহার করে দ্রুত অনুসন্ধান করবে। এর মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার টাইট স্ট্রাকচার এবং কয়েকটি গ্যাস ক্ষেত্রের গভীর এলাকায় খনন জরুরি। পেট্রোবাংলা /বাপেক্সের দক্ষতা থাকলেও এই মাত্রার খনন কার্যক্রম ব্যাবস্থাপনায় বিশাল ঝুঁকি আছে।

দেশে কর্মরত বিশ্বের অন্যতম সেরা কোম্পানি শেভ্রন ১২, ১৩, ১৪ ব্লকে তাদের ছেড়ে দেয়া এলাকায় পুনরায় গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব দিয়েছে। অতীত তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে এমনিতেই বিশ্ব সেরা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আসতে আগ্রহী না। এমতাবস্তায় দেশের স্বার্থে শেভরনে সঙ্গে দর কষাকষি করে দ্রুত চুক্তি করা প্রাসঙ্গিক হবে।

সরকার পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সামিটের সঙ্গে তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল চুক্তি তাড়াহুড়ো করে বাতিল করা সুবিবেচনা প্রসূত হয়নি। এর ফলে নতুন ভাসমান টার্মিনাল স্থাপন অন্তত ২ বছর পিছিয়ে গাছে। জ্বালানি ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীরা ভুল সংকেত পেয়েছে। যার প্রমান সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য পিএসসি বিডিং রাউন্ডে কোন সাড়া না পাওয়া। সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানের পুরো বিষয়টি লেজে গোবরে করে ফেলেছে পেট্রোবাংলা।

বাংলাদেশের জন্য ২০২৫-২০৩০ কঠিন সময়। এই সময়ে নিজেদের গ্যাস উৎপাদন দ্রুত কমতেই থাকবে। নিজেদের অনুসন্ধান থেকে সীমিত সাফল্য আসলেও ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে না। জানিনা কতটা নিরাপদে পেট্রোবাংলা /বাপেক্স ঝুঁকিপূর্ণ খনন কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে। বিদ্যমান অবস্থায় ভোলার গ্যাস গ্রিড সংযুক্ত করতে ৪ বছর লাগবে। ২০২৯র আগে নতুন এলএনজি আমদানি করার সুযোগ থাকবে না। পেট্রোবাংলা / জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ৪,০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস /এলএনজি ক্ষমতা অর্জন করতে হলে জ্বালানি সেক্টরকে পেশাধারী ধারায় পুনঃবিন্যস্ত করতে হবে। গ্যাস ব্যাবহারে অনেক দক্ষ এবং বিচক্ষণ হতে হবে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

ten + five =