দশম দিনে কপের ৩০ এর আলোচনা: ধীর অগ্রগতি, মন্ত্রী পর্যায়ের তীব্র আলোচনায় উত্তেজনা, এবং ‘বেলেম প্যাকেজ’ নিয়ে সংকোচনশীল পথে নেগোসিয়েশন

আফরোজা আখতার পারভীন, ঢাকা

ব্রাজিলের বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ৩০-এর দশম দিনটি ছিল প্রযুক্তিগত আলোচনার সীমা ছাড়িয়ে উচ্চ-স্তরের রাজনৈতিক দর-কষাকষির দিনে পরিণত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। ৭০টিরও বেশি দেশের মন্ত্রীরা বন্ধ দরজার বৈঠকে বসেন, যখন কপ৩০ প্রেসিডেন্সি “বেলেম প্যাকেজ” চূড়ান্ত করার উদ্দেশ্যে আলোচনাকে নতুন গতি দেয় — যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানি ট্রানজিশন, অর্থায়ন, বন রক্ষা, অভিযোজন, এবং কার্বন বাজারের মতো মূল ফাইল অন্তর্ভুক্ত। কিছু খসড়া পাঠে সীমিত অগ্রগতি দেখা গেলেও, জীবাশ্ম জ্বালানির ধাপে ধাপে পরিত্যাগ এবং ২০৩০ সালের পরের জলবায়ু অর্থায়ন নিয়ে গভীর বিভাজন থেকেই গেছে।

১. দিনের আলোচনার ফলাফল: মাঝারি অগ্রগতি, স্পষ্ট মতবিরোধ

১.১ জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে অগ্রগতি হলেও চূড়ান্ত ঐক্যমত্য নেই

দশম দিনে প্রেসিডেন্সি নতুন ভাষা প্রস্তাব করে, যার মধ্যে ছিল—

  • “সমস্ত জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণের” আহ্বান
  • জ্বালানি ব্যবস্থার ডিকার্বনাইজেশনের জন্য “মধ্য-শতাব্দী উচ্চাকাঙ্ক্ষা চক্র”
  • কয়লা পরিত্যাগ নিয়ে তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী কিন্তু বাধ্যতামূলক নয় এমন রেফারেন্স
  • নবায়নযোগ্য শক্তি ও জ্বালানি দক্ষতায় বৈশ্বিক লক্ষ্য

উচ্চ-উদ্যমী দেশগুলোর জোট স্পষ্ট ও সময়সীমাবদ্ধ ফসিল ফুয়েল সম্পূর্ণ ফেজ-আউট দাবি করলেও, তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো “জাতীয় জ্বালানি কৌশলে হস্তক্ষেপ” হিসেবে উল্লেখ করে কঠোর ভাষা প্রত্যাখ্যান করে। ফলে মূল অংশগুলো এখনও ব্র্যাকেটে রয়ে গেছে।

১.২ জলবায়ু অর্থায়ন: বিতর্ক থেকে বেরোতে পারেনি

অর্থায়ন আবারও সবচেয়ে রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর ইস্যু হয়ে ওঠে। বড় মতপার্থক্য গুলো ছিল—

  • ২০৩০-পরবর্তী অর্থায়নের স্কেল ও সময়রেখা
  • বাধ্যতামূলক না স্বেচ্ছাসেবী অবদান
  • উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে ‘দাতা দেশ’ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে কি না
  • লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের পরিচালন কাঠামো

চলমান আলোচনায় কোনো নাটকীয় অগ্রগতি হয়নি, যদিও সম্ভাব্য অর্থায়ন পথ বিশ্লেষণে নতুন কর্মধারা নিয়ে দেশগুলো ঐক্যমতে পৌঁছায়।

১.৩ অভিযোজন (GGA) নিয়ে সীমিত অগ্রগতি

দেশগুলো আলোচনার মাধ্যমে—

  • জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামোর সূচক
  • জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনার সমর্থন
  • বৈশ্বিক স্টকটেকের সাথে সংযুক্ত পর্যবেক্ষণ কাঠামো

—নিয়ে একমত হলেও পরিমাণগত লক্ষ্য নির্ধারণে মতবিরোধ রয়ে গেছে।

১.৪ ক্রিটিক্যাল মিনারেলস নিয়ে উত্তেজনা বাড়ছে

প্রথমবারের মতো কপ-এর পাঠে “পরিষ্কার জ্বালানি রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্রিটিক্যাল মিনারেল” অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

কিছু দেশ বলেছে এটি অযৌক্তিকভাবে খনিজ সমৃদ্ধ দেশগুলোকে সুবিধা দেয়; অন্যদিকে কিছু দেশ মনে করে এটি নবায়নযোগ্য জ্বালানি সম্প্রসারণে অপরিহার্য। ফলে এই অধ্যায়টি অত্যন্ত ব্র্যাকেটেড রয়ে গেছে।

২. বেলেম প্যাকেজ: একটি ঐক্যমত্য খুঁজতে প্রেসিডেন্সির প্রচেষ্টা

বর্তমানে আলোচনাধীন বেলেম প্যাকেজ-এ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে—

  • জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ-আউট নিয়ে রাজনৈতিক ঘোষণাপত্র
  • ২০৩০-পরবর্তী অর্থায়নের একটি বাস্তবায়ন রোডম্যাপ
  • অ্যামাজন বন রক্ষার জন্য একটি নবায়ন উদ্যোগ
  • শক্তিশালী অভিযোজন ব্যবস্থা
  • কার্বন মার্কেট নির্দেশনা ও সুরক্ষা ব্যবস্থা
  • জাস্ট ট্রানজিশনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ধারা

প্রেসিডেন্সি বলেছে এটি “উচ্চাকাঙ্ক্ষী কিন্তু বাস্তবসম্মত” প্যাকেজ উপস্থাপন করতে চাইছে, তবে অনেক দেশ মনে করছে পাঠটি এখনও “অসামঞ্জস্যপূর্ণ” এবং “চূড়ান্ত করার জন্য আরও রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়োজন।”

৩. COP30 প্রেসিডেন্সির ব্রিফিং: আপসের আহ্বান

ব্রিফিং-এ কপ প্রেসিডেন্সি জানায়:“আমরা এখন সিদ্ধান্তমূলক রাজনৈতিক পর্যায়ে প্রবেশ করেছি। কেউ সব পাবে না, কিন্তু সবাই একটি সমন্বিত ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী বেলেম প্যাকেজ থেকে কিছু না কিছু লাভ পেতে পারে।”

মূল বার্তাগুলো ছিল—

  • মন্ত্রীদের রাতভর বৈঠক চলবে
  • বেলেম প্যাকেজের নতুন সংস্করণ প্রকাশ হবে ১১তম দিনে
  • টেক্সটে পক্ষপাতের অভিযোগকে প্রত্যাখ্যান করে প্রেসিডেন্সি জানায় এটি সবার দাখিলকৃত মতামত প্রতিফলিত করে
  • প্রেসিডেন্সি পুনর্ব্যক্ত করে যে জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তরণ ও অর্থায়ন—দুইটিই কাঙ্ক্ষিত ফলাফলের স্তম্ভ পর্যবেক্ষকদের মতে, প্রেসিডেন্সি আজ আরও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে।

৪. সিভিল সোসাইটি ও আদিবাসী গোষ্ঠীর চাপ আরও বৃদ্ধি

দিবসজুড়ে তারা দাবি তোলে—

  • স্পষ্ট ও সময়সীমাবদ্ধ জীবাশ্ম জ্বালানি ফেজ-আউট
  • অতিরিক্ত, পূর্বানুমেয় জলবায়ু অর্থায়ন
  • আদিবাসী ভূমির সুরক্ষা
  • পরিবেশগত ন্যায়বিচার-ভিত্তিক শক্তি রূপান্তর

আদিবাসী নেতারা বলেন অ্যামাজন “কোনো দর-কষাকষির বস্তু নয়। যুব ও এনজিওরা সতর্কবার্তা দেয় যে দুর্বল বেলেম প্যাকেজ বৈশ্বিক জলবায়ু শাসনব্যবস্থার উপর আস্থা নষ্ট করবে।

৫. সামগ্রিক পরিবেশ ও আগামী দিনের প্রত্যাশা

আলোচনার মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকায় উত্তেজনা তীব্র। কূটনীতিকরা দিনটিকে “টার্নিং পয়েন্ট” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

আগামী দিনের মূল নজরদারি পয়েন্ট—

১. ফেজ-আউট ভাষা কি আরও শক্তিশালী হবে?

২. অর্থায়ন নিয়ে কোন বাস্তবসম্মত আপস সম্ভব হবে?

৩. ক্রিটিক্যাল মিনারেলস কি টেক্স থেকে যাবে?

৪. সময়মতো বেলেম প্যাকেজ চূড়ান্ত করা যাবে কি

কপ৩০-এর দশম দিনটি সীমিত অগ্রগতি দেখালেও রাজনৈতিক ভঙ্গুরতা স্পষ্ট করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি উত্তরণ ও অর্থায়ন নিয়ে বড় মতপার্থক্য থাকায় আগামী কয়েকদিনই নির্ধারণ করবে কপ৩০ তার কাঙ্ক্ষিত বেলেম প্যাকেজ দিতে পারবে কিনা। এখন প্রেসিডেন্সির সবচেয়ে বড় পরীক্ষা—একটি বিভক্ত টেক্সটকে ঐক্যমতপূর্ণ, কার্যকর জলবায়ু কর্মপথে রূপান্তর করা।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

6 + five =