সালেক সুফী: বিশেষ কারণে বাঁচার তাগিদে দেশ ছাড়তে হয়েছে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। অস্ট্রেলিয়ায় ১৭ বছর থাকলেও দুটি ঈদ করেছি আফগানিস্তানের কাবুলে। শুধু একবার কোরবানির ঈদের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সফরের সময় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঈদ করেছি ঢাকায়। এছাড়া এবার নিয়ে ১৭ বছরের ৩৩ ঈদের ৩২টি করতে হচ্ছে পরবাসে প্রবাসে।
ছেলে বেলা থেকেই আমি একটু মিশুক প্রকৃতির এবং বলতে দ্বিধা নেই একটু ভোজনপ্রিয়। ৭০ ছুই বয়সেও উপাদেয় খাবারের জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকি। আর ঈদ প্রতিবারই আমার জীবনে আসে আনন্দের বার্তা নিয়ে। যদিও ১৯৭১ সালের দুই ঈদ কেটেছিল অনেক উৎকণ্ঠায়।
মায়ের যত্নে ৭ বছর বয়স থেকেই নিয়মিত রোজা রাখতাম। নিয়মিত নামাজ সহ তারাবির নামাজ পড়েছি। ফরিদপুরে তারুণ্যে রোজার ঈদ অনেক উপভোগ করতাম। পড়শিদের ঘরে ঘরে ইফতার দাওয়াত থাকতো। ঈদের চাঁদ দেখে খেলার স্থায়ী বন্ধুদের নিয়ে মুরুব্বিদের সালাম করে সালামি নিতাম। দোল বেঁধে ঈদগাহে যেতাম।
মনে আছে মা পোলাও, কোর্মা, মুরগির রোস্ট, খাসির মাংসের রেজালা, কাবাব রান্না করতেন। ফিরনি পায়েস ছিল। মায়ের সাথে শেষ ঈদ করার সুযোগ ছিল ১৯৯৪। কিন্তু বিজিএসেলে জরুরি কাজে ব্যস্ত থাকায় যাওয়া হয়নি। রোজার ঈদের কিছু দিন পর মা মারা গেলেন।
ঢাকায় ঈদ করেছি কয়েকবার বড় বোন, ছোট বোনের বাসায়। আর বাকি সময় শশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জামাই আদরে। অবশ্য অধিকাংশ সময় আমাদের গ্যাস কোম্পানির জরুরি কাজগুলো ঈদের সময় করতে হতো। ২০০৩ কোরবানির ঈদ কাটিয়েছি বংগোপোসাগৰে সাঙ্গু গ্যাস ক্ষেত্র থেকে চট্টগ্রাম উপকূলে নির্মিত পাইপ লাইন সংস্কার কাজে। ওই কাজে সংযুক্ত ১২টি দেশের মুসলিমদের নিয়ে হেলি ডেকে নামাজ পড়েছি। বিশেষ আয়োজনে উপাদেয় খাবার ব্যবস্থা ছিল।
এবার আসুন পরবাসে ঈদ। ২০০৬ প্রথম ঈদের সময় মেলবোর্ন আমি আর ছোট ছেলে অভ্র ছিলাম। মায়ের সঙ্গে শুভ্র তখন দেশে। আমার এক সময়ের তিতাস অগ্রজ ওবায়েদ ভাই আমাদের ঈদের জামাতে নিয়ে যান। প্রবাসে বাঙালিদের আয়োজনে আমার বুয়েট বন্ধু মনোয়ারের সঙ্গে বহুদিন পর দেখা হয়। সারাদিন কাটে নীরবে নিভৃতে মন খারাপ করে। অবশ্য রোজি, শুভ্র অস্ট্রেলিয়া আসার পর যতবার পরিবারের সঙ্গে ঈদ করেছি অনেক আনন্দে কেটেছে। রোজি অত্যন্ত পাকা রাঁধুনি। আর আমাদের ভোজন বিলাসিতা নিয়ে ওর জানা আছে। তবে যতদিন শুভ্র আমাদের সাথে মেলবোর্ন ছিল তারাবির নামাজ পড়তে ডঙ্কাস্টার মসজিদে যেতাম। কিন্তু গাড়ি চালনার দক্ষতা না থাকায় বাকি সময়গুলো রিংউড বাসায় তারাবি পড়েছি।
শুভ্রর বিয়ের পর চাকরির সুবাদে ব্রিসবেন চলে আসে। আমরা রোজা এবং ঈদের সময় একসঙ্গে ব্রিসবেন কাটিয়েছি। আর এবার কুইন্সল্যান্ড চলে এসেছি। নাতি নাতনিদের সাথে কাটানোর জন্য। এবারের রোজায় চারটি মসজিদে তারাবির নামাজ পড়েছি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আমরা থাকি গোল্ড কোস্টের কাছাকাছি লোগান সিটিতে, পরিবার নিয়ে শুভ্র থাকে কাছেই মার্সডেন এলাকায়। আমরা স্ল্যাক ক্রিক, ইউএমবি, লোগান মসজিদে তারাবি পড়েছি। খতম তারাবির দিনটি ছিলাম অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম প্রধান হল্যান্ড পার্ক মসজিদে। ইনশাআল্লাহ ঈদের জামাত নাতি-নাতনিদের নিয়ে পড়বো আইপিডিসি ইসলামিক ষোল মসজিদে। এরপর সারাদিন কাটাবো মাউন্ট গ্রাভার্ট ঈদ মেলায়।
যে দুবার কাজের কারণে আফগানিস্তানের কাবুলে ছিলাম তার প্রথমবার তালিবানরা ঈদের দিন কাবুল শহরের তিনটি অংশে রকেট হামলা করে। আমাদের ঈদের জামাত পড়তে দেয়া হয়নি। বিশেষ ব্যবস্থায় আমাদের জন্য সুরক্ষিত আবাসনে টার্কি রোস্ট, নানা ধরনের উপাদেয় কাবাব রান্না করা হয়েছিল। আফগান বন্ধুরা অনেক উপহার দিয়েছিলো। ঈদের কয়েকদিন পর কয়েকজন আফগান বন্ধুর বাসায় নিমন্ত্রণ করে বিভিন্ন ধরনের উপাদেয় খাবার পেট পুরে খাবার কথা মনে আছে। একটি বার আমি আফগানিস্থান বৃহৎ পরিসরে ঈদের জামাত পড়েছিলাম। আমার আফগান ছাত্র-ছাত্রীরা গেস্ট হাউজে প্রচুর খাবার পাঠিয়েছিল। কাবুল গাজানফার ব্যাংকে ব্যাবস্থাপক হিসাবে কর্মরত বাংলাদেশি হাসিনুরের পরিবার আমাদের দেশীয় রান্না করে আপ্যায়িত করেছিল।
যাই হোক বাংলাদেশে ঈদের আনন্দ মিস করি। ঈদের দিন এবং পরবর্তী দিনগুলোতে সুযোগ পেলেই বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুলোতে ঈদের অনুষ্ঠান দেখবো। এই প্রবাসে বসে মনটা ভালো থাকবে না। বাবা-মা, বড় ভাই, দুই বোন পরপারে। শিউলি আপা চলে গেছেন ডিসেম্বর ২০২১। বাংলাদেশে আছে এখন সবেধন নীলমনি আমার ছোট ভাই সাকি, বড় ভাইয়ের ছোট ছেলে তরক্কী আর মেয়ে স্নিগ্ধা। বড় বোনের মেয়ে ফ্লোরা, ছেলে মেরাজ। ছোট অপার সন্তান রিফাত আর শায়ের। বাকি সবাই মালা, তোরা, তারেক, সোহানি বিভিন্ন দেশে। কথা বলবো। প্রযুক্তির কারণে এখন বিশ্ব হাতের মুঠোয়।
আরও দুইজনকে মিস করবো, আমজাদ আর রীপা আমার অনেক কাছের দুই প্রিয়জন।