আশ্রয়ণ: মুজিববর্ষে অলৌকিক উন্নয়ন

মো. রমজান আলী: বর্তমানে দেশ তার উন্নয়ন যাত্রার এক গৌরবময় অধ্যায়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার, “বাংলাদেশ: সমৃদ্ধির জন্য, অগ্রগতি”, অল্প সময়ের মধ্যে একটি গৌরবময় বাস্তবতায় পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ একের পর এক উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে ক্রমাগত বিভিন্ন উন্নয়ন কৌশল প্রয়োগ করে আসছে। একদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরলস নেতৃত্বে অর্থনৈতিক ও শিল্প খাতে দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে দ্রুত উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিগত দশ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, ফলে উন্নয়নধারায় জনগণের অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন এক অলৌকিক ঘটনা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শূন্য রিজার্ভ দিয়ে প্রবৃদ্ধির এ যাত্রা শুরু করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেশের প্রথম ৭.১৯ বিলিয়ন টাকার বাজেট পেশ করেছিলেন। আজ তাঁর মেয়ের হাতে, সেই বাজেট দাঁড়িয়েছে ৬.০৪ ট্রিলিয়ন টাকায়। কোভিড-১৯ মহামারিতেও ২০২১-২১  অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬.৯৪ শতাংশ হয়েছে, যা এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সর্বোচ্চ। কোভিড-১৯ সময় পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি গত পাঁচ বছরে ৭  শতাংশের বেশি হয়েছে। সরকার অর্থনীতিকে কাঠামোগতভাবে রূপান্তর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য দারিদ্র্য ও বৈষম্য কমাতে সামাজিক নিরাপত্তার পরিধি বাড়ানোর লক্ষ্যে বহুমুখী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করছে। সমাজের পিছিয়ে পড়া, নিঃস্ব, অসহায় এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য বড়ো আকারের উন্নয়ন প্রকল্পের পাশাপাশি বিভিন্ন কর্মসূচি একযোগে পরিচালিত হচ্ছে। আশ্রয়ণ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন ভাবনার অন্তর্ভুক্তিমূলক চেতনা থেকে শুরু হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন, শিক্ষা এবং বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম আবাসনে সংযোজন করা হয়েছে। কিভাবে একটি ঘর সামগ্রিক পারিবারিক কল্যাণ এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্য একটি প্রধান হাতিয়ার হতে পারে তার একটি অনন্য উদাহরণ হলো আশ্রয়ণ প্রকল্প।

 

‘কেউ পিছিয়ে থাকবে না’ স্লোগানকে সামনে নিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ভূমিহীন এবং গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। একটি ঘর এখন সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে, যার মধ্যে রয়েছে একটি বিচ্ছিন্ন পরিবারের দারিদ্র্যমোচন। প্রতিটি নিরাপদ বাড়ি পরিবারের সবাইকে বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে আত্মবিশ্বাসী এবং সক্রিয় করে তোলে। ১৯৯৭  সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রথম আশ্রয়ণ প্রকল্প চালু করে, গৃহহীন ও অসহায় দরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেন। এই ব্যক্তিরা তাদের জীবনমান উন্নত করার জন্য ঋণ ও প্রশিক্ষণ সুবিধাদি গ্রহণের মাধ্যমে আয়-উৎপাদনকারী কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত রয়েছে। ১৯৯৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার দেখানো পথে ৩৮.৪  বিলিয়ন টাকা ব্যয়ে মোট ২,৯৮,২৪৯টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। কিন্তু মুজিব বর্ষতে, বঙ্গবন্ধুর কন্যা দ্রুততম সময়ে গৃহহীন এবং ভূমিহীনদের বাড়ি দেওয়ার জন্য জাতির পিতার প্রস্তাবিত আবাসন কর্মসূচি পুনরায় চালু করেন। তিনি আশ্রয়ণ -২ প্রকল্পকে জাতির জন্য আরো সময়োপযোগী এবং টেকসই করার জন্য নতুন ডিজাইন করা ঘর নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ব্যারাক নির্মাণ ছাড়াও একটি দু’রুমের ঘর, একটি প্রশস্ত বারান্দা, একটি রান্নাঘর এবং একটি টয়লেট নির্মাণের জন্য একটি কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল, যার মধ্যে প্রতিটি নিরীহ পরিবারের জন্য ২  শতক জমির ব্যবস্থা ছিল। প্রথম দফায় ২৩ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মোট ৬৯,৯০৪ পরিবারকে মালিকানা অধিকারের সঙ্গে ঘর দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন, ২০২১  তারিখে ৫৩,০০০ এরও বেশি পরিবারকে একইভাবে ঘর দেওয়া হয়েছিল। এত বড়ো সংখ্যক পরিবারকে আবাসনের ব্যবস্থা বিশ্বের অন্য কোন দেশে সম্ভব হয়নি। এই সকল বাড়ি সমগ্র বাংলাদেশের জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে নির্মিত হচ্ছে। তারা একই সাথে খাস জমি চিহ্নিত করছে, অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধার করছে এবং গৃহহীনদের থাকার ব্যবস্থা করছে। অনেক ক্ষেত্রে, তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে।

ভূমিহীন, গৃহহীন, দুঃখী এবং উদ্বাস্তু পরিবারের স্বামী -স্ত্রীর যৌথ নামে জমি ও বাড়ির মালিকানা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, বিধবা এবং স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত মহিলাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবারকে মালিকানা নিয়ে ভবিষ্যতে বিবাদে জড়াতে না দেওয়ার জন্য জমির মালিকানা দলিল, বরাদ্দপত্র এবং শিরোনাম দলিল  হস্তান্তর করা হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবারগুলিকে ৩ মাসের জন্য ভিজিএফ প্রোগ্রামের আওতায় আনা হচ্ছে। সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী সামাজিক সুবিধা কর্মসূচির আওতায় মুক্তিযোদ্ধা, বয়স্ক, বিধবা এবং প্রতিবন্ধীদের সুবিধা অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন উৎপাদনশীল এবং আয় সৃষ্টিকারী কাজে নিয়োজিত করার জন্য ব্যবহারিক এবং প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমবায় বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিভাগ, সমাজসেবা বিভাগসহ অন্যান্য সরকারি সংস্থা  থেকে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। অন্যান্য সামাজিক সংগঠন এবং এনজিওগুলিও এই কর্মসূচির সাথে জড়িত। পুনর্বাসিত পরিবারের জন্য বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয় এবং প্রকল্পস্থলে নিরাপদ পানির জন্য টিউবওয়েল স্থাপন করা হচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টার, নামাজের কক্ষ, কবরস্থান, পুকুর এবং অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের রাস্তাগুলিও সহজতর করা হচ্ছে। প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন ধরনের ফল, বনজ ও ঔষধি গাছ লাগানো হচ্ছে। গৃহহীন মানুষদেরও কৃষি কাজে যুক্ত হতে উৎসাহিত করা হচ্ছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুভূত আবাসন কার্যক্রমের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হলো জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে  সরাসরি ভূমিকা রাখা। একা ঘর নির্মাণের মাধ্যমে বিভিন্ন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব হতে পারে। কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠীর আবাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, ক্ষমতায়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমন্বিত উন্নয়ন এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাথে সম্পর্কিত। এসডিজি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে এবং একটি সমন্বিত নীতি কাঠামো প্রণয়নে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রধান কারণ হচ্ছে অন্তর্ভুক্তিমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। একই সাথে, এসডিজিকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিকি পরিকল্পনার (২০২১-২০২৫)সাথে একীভূত করা হয়েছে। উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সমাজের দরিদ্র, অনগ্রসর এবং পিছিয়ে পড়া অংশকে বৃহৎ পরিসরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের সাথে একীভূত করা হয়েছে। মুজিব বর্ষের বিশেষ উদ্যোগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে জমি ও বাড়ি প্রদান করে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক গৃহিত অগ্রাধিকার নীতি “যিনি পিছনে আছেন তাকে অবশ্যই সামনে আসতে হবে” দেশের সুষম ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের গতি আরও ত্বরান্বিত করবে।

আবাসন কর্মসূচির প্রধান সুবিধাভোগীরা হলেন বাংলাদেশে চরম দারিদ্র্যের (১০.৫ শতাংশ) বসবাসকারী মানুষ। ফলে দারিদ্র্যমোচনে এই প্রকল্প অবশ্যই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। দেশের পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলো এই কর্মসূচির সুবিধা পাচ্ছে। একই সময়ে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, হরিজন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, চা শ্রমিক, ভূমিহীন কৃষক, তৃতীয় লিঙ্গ, জলবায়ু শরণার্থী, প্রতিবন্ধী, অসহায় এবং অত্যন্ত দরিদ্র মহিলারা এই কর্মসূচির প্রধান সুবিধাভোগী। এই কর্মসূচির মাধ্যমে  পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আয় ও উৎপাদনশীল সম্পদে তাদের প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি, ন্যূনতম শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টি অর্জন সম্ভব। এসডিজি ২০৩০ লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের ফলে বৈষম্য হ্রাস, বিভিন্ন সেবা, বিদ্যুৎ, সুপেয় পানি এবং নাগরিক অধিকার আরও উন্নত হবে। এটি লিঙ্গ ও জাতিগত বৈষম্যেরও অবসান ঘটাবে। শুধু আবাসন নিজেই কর্মসংস্থান এবং অন্যান্য উপার্জনের সুযোগের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এক জায়গা থেকে সবার জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা সহজ হবে। পরিবার কল্যাণ সহকারী এবং স্বাস্থ্যসেবা সহকারীরাও গ্রামীণ এলাকায় সুবিধাভোগীদের সাথে নিয়মিত সংযোগ স্থাপন করে সেবা প্রদান করতে সক্ষম হবে। স্থানীয় পর্যায়ে, নির্মাণ সামগ্রী সরাসরি গ্রামীণ বাজার থেকে সংগ্রহ করা হয়, যার ফলে নির্মাণ ব্যয় কম হয় এবং একই সাথে গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙ্গা হয়। এই একটি প্রকল্পের মাধ্যমে বাংলাদেশের পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নয়নের নতুন দিগন্তের দ্বার উম্মোচন হবে।

লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

19 − twelve =