সালেক সুফী: আমি প্রতিদিন ভোর রাতে ঘুম থেকে চোখ খুলে এবং রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আমার স্নেহময়ী মা মরহুম সৈয়দা ইফফাত আরা বেগমকে স্মরণ করি। তাই আমার প্রতিদিনই মা দিবস। মা ছিলেন আমার সেরা বন্ধু, শিক্ষক, জীবন গড়ার আদর্শ কারিগর। ‘ কোনো দিন কারো প্রতি ঘৃণা, প্রতিহিংসা না করার শিক্ষা, সত্যি কথা বলার সৎসাহস মায়ের কাছ থেকে শেখা।
বাবা চাকরি সূত্রে দূরে থাকতেন। ছুটিতে আসলে যতটুকু সময় পেতেন ইংরেজি শিখাতেন, খেলাধুলোয় উৎসাহ দিতেন। বাবা মরহুম খন্দকার আব্দুল খালেক কলকাতা সেন্ট জাভিয়ার কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যের স্নাতক ছিলেন। ফুটবল খেলতেন কলকাতা ফুটবল লিগে।
মায়ের সাথে সময় কেটেছে শৈশব কৈশোর। পড়ালেখা, আরবি শিক্ষার হাতে খড়ি মায়ের হাতে। পীর বংশের মেয়ে রক্ষণশীল পরিবার। নানা মা-খালাদের বাসায় শিক্ষক রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। তারপরেও মায়ের মতো বাংলা লিখতে, ইংরেজি পড়তে, উর্দু-ফারসি অনর্গল বলতে আমি কাউকে দেখিনি। স্কুল ম্যাগাজিনে আমার প্রথম দুটি লিখাও মা ঠিক করে দিয়েছিলেন।
যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছি সেদিন থেকে মায়ের আদর স্নেহ ভালোবাসা পেয়েছি। তা সেটা মায়ের কোলে হোক বা দূর বিদেশে যেখানেই থাকি না কেন। ১৯৭১ যতদিন মার কাছ থেকে দূরে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধের কাছাকাছি ছিলাম, প্রায় প্রতিদিন মাকে একপাতা হলেও চিঠি লিখতাম। সুযোগ পেলে পোস্ট করতাম। বুয়েটে পড়ার সময়, প্রশিক্ষণে দেশের বাইরে থাকার সময় নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, কানাডা থেকেও নিয়মিত লিখেছি।
শিশুবেলা বলি কেন এমনকি বুয়েটে পড়ার সময় ফরিদপুর গেলে বা মা ঢাকা আসলে মা হাতে তুলে খাইয়েছেন, পড়ার সময় পাশে বসে থেকেছেন। আমি খুব সকালে কোরান শরীফ পড়ে দুনিয়ার সবার জন্য দোআ করতে শুনেছি। রাতে ঘুমানোর আগে চারটি সূরা এবং আয়তাল কুরসী পড়ে ঘুমানোর অভ্যাস মায়ের শিখানো।
১৯৬৯ জানুয়ারী মাসে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান।আমি ওই বছর ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবো। ছোট ভাই সাকি ক্লাস এইটে পড়ে। বড় ভাই পরিবার নিয়ে খুলনায় থাকেন। বড় বোন স্বামী-সন্তান নিয়ে ঢাকায়, মেঝো আপা সদ্য এমএ পাস করে কলেজের শিক্ষকতা করছেন। মা কিন্তু নিজহাতে সব সামাল দিয়েছেন।
মায়ের সাথে ফুল আর সবজির বাগান করেছি, বিদেশি হাঁস, মুরগি, কবুতর পালন করেছি, নানা ভাবে মাছ ধরে এনে দিয়েছি। মা’কে বসিয়ে রেখে রাত জেগে পড়েছি। মনে আছে ১৯৭১ মে মাসে মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছুদিন বাসায় ছিলাম। একদিন কিভাবে যেন দুইজন পাঞ্জাবি সেনা বাসায় ঢুকে আমার আর বড় ভাইয়ের বুকে সরাসরি রাইফেল তাক করেছিল। মা আরবি-ফারসি ভাষা অনর্গল বলে বুঝিয়ে আমাদের রক্ষা করেছিলেন। যদি মা একটু বিচলিত হতেন আমাদের লুকিয়ে রাখা আগ্নেয়াস্ত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল না। নিশ্চিত মৃত্যু হতো সেই দিন।
আরও একদিনের কথা মনে আছে। ক্লাস সেভেনে পড়ি। বৃষ্টির দিনে স্কুল থেকে কাক ভেজা হয়ে ফিরেছি। কাপড় পাল্টে মায়ের পাশে বসে আছি। মা আছরের নামাজ পড়ে ভাত মেখে খায়িয়ে দিবেন। আমাদের একঘর থেকে আরেক ঘরে যাবার বিদ্যুৎ লাইনের উপর কাপড় টানাতে চেষ্টা করে নতুন কাজের বুয়া চিৎকার করে উঠলো। মা ওকে ছুঁতে যেয়ে তিনিও চিৎকার করলেন। জানিনা হয়তো বিধাতার নির্দেশে আমি তাৎক্ষণিক মেইন সুইচ অফ করেছিলাম বলে মা, বুয়া দুইজনই রক্ষা পেয়েছিলেন। অবশ্য দুজনই ভুগেছিলেন বেশ কিছুদিন।
দুই বার জীবনে মার কথা মানিনি। একবার একাত্তরে মা’ক না বলে খুলনায় যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগে সম্পৃক্ত হওয়া।অবশ্য পরে ঢাকায় বিদেশি সংবাদিকদের সাথে কাজ করার বিষয়টি আম্মা জানতেন। আর একবার মায়ের অমতে বিয়ে করা। অবশ্য মা অচিরেই মেনে নিয়েছিলেন। কুমিল্লায মা দুইবার আমাদের সাথে এসে থেকেছেন।
১৯৯৪ সালে ইন্তিকাল করার আগে রোজি, শুভ্র, অভ্রকে নিয়ে ফরিদপুরে ঈদ করতে অনুরোধ করেছিলেন। ওই সময় আমাদের বাখরাবাদ-চট্টগ্রাম পাইপ লাইনের কাজে আমি অন্যতম সমন্বয়কারী ছিলাম বলে মা’কে কোরবানির ঈদে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। মা নিজে হাতে পিঠা, আমসত্ত্ব বানিয়ে জন্যে জন্যে সবার জন্য প্যাকেট করে পাঠিয়েছিলেন। ১৯৯৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মা আমাদের এতিম করে চলে গেলেন।
মা বলতেন ‘নাম রেখেছি সুফী, আমি চাই কাজে এবং চিন্তায় নামটির কথা স্মরণে রাখবে।’ জানিনা মায়ের শিক্ষা জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি কিনা। আজ সবাই যখন ঘটা করে মা দিবসে মাকে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট দিচ্ছে আমার মানসপটে মায়ের ছবি ভেসে উঠছে। মায়ের নামে নাম আমাদের ইফফাত মঞ্জিল রক্ষা করবো। মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখবো এটাই এখন আমার ভিশন। এখনো যখনি কিছুটা বিপদ আসে মায়ের মুখ ভেসে ওঠে। জানি দুনিয়ার সব মা একই রকম হয়। রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বিয়ানা সগিরা।