সুলতানা লাবু: শিশুকে সুষ্ঠুভাবে গড়ে তুলতে হলে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি প্রয়োজন মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়া। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য গঠনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিশুর পরিবেশ। মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন ব্যক্তিত্বের সুষ্ঠু বিকাশই মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার উপায়। ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে শিশুর প্রথম কয়েক বছর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন মনোবিজ্ঞানীরা। শিশুরা অনুকরণ করতে ভালোবাসে। তাই শিশুর পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা, বিশ্বাস, শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহনশীলতার সম্পর্ক থাকা খুব প্রয়োজন। অর্থাৎ শিশুর বাসগৃহ যেন সুশৃঙ্খল ও শান্তির হয়।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নেয়ার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান একক পরিবারের কারণে শিশুদের বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গবেষনায় দেখা গেছে, যৌথ পরিবারে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। একসময় আমাদের পরিবারগুলো যৌথ পরিবার ছিলো। কোনো সমস্যা হলে যৌথ পরিবারের মধ্যে আরও অনেক শিশুদের সঙ্গে হেসে খেলে এগুলো ঠিক হয়ে যেতো, কিন্তু এখন সবাই একক পরিবার হয়ে গেছে।
এখন বেশিরভাগ পরিবারে একটা বা দুইটা বাচ্চা। বাবা মা দুজনই ব্যস্ত। বাচ্চাদেরও মানসম্মত সময় দেয়া যাচ্ছে না। যাদের একটু আর্থিক স্বচ্ছলতা আছে, তাদের বাচ্চারা টেলিভিশন আর মোবাইল ফোন নিয়েই সময় কাটায়। কিন্তু গ্রামে এই সমস্যাটা ততোটা দেখা যায় না। তারা মাঠে ঘাটে হেসে খেলে বেড়াতে পারে। কিন্তু শহরে আজকাল সব এককভাবে থাকতে যেয়ে শুধু নিজেদের নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকার ফলে বাচ্চাদের চাহিদার দিকে সেভাবে নজর দেয়া হচ্ছে না। শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে দিলেই, শিশুরা খুশি আর এতেই শিশুর প্রতি দায়িত্ব পালন হয়ে গেল। এমনটা ভাবা ভুল। বাচ্চারাও তাদের সাথী চায় এবং বাবা-মাকে সেই সাথী হতে হবে। তাদের অন্তত সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিতে হবে, যাতে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো হয়, তারা উদার হয়, অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে শিখে। সবার সঙ্গে মিশে যেন চলতে পারে, সেভাবেই শিশুদের শিক্ষা দেওয়া উচিত।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার জন্য বিশেষ আহ্বান জানিয়েছেন শিক্ষক এবং অভিভাবকদের। তিনি মনে করেন, মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে অনেকে এ বিষয়ে সচেতন না।
অনেক সময় দেখা যায় শিশুদের পড়া দিলে পড়তে পারে না বা পড়ায় মনোযোগ দিতে পারে না। পড়াশোনার দিকে কোনো রকম খেয়ালই করতে পারছে না। শিক্ষক কি বলছে, তা সে শুনছেই না। তখন সেই শিশুটিকে একবাক্যে আমরা বলে ফেলি অমনোযোগী। এরপর শিশুটির ভাগ্যে জোটে মারধর, ধমক, বকাঝকা। কিন্তু আমরা একবারও ভেবে দেখি না, কেন শিশুটি তা করতে পারছে না। কেন সে মনোযোগ দিতে পারছে না। এটা আসলে এক ধরনের প্রতিবন্ধিতা। এটা অন্য ধরনের একটা সিনড্রোম। আবার অনেক শিশুর ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটা বিষয়ে সে খুব ভালো। কিন্তু তাকে একটু ধমক দিলেই সে আর পড়তে পারে না, আর লিখতে পারে না। সে মনোযোগ দিতে পারে না। নার্ভাস হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে শিশুর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সরকারের সচেতনতার কোনো ঘাটতি নেই। শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি প্রত্যেক শিক্ষকের সচেতন হওয়া উচিত। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের পরিচর্যার লক্ষ্যে প্রায় দুই লাখ শিক্ষককে সরকারি ভাবে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে প্রতিটি শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি বলবো না যে প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একজন মানসিক বিশেষজ্ঞ রাখতে হবে, কারণ সেটা সম্ভব না। কিন্তু প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে মানসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়ে অন্তত শিক্ষার্থীদের একটা পরীক্ষা নেওয়া প্রয়োজন এটা জানতে যে, কার ভেতরে কি ধরনের সমস্যা আছে।’ তিনি মনে করেন, ‘শুধু ধমক দেওয়া বা বকাঝকা করাই নয়। শিক্ষার্থীদের অবস্থাটা বুঝে তাদের সঙ্গে সেভাবেই আচরণ করতে হবে। বাবা মা, শিক্ষক বা বন্ধু বান্ধব সবাইকে এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।’
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি সরকার শিশুদের পুষ্টির বিষয়টিও গুরুত্ব দিচ্ছে। পুষ্টি বিষয়টির উপর সবার সচেতনতা খুব জরুরি। সরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যে প্রায় এক লাখ শিক্ষক এবং কর্মকর্তাকে পুষ্টি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে শিক্ষকরা পুষ্টি নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে এবং শিক্ষা দেয়। বাবা মাদের শিশুর খাবারের পুষ্টির দিকটা লক্ষ্য করা আবশ্যক। এ বিষয়টিতে বাবা মাসহ শিক্ষকদেরও সচেতন থাকা অত্যন্ত জরুরি।
পড়াশোনাটা শুধু পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না রেখে মানবিক মানুষ হওয়ার শিক্ষা গ্রহণের তাগিদ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাটা শুধু একগাদা পাঠ্যপুস্তক পড়ে যে শিক্ষা, সে শিক্ষা না। শিক্ষা পরিবেশ সম্পর্কে, মানবিকতা সম্পর্কে, শিক্ষা সবার সঙ্গে চলার শিক্ষা, সেটাই সবাইকে দিতে হবে।’
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমাদের অজ্ঞতার কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের পরিবর্তে এ সংশ্লিষ্ট অসুস্থতা দেখা দিলে তা প্রতিকারের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠি। মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হলেতো প্রতিকারের প্রয়োজন হবেই। তবে আমরা যদি মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হওয়া প্রতিরোধের দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিতে পারি, তবে বেশি লাভবান হতে পারি। ছোটবেলা থেকেই মানসিক সমস্যাগুলোর বীজ বপন হয়। এই বীজের উৎপত্তি মূলত পরিবার এবং সমাজ থেকেই সৃষ্টি। ছোটবেলা থেকেই আমরা ছেলে শিশু ও মেয়ে শিশুর মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে দেই। বৈষম্য এবং বিভাজন ছেলে-মেয়ে উভয় শিশুর জন্য মারাত্বক ক্ষতিকর। সব শিশুকে তার আনন্দ, দুঃখ, ভয়, রাগ এই অনুভূতিগুলো সাভাবিকভাবেই প্রকাশ করতে দিতে হবে। কিন্তু যখন শিশুরা এসব অনুভূতিগুলো প্রকাশ করতে যায়, তখন তারা নানা রকম বাধা পায়।
এই অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার সময় মেয়ে শিশুর সাথে আমরা এক রকম আচরণ করি, আবার ছেলে শিশুর সাথে অন্য রকম আচরণ করি। যেমন ছেলে শিশুদের মাথায় আমরা ছোটবেলাতেই একটা মেসেজ ঢুকিয়ে দেই- ছেলেদের কাঁদতে নেই, ছেলেদের ভয় পেতে নেই। এর ফলে ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই কান্না এবং ভয় দুটো অনুভূতি প্রকাশে বাধা পায়। তখন ওদের কাছে থাকে শুধুমাত্র রাগ আর আনন্দের অনুভূতি। তাই তারা দু:খ পেলেও রাগ দিয়ে প্রকাশ করে। আবার রাগ হলেও রাগ দিয়ে প্রকাশ করে। এমন কি ভয় পেলেও তা রাগ দিয়েই প্রকাশ করে। একটা অনুভূতি দিয়ে ছেলে শিশুদেরকে তিনটা অনুভূতি প্রকাশ শিখিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে তাদেরকে আমরা সহিংস করে গড়ে তুলছি। আবার মেয়ে শিশুদের বেলায় ঘটছে তার উল্টোটি। মেয়ে শিশুরা তাদের রাগ, ভয়, দুঃখ এগুলো প্রকাশ করছে কান্নার মাধ্যমে। তাই সব শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখতে হলে এই ছোট ছোট বিষয়গুলোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে, যাতে শিশুরা সৃজনশীল, মননশীল এবং মুক্তমনের মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। এজন্য পারিবারিক এবং সামাজিক সচেতনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
শিশুদের সুরক্ষার ক্ষেত্রে সুশিক্ষার কোনো বিকল্পই নেই। সততা, নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ এবং নিষ্ঠার আলো ছড়িয়ে দিতে হবে শিশুর মধ্যে। সেই শিক্ষা প্রথমেই আসতে হবে শিশুর পরিবার থেকে। তারপর ধাপে ধাপে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও আশপাশের অন্যান্য পরিবেশ থেকে। বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তিকে অনেকইে শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতির জন্য দায়ী বলে মনে করেন। অথচ আমরা একবারও ভেবে দেখি না এজন্য দায়ী টেকনলজি নয়, দায়ী এর অপব্যবহার।
এটা সত্যি যে, বিশ্বের প্রযুক্তিগত উন্নয়নের পরশে আমাদের জীবনযাত্রায় বিশাল পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু এর অপব্যবহার শিশুর উপর নানা রকম কুপ্রভাব ফেলছে। বিশে^র অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের শিশুরাও প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এই আল্ট্রাপ্রযুক্তির বিভিন্ন উপকরণ যেমন মোবাইল, কম্পিউটার ইত্যাদির অপব্যবহার শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করছে। দূরত্ব সৃষ্টি করছে মা ও শিশুর মাঝে। দূরত্ব সৃষ্টি করছে পারিবারিক সব বন্ধনে। এর ফলে পারিবারিক প্রথাগত শিক্ষা, শিষ্টাচার, ধর্মীয় ও সামাজিক আচরণ অর্জন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিশুরা। উন্নত বিশে^র সাথে তাল মিলাতে অবশ্যই প্রযুক্তির সাথেও শিশুর পরিচয় থাকা দরকার, কিন্তু তা যেন আসক্তিতে পরিণত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা অত্যন্ত জরুরি।
কেন শিশুরা প্রযুক্তির উপর আসক্ত হচ্ছে, তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? শিশুরা পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত সঙ্গ পাচ্ছে না। খেলার সঙ্গি পাচ্ছে না। খেলার জন্য মাঠ পাচ্ছে না। আর পড়াশোনার চাপতো আছেই। তাইতো দিন দিন মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারই শিশুর বন্ধু হয়ে উঠছে। শিশুকে সময় দিতে হবে আমাদের। শিশুকে বুঝতে চেষ্টা করতে হবে, শিশুদের সুস্থ্য সবল শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করতে হবে আমাদেরই। তবেই আমরা আজকের শিশুদের কাছ থেকে উন্নত ও সুন্দর এক দেশ পাব। সুস্থ সুন্দর আর আদর্শ প্রজন্ম সে দেশের নেতৃত্বে থাকবে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার