পরিবেশ ও সুরক্ষা

মো. মাসুদুর রহমান: শিল্পবিপ্লবের কারণে মানুষের চাহিদার পরিবর্তনের সাথে সাথে জীবনযাত্রারও পরিবর্তন ঘটছে। বিভিন্ন কলকারখানা তৈরি হচ্ছে। এসব কলকারখানা শুধু মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। পাশাপাশি এসব কলকারখানা থেকে নানা রকম বর্জ্য মানুষের জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলছে। একটি দেশের মানুষের স্বাস্থ্য, গড় আয়ুসহ অনেক কিছুই নির্ভর করে পরিবেশের ওপর।তাই পরিবেশকে বাদ দিয়ে কোনোভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের একদিকে যেমন শিল্পবিপ্লবের সুবিধা নিয়ে নতুন নতুন প্রযুক্তির মাধ্যমে গড়ে ওঠা শিল্পকে গ্রহণ করতে হবে ঠিক তেমনি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে  এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করে পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তা না হলে পরিবেশ তার প্রাকৃতিক নিয়মেই আমাদের ওপর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।

শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগের অন্যতম একটি উদ্যোগ হলো পরিবেশ সুরক্ষা। পরিবেশ সুরক্ষার ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে বেশি উপযোগী ও সাশ্রয়ী হলো ব্যপকভাবে বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে বনায়ন করা। এজন্য শুধু গাছ লাগালেই হবে না,গাছ যাতে টিকে থাকে সে জন্য গাছের নিয়মিত পরিচর্যা করতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য দেশকে আরও বাসযোগ্য করে গড়ে তুলতে হলে সবুজ বনায়ন ছাড়া কোন উপায় নেই। তাই দেশবাসীকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নাজুক অবস্থানে থেকেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নানা উদ্যোগের কারণে পরিবেশ রক্ষায় অনেক ইতিবাচক কাজ অতীতে হয়েছে এবং হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তর এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এসকল ইতিবাচক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ‘ চ্যাম্পিয়ন অব দ্যা আর্থ ‘ পুরস্কারে ভূষিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। ‘পলিসি লিডারশীপ’ ক্যাটাগরিতে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ এ পুরস্কার। এরও আগে  মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালে ইউনেস্কো শান্তিবৃক্ষ পুরস্কার পান। এসব পুরস্কার পরিবেশ রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর কাজের স্বীকৃতি তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সত্তর এর দশকের শুরু থেকেই পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের বিষয়টি বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়ে আসছে। তখন থেকেই বিশ্বব্যাপী পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো পরিবেশ রক্ষায় জনগণকে সচেতন এবং ক্ষমতাসীন রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের পরিবেশ রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সবসময় চাপ প্রয়োগ করে আসছে। ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত স্টকহোম কনফারেন্সের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিবেশ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান গঠন ও জাতীয় পরিবেশ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এ সম্মেলনের মাধ্যমে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে ব্রজিলের রিও- ডি- জেনেরিওতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ধরিত্রী সন্মেলনকে বিশ্ব পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাব মোকাবিলায় অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে ধরা হয়।পরবর্তীতে ১৯৯৭ সালে, কিয়োটো প্রটোকল সম্পাদিত হয়। এ প্রটোকলের মাধ্যমে কার্বন ডাই অক্সাইড ও গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানোর জন্য প্রস্তাব করা হয়েছিল। ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী  গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃ সরণকারী বিশ্বের প্রথম দশটি দেশ হলো চীন(২৩.৯২%), যুক্তরাষ্ট্র(১১. ৮৪%), ইউরোপ(৬.৮৪%), ভারত(৬.৮১%), রাশিয়া (৪.০৭%), জাপান (২.৯০%), ব্রাজিল(২.৩৬%), ইন্দোনেশিয়া (১.৬৯%), ইরান (১.৫৯%), ও দক্ষিণ কোরিয়া (১.৫৬%)। এই দেশগুলো থেকে বিশ্বের গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণের ৬৫ শতাংশ হয়ে থাকে। এখানে উল্লেখ ২০১৮ সালে বৈশ্বিক গ্রীন হাউস গ্যাস নিঃসরণের পরিমাণ ছিল ৪৮ হাজার ৯৩৯.৭১ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড।

সৌরশক্তি, বায়োগ্যাস প্লান্ট, এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট এর মতো পরিবেশবান্ধব খাতের উন্নয়নের পথ সুগম করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজস্ব তহবিল থেকে ২০০৯ সালে পরিবেশবান্ধব খাতের জন্য ২ শত কোটি টাকার একটি আবর্তনশীল পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করে। পরবর্তী ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষিতে ২০২০ সালে তহবিলটি বৃদ্ধি করে ৪ শত কোটিতে উন্নীত করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ স্কিমের আওতায় ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অর্থায়নের বিপরীতে মোট ৮ টি পরিবেশবান্ধব বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট,গ্রিন ইন্ডাস্ট্রি , ভার্মি কম্পোস্ট, সোলার হোম সিস্টেম, বর্জ্য পরিশোধন প্ল্যান্ট,সোলার মিনি গ্রিড, জ্বালানি অদক্ষ সামগ্রী প্রতিস্হাপন এবং কারখানা কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সর্বমোট ৫৩.৪০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়নের ফলে অবকাঠামো নির্মাণ এবং যানবাহন ও কলকারখানার সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ সকল উৎস থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণও ক্রমশ বাড়ছে। মানব স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের বিরূপ প্রভাবসহ অন্যান্য ক্ষতিকর প্রভাব নিরসনের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর উন্নত প্রযুক্তির ইটভাটার প্রচলন,যানবাহন ও কলকারখানাসৃষ্ট ক্ষতিকর ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর অবৈধ পরিবেশ দুষণকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে বিগত জানুয়ারি ২০১৯ থেকে জানুয়ারি ২০২২ পর্যন্ত সময়ে মোট ১ হাজার ৪৪২ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ২ হাজার ৩৬০ টি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে এবং জরিমানা আরওপ পূর্বক  ৫৬ কোটি ২৩ লাখ ৮১ হাজার ৪ শত টাকা আদায় করেছে। এছাড়াও ৭৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদানসহ ৭৬১ টি অবৈধ ইটভাটা ভেঙে ফেলেছে।  বিগত জানুয়ারি ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময়ে কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী যানবাহনের বিরুদ্ধে ৮৬ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৫৮৮ টি মামলা দায়ের করেছে এবং ১৬ লাখ টাকারও বেশি জরিমানা আদায় করেছে ।

শিল্প দূষণ নিয়ন্ত্রণে সকল প্রকার শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প কলকারখানার ক্ষেত্রে তরল বর্জ্য পরিশোধনাগার ব্যবস্হা,শব্দ প্রতিবন্ধক ব্যবস্থা,বায়ু পরিশোধন ব্যবস্হাসহ সকল প্রকার প্রশমন ব্যবস্হা নিশ্চিত করার পর পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র প্রদান ও নবায়ন করে থাকে। ২০০৯ থেকে ২০২১ পর্যন্ত কম-বেশি ৬৫ হাজার শিল্প কলকারখানার অনুকূলে পরিবেশগত ছাড়পত্র প্রদান করা হয়েছে এবং কম বেশি ১ লাখ ১০ হাজার শিল্প কলকারখানার পরিবেশগত ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। পানি দূষণ রোধে তরল বর্জ্য নির্গমনকারী শিল্প কলকারখানাকে তরল বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্হা Effluent Treatment Plant ( ETP) স্হাপনে  পরিবেশ অধিদপ্তরের মনিটরিং অব্যাহত থাকায় অধিকাংশ পানি দূষণকারী শিল্প কলকারখানায় ইতিমধ্যে ইটিপি স্হাপন করেছে। ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত ইটিপি স্থাপনযোগ্য ২ হাজার ৬৭৮ টি শিল্প ইউনিটের মধ্যে ২ হাজার ২৪৯ টি শিল্প ইউনিটে ইটিপি স্হাপন করা হয়েছে। তরল বর্জ্য নির্মাণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানে জিরো ডিসচার্জ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে যার আওতায় শিল্প কলকারখানায় উৎপন্ন তরল বর্জ্য প্রকৃতিতে নির্গমন না করে পরিশোধনপূর্বক পুনঃব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৪  থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তর মোট ৬ শত তরল বর্জ্য নির্মাণকারী শিল্প কলকারখানার অনুকূলে জিরো ডিসচার্জ প্ল্যান অনুমোদন দিয়েছে।

জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট এর অন্যান্য অভীষ্টের ন্যায় পরিবেশ ও জলবায়ু সংক্রান্ত অভীষ্টগুলো বাস্তবায়নে সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নভেম্বর ২২ এ গ্লাসগোতে অনু্ষ্টিত জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) লিডার সামিটে দেওয়া জাতীয় বিবৃতিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ সুরক্ষায় চার দফা দাবি তুলে ধরে বিশ্বের জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের নৈতিক কণ্ঠস্বরে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশের স্বপ্নবাজ মানুষ কখনোই হারেনি। আমাদের পরিবেশ আমাদের নিজের এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য নিরাপদ রাখতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সোনার বাংলা সবুজ করার যে প্রচেষ্ঠা তা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশের সকল স্তরের মানুষকে। তবেই রক্ষিত হবে আমাদের পরিবেশ এবং আমরা আবারও প্রমাণ করতে পারব আমরাই বিশ্বের কাছে রোল মডেল।

পিআইডি ফিচার

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

nine + 9 =