ফারজানা ইয়াসমীন: সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রেখেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কী পরিমাণ ক্ষতি করেছে সোনার বাংলার। পাকবাহিনীর অত্যচারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হয়েছিল এ দেশের নারী সমাজ। এসব বেঁচে যাওয়া নির্যাতিত নারীদের তিনি নিজ সন্তানের মর্যাদা দিয়েছিলেন। নির্যাতিত সকল নারীদের দায়-দায়িত্ব জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা তাদের কাঁদে তুলেনিয়ে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশের পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমঅধিকার থেকে বঞ্চিত নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এখানে উল্লেখ্য মুক্তিযুদ্ধের সময় নারীর সংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার অর্ধেক অর্থাৎ ৩ কোটি ৭৪ লাখ নারীই ছিল মুক্তিযোদ্ধা। কোনো নারী রাজাকার ছিলো না। রাজাকারের কোনো কাজে সমর্থনও করেনি কোনো নারী (বেগম পত্রিকা, ২০০০)। আমাদের আছে গর্বের তারামন বিবি বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা ডা. সেতারা বেগম, কাকন বিবি, ফোরকান বেগম, আশালতা বৈদ্য, শোভা রাণী, করুনা বেগম, বীথিকা বিশ্বাস, শিরিন বানু মিতিল ও আলেয়া বেগমসহ আরও অনেক নারী মুক্তিযোদ্ধা। একাধিক সম্মুখযুদ্ধে তাদের অনেকেরই ছিল উজ্জ্বল উপস্থিতি। তাঁরা প্রত্যেকেই একেকটা উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আমাদের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব।
বাংলাদেশের নারীর সাফল্য আজ বিশ্ব জুড়ে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয়। একজন মেয়েকে শিক্ষা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে গোটা পরিবারকে শিক্ষিত করে তোলা। জাতির কল্যাণ ও অগ্রগতিতে নারী শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এর মূল ভিত্তি শুরু হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। জাতির পিতার পথ অনুসরণ করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী উন্নয়ন,কর্মসংস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দীর্ঘ, মধ্যে ও স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণসহ সময়োপযোগী নানা ধরনের নীতি – কৌশল গ্রহণ করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর গৃহীত ১০ টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন “নারীর ক্ষমতায়ন”। সে লক্ষ্যে চলছে নারী উন্নয়নের নানা কার্যক্রম। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যুক্ত হয়েছে উন্নয়নের মহাসড়কে। এরই ধারাবাহিকতায় গত এক দশকে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার ব্যপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। যার সুফল সমাজের সকল স্তরের মানুষ পেয়েছে, পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে। গ্রামীণ নারীসমাজের আর্থসামাজিক অবস্থানকে মজবুত করার জন্য সহজ শর্তে বিভিন্ন রকম ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্হা করা হয়েছে। তাদের জীবনমান উন্নয়ন এবং আয়বর্ধক কর্মে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যে গ্রামাঞ্চলে বর্তমান সরকার “আমার বাড়ি, আমার খামাoর” প্রকল্প বাস্তবায়িত করছে। গার্মেন্টস শিল্পে ৪০ লক্ষ কর্মরত নারী পুরুষের মধ্যে ৮০ ভাগই নারী। নারীর ক্ষমতায়নে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন ৫০ এ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এছাড়াও নারীরা সরাসরি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এবারই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নারী সংসদ অর্থাৎ ২২ জন নির্বাচিত হয়েছেন। সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। এছাড়াও সরাসরি নির্বাচনের সুযোগতো রয়েছেই। চাকরিতেও নারীদের জন্য রয়েছে বিশেষ সুবিধা। উচ্চ আদালত এবং নিন্ম আদালতে আসীন রয়েছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী বিচারক। তাঁরা দক্ষতার সাথে বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। প্রশাসনে আছেন বেশ কয়েক জন নারী সচিব। বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় সামলাচ্ছেন একজন নারী সচিব। নারীরা এখন পুলিশ, সেনাবাহিনী কিংবা জাতিসংঘের শান্তি বাহিনীর মতো চ্যালেঞ্জিং কাজে উচ্চপদে দক্ষতার সাথে কাজ করছেন। নারী বিজ্ঞানী,গবেষক, উদ্ভাবক,রাষ্টদূত সবক্ষেত্রেই যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী,স্পীকার ও বিরোধীদলীয় নেত্রীও নারী। এছাড়াও শিক্ষকতা,ডাক্তারি পেশাসহ গণমাধ্যমেও নারীদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো।
রাষ্ট্র ও জনজীবনের মূলধারায় নারী পুরুষের সমান অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারী পুরুষের সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের জন্য দেশের সংবিধানসহ বিদ্যমান আইন,পরিকল্পনা ও নীতি নির্ধারণী দলিলপত্রে সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি’ র লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং ২০৪১ সালের মধ্যে জেন্ডার সমতাভিত্তিক এক উন্নত – সমৃদ্ধ বিশ্বে প্রবেশের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মহাসোপানে বাংলাদেশের নারীরা আজ আদর্শ ও নির্ভরযোগ্য। ৮ কোটি ২২ লাখ নারীর কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ আজ আর্থসামাজিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করছে। উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং শ্রমবাজার ও আয়বর্ধক কাজে নারীর অধিকতর অংশগ্রহণ দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সরকারি সেবা প্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় কম-বেশি ৮৬ কোটি নারীর বসবাস,যার মধ্যে প্রায় ৬৩ কোটি নারী ভারতীয়। জেন্ডার সমতার ক্ষেত্রে ২০২১ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৫ ( সামগ্রিক স্কোর ছিলো ০.৭১৯)। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যা বৈশ্বিক জেন্ডার গ্যাপ সূচকে শীর্ষ ১০০ এ স্হান পেয়েছে। এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর মধ্যে ভূটান ১০৬, শ্রীলংকা ১১৬, মালদ্বীপ ১২৮, ভারত ১৪০ ও পাকিস্তানের অবস্থান ১৫৩। বাংলাদেশের বর্তমান শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৬.৩ শতাংশ। দেশে মোট শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৩৫ লাখ, যার মধ্যে পুরুষ ৪ কোটি ৩৫ লাখ এবং নারী ২ কোটি। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষায় মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫১ শতাংশ, মাধ্যমিক পর্যায়ে ৫৪ শতাংশ এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে ৪৮.৩৮ শতাংশ নারী। বিগত সময়ের তুলনায় নারীরা শিক্ষায় তুলনামূলকভাবে অনেক এগিয়েছে। তবে এখানেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই, আমাদের যেতে হবে অনেক দূর, করতে হবে অনেক কিছু। বর্তমান সরকার ” প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট” ফান্ড গঠন করে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে নারীদের শিক্ষা বৃত্তিসহ অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে। প্রাথমিক শিক্ষায় মেয়ে শিশুদের ভর্তির হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান আরও ৬২ টি দেশের সাথে সমন্বিতভাবে প্রথম। ২০২১ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকার শতকরা হার ছিল ৬৪.৪১ শতাংশ আর পুরুষ শিক্ষকের হার ছিল ৩৫.৫৯ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষায় বর্তমানে শতভাগ ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে,ছাত্রদের ক্ষেত্রে এ হার ৭০ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষায় নারীদের নানাবিধ সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধির কারণে গত এক দশকে অধিক সংখ্যায় নারী শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করেছেন এবং সাফল্যের সাথে শ্রমবাজারে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছেন।
বিগত এক দশকে সরকারের নানামুখী কার্যক্রম গ্রহণের ফলে নারীদের জীবনমানে ব্যপক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। নারী শিক্ষার হার বেড়েছে, গড় আয়ু বেড়েছে, সরকারি-বেসরকারি চাকরিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং পাচ্ছে। শিশু মৃত্যুরহার এবং মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক কমেছে। সামগ্রিকভাবে দেশের দারিদ্র্যের হার কমেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে, নারী ক্ষমতায়িত হচ্ছে। এতকিছুর পরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীরা এখনও পিছিয়ে রয়েছে। তাদেরকে উন্নয়নের মূলস্রোতে আনার জন্য সরকার ইতোমধ্যে টার্গেট ওরিয়েন্টেড কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সমাজের সুবিধাবঞ্চিত সকল নাগরিকদের সমাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কর্যক্রমের জন্য বাজেট বরাদ্দ রয়েছে ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৫৭৬ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ১৬.৭৫ শতাংশ। বর্তমান অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বয়স্ক ভাতা ৫৭.০১ লক্ষ, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা ২৪.৭৫ লাখ, প্রতিবন্ধী ২৩.৬৫ লাখ, হিজড়া, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ৮৬ হাজার জন উপকারভোগী নির্ধারিত হারে ভাতা পাবেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামাজিক সুরক্ষা কর্যক্রমের আওতায় নগদ সহায়তা পাবেন মোট ১ কোটি ২২ লাখ ৮৬ হাজার জন উপকারভোগী। এছাড়াও দরিদ্র মানুষের জন্য ভিডব্লিউবি কার্যক্রম, ভিজিএফ,জিআর,কাবিখাসহ নানাবিধ খাদ্য সহায়তা কার্যক্রম সরকার পরিচালনা করছে। খাদ্য সহায়তাসহ অন্যান্য সুবিধা পাবেন ৩ কোটি ৫৯ লাখ ২৫ হাজার জন উপকারভোগী। বিভিন্ন প্রকার উপবৃত্তি পাবে ২ কোটি ৩৮ হাজার জন।
খুব সাধারণীকরণ মনে হলেও এখনো ধর্মীয় অনুশাসনের অপব্যবহার, ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, কর্ম বা শিক্ষা ক্ষেত্রে নিরাপত্তার অভাব,অসৌজন্যমূলক ব্যবহার,আনওয়েলকামিং এ্যাটিচ্যুড, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা নারী উন্নয়নের প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে। নারী উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের নেতৃত্ব বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এদেশের নারীরা সকল বৈষম্যকে ছাপিয়ে নিজ যোগ্যতায় দেশে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দক্ষতার সাথে তাদের অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করতে সক্ষম হবেন এবং দেশের মুখ উজ্জ্বল করবেন এটাই প্রত্যাশা। নারী শিক্ষা ও নারী উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি অর্জনের স্বীকৃতি হিসেব যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা ‘ গ্লোবাল সামিট অব উইমেন ‘- এর পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘ গ্লোবাল উইমেন লিডারশিপ’ অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘে অনুষ্ঠিত সাধারণ পরিষদের সভায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘ প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড’ পুরস্কারও পেয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।
আজকে বাংলাদেশে যে শিশু জন্মগ্রহণ করবে ২০৪১ সালে তার বয়স হবে ১৯ বছর। এই শিশুটিই হবে আগামীর বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি। ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা শুধু সরকারের লক্ষ্য নয়,বরং উন্নত দেশ হিসেবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকা, যার জন্য প্রয়োজন হবে শারীরিকভাবে সক্ষম ও মানসিকভাবে বুদ্ধিদীপ্ত মানবসম্পদ। সেখানে থাকবেনা কোনো বৈষম্য, নারীর অধিকার নিশ্চিত হবে সকল ক্ষেত্রে, সামাজিক সুরক্ষা পাবে প্রতিটি নাগরিক, দেশ হবে দারিদ্র্য শূন্য, রাষ্ট্র হবে কল্যাণকর এটাই প্রত্যাশা ।
পিআইডি ফিচার