শুধু টক খাবার নয়, অনেক খাবারই রয়েছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
আর এই মহামারীর সময়ে যখন সবার মাথাতেই কাজ করছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো নিয়ে তখন নানান ধরনের ভুল ধারণাও ডালপালা ছড়াচ্ছে।
যাচাই বাছাই না করে যে যা উপদেশ দেয় সেটাই অনুসরণ করা শুরু করলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই থাকে বেশি।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এমন খাবার নিয়ে কিছু ভুল ধারণা তুলে ধরা হলো ‘রিয়েলসিম্পল’ ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন অবলম্বনে।
ভিটামিন সি বেশি খেলেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে
‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড ইনফর্মেশন কাউন্সিল’য়ের ব্যবস্থাপক ড. আলি ওয়েবস্টার বলেন, “রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিপূর্ণভাবে কাজ করা জন্য ভিটামিন সি জরুরি একটি পুষ্টি উপাদান। তবে ‘সাপ্লিমেন্ট’য়ের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি গ্রহণ করলেই যে অনেক উপকার পাওয়া যাবে ব্যাপারটা তেমন সহজ নয়।”
এই পুষ্টিবিদ আরও বলেন, “শরীর একসঙ্গে একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় পুষ্টি উপাদান শোষন করে, তাই বেশি খেলেই বেশি উপকার পাওয়া যাবে এমনটা ভাবলে ভুল হবে। প্রাপ্তবয়স্ক নারীর ভিটামিন সি’র চাহিদা দৈনিক ৭৫ মি.লি. গ্রাম আর প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের দরকার হয় ৯০ মি.লি. গ্রাম। এর বেশি যাই গ্রহণ করা হোক না কেনো তা প্রস্রাবের সঙ্গে বেরিয়ে যাবে।”
একটি পুষ্টিকর খাবারেই সব সমস্যার সমাধান
সুস্থ থাকতে হলে চাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস।
ওয়েবস্টার বলছেন, “এমন কোনো ‘সুপারফুড’ নেই যা একাই আপনার স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারবে। স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসে বিভিন্ন ধরনের রঙিন খাবার থাকতে হবে। এর মধ্যে ফল আর সবজি থাকতে হবে বেশি। সেগুলো হতে পারে তাজা, হিমায়িত, কৌটাজাত। তবে তাজাই হতে হবে বেশি।”
প্যাকেট থেকে সংক্রমণ হতে পারে
নিউ ইয়র্ক’য়ের ‘ফিজিশিয়ান’, বিজ্ঞানী ডা. উইলিয়াম লি বলেন, “খাবারের মোড়ক স্পর্শ করার মাধ্যমে জীবাণু সংক্রমণ হয় এমন প্রমাণ নেই। তবে নিরাপদ থাকতে জীবাণুনাশকে ভেজানো কাপড় দিয়ে মোড়ক মুছে নিতে পারেন কিংবা হাতে গ্লাভস ব্যবহার করতে পারেন। ব্যবহারের পর সেই কাপড়টা ধুয়ে ফেলতে হবে কিংবা ‘ডিজইনফেকট্যান্ট ওয়াইপ’ ব্যবহারের পর নিরাপদ স্থানে ফেলতে হবে। আর খাবার স্পর্শ করার পর হাত ভালোভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।”
সিট্রাস বা টক ধরনের ফলই শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর অনন্য উপাদান ভিটামিন সি। যা প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় লেবু, কমলা, আঙুর ইত্যাদি ‘সিট্রাস’ ফল থেকে। তবে অন্য খাবার যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারেনা এমনটা ভাবলে ভুল হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সনদ স্বীকৃত পুষ্টিবিদ ব্রিয়ানা রড্রিগেজ বলেন, “এই ফলগুলো সহজেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়, খাওয়ার ঝামেলা নেই বললেই চলে। তবে আরও অনেক খাবার আছে যা থেকে একই উপকার পাওয়া সম্ভব।”
‘রেড পেপার’ বা লাল মরিচে মাত্র আধা কাপে যে পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে তা একজন মানুষের গড় দৈনিক চাহিদার ১৫০ শতাংশ।
রসুনের ‘সালফিউরিক’ উপাদান রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে জোরদার করতে অনন্য।
গাজর চোখের জন্য অত্যন্ত উপকারী হিসেবে সুপরিচিত। তবে তাতে যে পরিমাণ ভিটামিন এ থাকে, তা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার জন্যও উপকারী।
রোগীদের মুরগির মাংসের সুপ খাওয়া পরামর্শ বিনা কারণে দেওয়া হয় না। শরীরে পানি যোগানো পাশাপাশি এতে থাকে দস্তা, যা প্রদাহ থেকে সুরক্ষিত রাখার জন্য জরুরি একটি উপাদান।
আর থাকে ভিটামিন বি-সিক্স, যা নতুন লোহিত রক্তকণিকা তৈরির জন্য প্রয়োজনীয়।
খাবার আর ভিটামিনই শুধু রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো হাতিয়ার
রড্রিগেজ বলেন, “স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলার পাশাপাশি দৈনিক জীবনযাত্রাতেও নানান পরিবর্তন আনতে হবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করতে চাইলে।”
বিশ্রাম তাদের মধ্যে একটি। প্রতিদিন সাত থেকে নয় ঘণ্টার নির্ভেজাল ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।
মানসিক চাপ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে গভীরভাবে। বর্তমান সময়ে কাজ, ভবিষ্যত, মহামারী এসব নিয়ে দুশ্চিন্তায় মানসিক চাপ সবারই বেশি।
তবে সুস্থ থাকতে হলে যেভাবেই হোক মানসিক চাপকেও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, “রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য শরীরচর্চার গুরুত্ব বলে শেষ করা সম্ভব নয়। ঘরে, বাইরে, পার্কে, ব্যায়ামাগারে যেখানেই হোক, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হলে নিয়মিত শরীরচর্চা করতেই হবে। পাশাপাশি মদ্যপান, ধূপমান ইত্যাদি বদোভ্যাস ত্যাগ করতে হবে।”
ভেষজ ওষুধ সবার জন্য উপকারী
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক সনদপ্রাপ্ত পুষ্টিবিদ লিজি সুইক বলেন, “রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নয়নে ভেষজ ওষুধের যথেষ্ট গুনাগুন আছে অনেক। তবে তা সবার ক্ষেত্রে সমানভাবে কার্যকর হয় না। শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে এই ভেষজ উপাদানগুলো মানুষভেদে ভিন্ন প্রভাব তৈরি করে। তাই অন্যকারও ভেষজ চিকিৎসা বা পরামর্শ নিজের ওপর প্রয়োগ করলেই যে উপকার পাওয়া যাবে এমনটা মনে করলে ভুল হবে। নিজের শরীরের অবস্থা অনুযায়ী বিশেষায়িত পরামর্শ নিতে হবে অভিজ্ঞ ভেষজ চিকিৎসকের কাছ থেকে।”
বিশেষ কিছু পুষ্টি উপাদানই যথেষ্ট
সুইক বলেন, “ভিটামিন সি, দস্তা ইত্যাদি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো জন্য হয়ত বেশি জরুরি, তবে অন্যান্য উপাদানগুলো বাদ পড়ে গেলে ঘাটতি থেকেই যাবে। আর শুধু ‘সাপ্লিমেন্ট’ দিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো যায় না।”
“স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস মেনে চলতে হবে সবার আগে, পরবর্তী সময়ে বিশেষ কিছু পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণের জন্য ‘সাপ্লিমেন্ট’ বেছে নিতে হবে। আর প্রয়োজনীয় উপাদানগুলে দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করতে থাকলে ওই উপাদানটাই হতে পারে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হওয়া কারণ।”
স্পোর্টস ড্রিংকস রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য আবশ্যক
‘নিউট্রিবুলেট ডটকম’য়ের পুষ্টিবিদ ম্যাকেনজি জোন্স বলেন, “কৃত্রিম রং আর চিনি দিয়ে তৈরি হয় অধিকাংশ ‘স্পোর্টস ড্রিংকস’, ‘এনহ্যান্সড ওয়াটার’। আর এগুলো একজন মানুষ সারাজীবনে একবারও যদি গ্রহণ না করেন তাতেও কোনো ক্ষতি হবে না। দীর্ঘমেয়াদে স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমেই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী হয়।”
কৌটাজাত খাবার মানেই ক্ষতিকর
‘নিউট্রিবুলেট’য়ের আরেক পুষ্টিবিদ শিরিন চৌ বলেন, “হিমায়িত ও কৌটাজাত ফলের তুলনায় তাজা ফলকে সবসময়েই উত্তম ধরা হয়। তাই বলে হিমায়িত কিংবা কৌটাজাত ফল যে উপকারী নয় তা কিন্তু না।”
একটি ফল যে সময়ে সবচাইতে খাওয়ার উপযোগী সেই সময়ে তা সংগ্রহ করে হিমায়িত কিংবা কৌটাজাত করা হয়। ফলে সেখান থেকেও ভালো পরিমাণে পুষ্টি উপাদান পাওয়া সম্ভব।
বিডিনিউজ