তথ্য প্রযুক্তির যুগে জনগণকে তথ্য প্রদান নিশ্চিত করতে হবে

ইমদাদ ইসলাম: অধিকার আইন, ২০০৯ এর ৮(১) ধারা অনুসারে জনৈক আবুল হাশিম, প্রাক্তন সাব পোস্টমাস্টার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় উপ-ডাকঘর  ০৬.১০.২০২০ তারিখে  ডাক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত তথ্য কর্মকর্তার বরাবর রেজিষ্ট্রিকৃত ডাকযোগে মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট তার ১৫.০৯.১৯৮৮ তারিখের দাখিলকৃত রিভিশন পিটিশন পরবর্তী সুদীর্ঘ ৩২(বত্রিশ) বৎসর অতিবাহিত হলেও তিনি প্রতিনিয়ত ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করা সত্ত্বেও অদ্যাবধি কোন সিদ্ধান্ত না পেয়ে শারিরীক, মানসিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দায়ী কর্মকর্তার নাম, পদবীসহ পূর্নাঙ্গ ঠিকানা লিখিতভাবে জানাতে আবেদন করেন।

ডাক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই) অভিযোগকারীকে “সংশ্লিষ্ট কাগজপত্রাদি বিশ্লেষণ ও সংশ্লিষ্ট সার্কেল হতে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনাপূর্বক এতদসংক্রান্ত বিষয়ে কোনো কর্মকর্তা দায়ী নয় মর্মে পরিলক্ষিত হয়” মর্মে একটি জবাব প্রেরণ করেন। উক্ত জবাবে সন্তুষ্ট হতে না পেরে অভিযোগকারী  সচিব, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় বরাবর রেজিষ্ট্রিকৃত ডাকযোগে আপীল আবেদন করেন। আপীল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপীল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক তথ্য অধিকার (তথ্যপ্রাপ্তি সংক্রান্ত) বিধিমালা-২০০৯ এর বিধি ৪(২), বিধি ৪(৩) ও বিধি ৬(২) এর আলোকে ডাক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার গৃহীত কার্যক্রম যথাযথ হওয়ায় আপীল আবেদনটি তথ্য অধিকার আইন এর অনুচ্ছেদ ২৪(৩)(খ) মোতাবেক খারিজ করে অভিযোগকারীকে জানিয়ে দেয়। উক্ত আদেশে সংক্ষুদ্ধ হয়ে এবং তথ্য না পেয়ে অভিযোগকারী তথ্য কমিশনে অভিযোগ দায়ের করে।

তথ্য কমিশনের অভিযোগটি পর্যালোচনান্তে শুনানির জন্য গ্রহণ করে অভিযোগকারী এবং সংশ্লিষ্ট পরিচালক (ডাক) ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), মহাপরিচালক, ডাক অধিদপ্তর; যুগ্মসচিব ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (আরটিআই), ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ; অতিরিক্ত সচিব, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগ, ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ সচিবালয়সহ মোট পাঁচ (০৫) জনের প্রতি সমন জারি করে। তথ্য কমিশন উভয়পক্ষের বক্তব্য ও দাখিলকৃত প্রমাণাদি পর্যালোচনান্তে অভিযোগকারীর চাহিত তথ্য ৩২ বছর ধরে বিলম্ব করা হয়েছে এটা সংশ্লিষ্টদের অকর্মন্যতার পরিচয় বহন করে যা মোটেও কাঙ্খিত নয় মর্মে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং আবেদনকারীর চাহিত হালনাগাদ তথ্য  দেওয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দিয়ে অভিযোগটি নিষ্পত্তি করেন।

তথ্য কমিশন সূচনালগ্ন থেকে জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তথ্য অধিকার আইন,২০০৯ এর ধারা ২৫ এর আলোকে দেশের নাগরিকগণ তথ্য না পেয়ে কমিশনে অভিযোগ দায়ের করতে পারেন এবং তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার পর থেকে নাগরিকদের অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করে আসছে। কমিশন অনেক ক্ষেত্রে স্ব-প্রণোদিতভাবেও অভিযোগ অনুসন্ধান ও নিষ্পত্তি করে আসছে । ২০০৯ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য কমিশনে ৪৩২৭টি অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তন্মধ্যে ২৫৪৯টি অভিযোগ কমিশন কর্তৃক শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু করোনা ভাইরাস সংক্রান্ত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় প্রচলিত পদ্ধতিতে শুনানি গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, সাধারণ মানুষের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকল্পে জনস্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দিয়ে তথ্য কমিশনে দায়েরকৃত অভিযোগসমূহ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণের লক্ষ্যে ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণ শুরু হয়।

দায়েরকৃত অভিযোগগুলোর মধ্যে শুনানির জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি এরূপ ১৩০টি অভিযোগের মধ্যে ১২৫টি অভিযোগ অভিযোগকারীকে তার আবেদনে পরিলক্ষিত আইনগত ও অন্যান্য ত্রুটি বিচ্যুতি, পত্র মারফৎ অবহিত করা হয়েছে এবং পরবর্তীতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে অভিযোগ দাখিলের বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণের মাধ্যমে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা ৫৪ এবং স্ব-শরীরে উপস্থিতিতে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা ০৮টি সহ মোট নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগ সংখ্যা ৬২। ২০২০ সালের ৯৭টি অভিযোগের বিষয়ে ২০২১ সালে শুনানি গ্রহণ করা হয় এবং নিষ্পত্তি করা হয়। ০১ জানুয়ারি, ২০২১ থেকে ৩১ ডিসেম্বর, ২০২১ তারিখ পর্যন্ত তথ্য কমিশনে মোট ৪৬৩টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এরমধ্যে ২৩৪টি অভিযোগ শুনানির জন্য গ্রহণ করা হয়। তন্মধ্যে ২৩০টি অভিযোগ  ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে এবং ০৪ টি অভিযোগ শারীরিক উপস্থিতিতে শুনানি  করা হয়।

তথ্য কমিশন দেশের নাগরিকদের তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সব সময়ে সচেষ্ট। ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণের ক্ষেত্রে নানারকম সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়েছে তথ্য কমিশনকে। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানি গ্রহণ ও অভিযোগ নিষ্পত্তির মাধ্যমে তথ্যের অবাধ প্রবাহকে গতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণের কারণে পক্ষগণ দেশের দূরবর্তী প্রান্তে অবস্থান করলেও তাদের স্ব-স্ব অবস্থান থেকে ভার্চুয়াল শুনানিতে অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন। যার ফলে একদিকে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শুনানিতে অংশগ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে এবং অপরদিকে দেশের প্রান্তিক এলাকা থেকে তথ্য কমিশনে হাজিরার প্রয়োজন না থাকায় জনগণের অর্থনৈতিক সাশ্রয় সম্ভব হয়েছে। এ পদ্ধতিতে শুনানিতে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণে মাঠ পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কমিটি এবং ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার ও পৌরসভা ডিজিটাল সেন্টারের সহযোগিতা গ্রহণ করা হয়েছে।

তথ্য অধিকার আইনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে (ক) তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে তথ্য কমিশন কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আইনটি পাস হওয়ার এবং তথ্য কমিশন প্রতিষ্ঠার এক যুগ অতিবাহিত হলেও দেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় এই আইনটির চর্চা খুবই সীমিত। সমগ্র জনগণকে আইনটি সম্পর্কে যথাযথভাবে অবগত করা সম্ভব হয়নি তথ্য কমিশনের সীমিত জনবল এবং সীমিত অবকাঠামোর কারণে। (খ) Official Secrecy Act, 1923 – এই আইনটি দাপ্তরিক গোপনীয়তা বজায় রাখা সংক্রান্ত। তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ সালে পাস হলেও  Secrecy Act দীর্ঘদিন ধরে অনুশীলনের কারণে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের  মাঝে  দাপ্তরিক  গোপনীয়তা  বজায় রাখার প্রবণতাটি এখনও বিদ্যমান রয়েছে যা তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে  প্রতিবন্ধকতা  হিসেবে কাজ করছে। (গ) তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষসমূহের  কার্যকরী  পদক্ষেপ  গ্রহণের  নিমিত্ত  কোনো  আর্থিক বরাদ্দ না থাকায় প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানো সম্ভব হয় না।

(ঘ) তথ্য অধিকার আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষসমূহের স্ব-প্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু অধিকাংশ অফিসে অজ্ঞতার কারনে সঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ সম্ভব হয় না ফলে ‘স্ব-প্রণোদিত’ তথ্য প্রকাশের বিষয়ে কর্তৃপক্ষসমূহ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। (ঙ) তথ্য অধিকার আইনে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করেছে, সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তথ্য প্রদানে যথাযথ সুযোগ-সুবিধা যেমন- অন্যান্য কর্মকর্তাগণের যথাসময়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত  কর্মকর্তাকে সঠিক তথ্য সরবরাহকরণসহ দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয়  লজিস্টিক  সরবরাহে  সীমাবদ্ধতা রয়েছে। (চ) তথ্য কমিশন সময়ে সময়ে জনঅবহিতকরণ সভার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে। তদুপরি সমগ্র দেশের তৃণমূল পর্যায়ের  জনগণ এখনও এই আইন সম্পর্কে অবগত নয়। (ছ) তথ্য অধিকার বাস্তবায়নে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা কমিটিসমূহ  মাঠ পর্যায়ে তথ্য অধিকার বাস্তবায়ন, মনিটরিং, প্রশিক্ষণ এবং তথ্য অধিকার বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের অভাব রয়েছে। (জ) বর্তমান যুগ তথ্য-প্রযুক্তির যুগ। এ সময়ে বিভিন্ন সেক্টরে প্রযুক্তির বহুল প্রয়োগ শুরু হলেও তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে Online Tracking System সহ তথ্য প্রযুক্তির কার্যকরী প্রয়োগ পুরোপুরি সম্ভব হয়নি। (ঝ) সারা বিশ্ব কোভিড-১৯ মহামারির ভয়াল থাবায় আক্রান্ত। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অনলাইনে জুম অ্যাপ্স এর মাধ্যমে ভার্চুয়াল শুনানি গ্রহণের মাধ্যমে অভিযোগ নিষ্পত্তি করা সম্ভব হলেও এই প্রযুক্তি ব্যবহারে সাধারণ মানুষের এখনো সেভাবে সক্ষমতা তৈরি হয়নি।

তথ্য অধিকার আইন ২০০৯ এর মূল লক্ষ্য হলো তথ্যের অবাধ প্রবাহ ও জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণ। এর মাধ্যমে জনগণের তথ্য প্রাপ্তির একটি আইনি ভিত্তি তৈরি হয়েছে। সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দুর্নীতিমুক্ত দায়িত্ব পালন তথা সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়েছে। তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বজায় রাখতে তথ্য কমিশন একনিষ্ঠভাবে কাজ করে গেলেও এই প্রবাহমানতা বজায় রাখার দায়িত্ব সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের। সকল প্রতিষ্ঠান তাদের স্ব স্ব তথ্য উন্মোচনের মাধ্যমে এই প্রবাহ বজায় রাখলে তবেই এই আইনটির প্রণয়ন সফল হবে, তৈরি হবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি, প্রতিষ্ঠা পাবে সুশাসন। আর এই স্বচ্ছতা , জবাবদিহি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ,যেখানে থাকবে না কোন বৈষম্য,সবার জন্য সমান অধিকার।

পিআইডি ফিচার

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

13 − 9 =