বিশ্বজুড়েই ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশসহ বিশ্বে প্রতি সাত সেকেন্ডে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে— ‘ডায়াবেটিস আছে এমন রোগীদের অন্তত ৫০ শতাংশ জানেন না তাদের ডায়াবেটিস আছে। এ কারণে ডায়াবেটিস সম্পর্কে সবার সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।’
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) তথ্যমতে— বর্তমানে বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লাখেরও বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যাদের প্রায় অর্ধেকই নারী। কিন্তু আক্রান্তদের অর্ধেকেরও বেশি মানুষই জানেন না তাদের ডায়াবেটিস আছে। এমনকি দেশে ১০০ জনের মধ্যে ২৬ জন নারীই গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে ভোগেন। আবার তাদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই পরবর্তীকালে টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের মত অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশেও এ চিত্র বিরাজ করছে।
এমন পরিস্থিতিতে ডায়াবেটিস সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে বিশ্বের মতো সোমবার (১৪ নভেম্বর) দেশেও পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস-২০২২’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য- ‘আগামীতে নিজেকে সুরক্ষায় ডায়াবেটিসকে জানুন।’ দিনটি উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকায় বাংলাদেশসহ বিশ্বে রোগটি ক্রমশ বাড়ছে। এটি প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আগামীদিনে নিজেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বাণীতে বলেন, ডায়াবেটিস একটি প্রতিরোধ ও নিরাময়যোগ্য রোগ। তবে, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) নানামুখী কাজ করছে। সরকার টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে ইনসুলিন দিতে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
এ বিষয়ে বাডাসের সভাপতি ও জাতীয় অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান বলেন, মানবদেহে কোনো কারণে ইনসুলিন নামক হরমোনের অভাব বা ঘাটতি হলে, উৎপাদিত ইনসুলিন কার্যকরভাবে শরীরে ব্যবহৃত না হলে বা শরীরের ইনসুলিন নিষ্ক্রিয় থাকলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। এ গ্লুকোজ পরে প্রসাবের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। এ অবস্থাকেই ডায়াবেটিস বলা হয়।
গবেষণায় দেখা যায়— গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারীদের ও গর্ভস্থ শিশুদের টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গর্ভকালীন ডায়াবেটিস যদি নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাদের পরবর্তী সময়ে টাইপ-২ ডায়াবেটিস ঝুঁকি আরও বেশি। এ অবস্থায় পরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভকালীন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস অনেকাংশেই প্রতিরোধ সম্ভব। তাই যাদের ডায়াবেটিস আছে, তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার বিষয়ে সচেতন করা দরকার। যাদের এখনো হয়নি তাদের প্রতিরোধে সচেতন হতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বে এমন পরিবার নেই যে পরিবারে অন্তত একজন ডায়াবেটিক রোগী অথবা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছেন এমন মানুষ নেই। পরিবারকে ডায়াবেটিস থেকে রক্ষায় সচেতনতা তৈরি করতে হবে। ডায়াবেটিস সারাজীবনের রোগ, একবার হলে তা কখানো সারে না। তবে, ৭০ শতাংশ পর্যন্ত প্রতিরোধযাগ্য ও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য। এজন্য ডায়াবেটিস প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিগুলো জানতে হবে।
আইডিএফ ডায়াবেটিস এটলাস-২০২১ এর তথ্যানুযায়ী— ২০২১ সালে ৫৩ দশমিক ৭ কোটি মানুষ (প্রতি ১০ জনে ১ জন) ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিলেন। ২০৩০ সালের মধ্যে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৪ দশমিক ৩ কোটিতে এবং ২০৪৫ সালে ৭৮ দশমিক ৩ কোটিতে পৌঁছাতে পারে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ২৪ কোটি মানুষ (প্রতি দুইজনে একজন) জানে না তারা রোগটিতে আক্রান্ত হয়েছেন (নির্ণয়হীন)। তাদের অধিকাংশই টাইপ-২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্তদের চারজনের মধ্যে তিনজনেরও বেশি মানুষ নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশেগুলোতে বাস করেন।
আইডিএফ পরিসংখ্যান আরও বলছে— বিশ্বে প্রায় ২ কোটি নারী (প্রতি ছয়জনে একজন) গর্ভাবস্থায় হাইপোগ্লাইসেমিয়ায় (উচ্চ রক্তের গ্লকোজ) আক্রান্ত হয়। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ শহরাঞ্চলে বাস করেন এবং তিন চতুর্থাংশ কর্মজীবনকালের। ১২ লাখেরও বেশি শিশু ও কিশোর (০-১৯ বছর) টাইপ-১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ২০২১ সালে বিশ্বে ৬৭ লাখ মানুষের ডায়াবেটিসের কারণে মৃত্যু হয়েছে। ২০২১ সালে ৯৬৬ বিলিয়ন ডলার স্বাস্থ্যব্যয় হয় ডায়াবেটিসের কারণে। যা বৈশ্বিক স্বাস্থ্যখাতে মোট ব্যয়ের ৯ শতাংশ।
বাডাসের মহাসচিব মোহাম্মাদ সাইফ উদ্দিন বলেন, ‘দেশে যে হারে ডায়াবেটিসের রোগী বাড়ছে, তাতে আশঙ্কা করা হচ্ছে আগামী ২০৪৫ সালে আক্রান্তের সংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ হবে। তবে ডায়াবেটিক সমিতি রোগটি প্রতিরোধে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও টেকসই কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। গর্ভকালীন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর জন্য ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা’ নামে একটি বিশেষ প্রকল্প নিয়েছি। এ লক্ষ্যে ৪০০ কাজীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা পরিকল্পিত গর্ভধারণের ব্যাপারে নবদম্পতিদের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। সারাদেশে স্থাপিত ৫৪টি ‘গর্ভধারণ-পূর্ব সেবা কেন্দ্র’ থেকে নারীরা স্বল্পমূল্যে গর্ভধারণ সংক্রান্ত সেবা নিতে পারছেন। সারাদেশে প্রশিক্ষিত ৪০০ কাজী ও ৩০০ ইমাম এ কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছেন।
গর্ভবতী মায়েদের অপুষ্টি থাকলে তাদের সন্তানদের ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস আক্রান্তের ঝুঁকি অনেক বেশি। ফলে বিয়ের সময় মেয়েদের এ ব্যাপারে সচেতন করতে পারলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে অনেক ভালো ফল পাওয়া যাবে। এ কর্মসূচির মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ’গর্ভধারণ- পূর্ব সেবা’ নিশ্চিত করতে পারলে প্রসবকালীন নারী ও শিশুমৃত্যুর হার কমানো এবং নারীসহ আগামী প্রজন্মকেও ডায়াবেটিসের ভয়াবহ প্রকোপ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
দিবসটি উপলক্ষে প্রতিবারের মতো এবারও ডায়াবেটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে বাডাস। দেশব্যাপী সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফলেট বিতরণ করা হবে।