সালেক সুফী
প্রতিবেদন যখন লিখছি কাতারের মরুর বুকে বিশেষভাবে নির্মিত বিশ্বের সেরা ক্রীড়ার আসর ২২ম বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট শুরু হতে ২৪ ঘণ্টা বাকি। শুরু হতে চলেছে বিপুল ব্যয়ের অনেক নতুন সংযোজনের ৩২ দলের অংশগ্রহণে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতা। বিশ্বকাপ নিয়ে ইতিমধ্যেই সারা বিশ্ব ফুটবল জ্বরে আক্রান্ত। অন্যান্য দেশের চেয়েও বেশি উন্মাদনা বাংলাদেশে, শহরগুলিতে তো কথাই নেই। গ্রামেগঞ্জে চলেছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, জার্মানি নিয়ে উত্তেজনা, উন্মাদনা। প্রিয় দলের পতাকায় ছেয়ে গাছে মাঠ ঘাট পথ প্রান্তর। রীতি মতো মিছিল করছে ভক্ত অনুরাগীরা প্রিয় দলের পতাকা ব্যানার নিয়ে। হয়তো খোদ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনায় বাংলাদেশের মতো এতো পতাকার দেখা মিলবে না। চার বছর পর পর বসে ফুটবল মহাযজ্ঞ। বাংলাদেশের ফুটবল আবেগ হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
২০ নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত চলবে খেলা। ১৯৩০ থেকে শুরু হয় ফুটবল বিশ্বকাপের আসর ১৯৪২ এবং ১৯৪৬ অনুষ্ঠিত হতে পারেনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে। এযাবৎ অনুষ্ঠিত ২১ বারের আয়োজনে সর্বাধিক ৫ বার জয়ী হয়েছে সর্বকালের সর্বযুগের অন্যতম সেরা দল ব্রাজিল। ৪ বার করে জিতেছে ইতালি আর পশ্চিম জার্মানি, দুইবার করে জিতেছে উরুগুয়ে, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, একবার করে ইংল্যান্ড আর স্পেন। বিশ্বকাপ ২০২২ প্রথমবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে মরুভূমির বুকে একটি মুসলিম প্রধান দেশে শীত মৌসুমে। খেলোয়াড় আর দর্শকদের স্বস্তি দিতে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত নির্মাণ কৌশলে ৮টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হয়েছে। মুসলিম দেশ বলে মাদক দ্রব্য গ্রহণ, মেয়েদের খোলা মেলা পোশাকে মাঠে উপস্থিতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জ্বালানি সমৃদ্ধ ক্ষুদ্র কাতার ফুটবল সমাজকে বিনোদন দেয়ার সবধরণের আয়োজন করেছে। আশা করা যাচ্ছে, বিশ্ব জোড়া কোটি কোটি ফুটবল প্রেমী নানাভাবে ফুটবল যজ্ঞ উপভোগ করবে।
বরাবরের মতো এবারেও বিশেষজ্ঞ মহল, অনুরাগীরা নানা ধরনের পর্যালোচনা, বিশ্লেষণ করছে সম্ভাব্য বিশ্বজয়ী নিয়ে। উন্নয়নশীল তৃতীয় বিশ্বের মানুষ সঙ্গত কারণেই ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা দুই শিবিরে বিভক্ত। যাদের বয়স ৪০ বা তার বেশি তারা অধিকাংশ ব্রাজিল ভক্ত। যারা অপেক্ষাকৃত তরুণ তারা ম্যারাডোনা, মেসির কল্যাণে অনেকেই আর্জেন্টিনার অনুরাগী। তবে যারা ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়মিত দেখেন তাদের একাংশ ফ্রান্স, স্পেন,পর্তুগাল, ইংল্যান্ড, নেদারল্যান্ডকেও ভালোবাসেন। কিন্তু এই সংখ্যা কোনোভাবেই ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
পরিসংখ্যান আর বর্তমান ফর্মের বিবেচনায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা অবশ্যই এগিয়ে। তবে বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্স অনেক শক্তিশালী দল। চিরদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী জার্মানি আর বেলজিয়ামকেও অনেকে সম্ভাবনার তালিকায় রাখছেন।
ব্রাজিল একমাত্র দল যারা ২১ বিশ্বকাপ আসরে প্রতিবার অংশ নিয়েছে। সর্বাধিক ৫ বারের শিরোপা জয়ের রেকর্ড ওদের, জিতেছে চার মহাদেশে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ আসর থেকে ট্রফি জয়ের একমাত্র অধিকারী ব্রাজিল। পাশাপাশি ব্রাজিল এখন ফিফা র্যাংকিংয়ে সবার উপরে। ২০০২ জাপান থেকে ৫ম বিশ্বকাপ জয়ের পর ২০ বছর অতিবাহিত। এবারে ব্রাজিল ষষ্ঠ বিশ্বকাপ মিশনে তুখোড় দল নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। নান্দনিক ফুটবল কৌশলের অধিকারী পেলে, গারিঞ্চা, রোনালদো, রিভেলিনদের ব্রাজিল এবারের আসরের শীর্ষ ফেভরিট দল।
ব্রাজিলের মতোই অনেকের প্রিয় দল আর্জেন্টিনা। দক্ষিণ আমেরিকার ঐতিহ্যবাহী ফুটবল দেশ আর্জেন্টিনা সর্বকালের অন্যতম সেরা ম্যারাডোনার জাদুকরী নৈপুণ্যে ১৯৭৮ আর ১৯৮৬ সালে জিতেছিল বিশ্বকাপ। কাছাকাছি পৌঁছেও জয় পায়নি ১৯৯০ তে। ফিফা র্যাংকিংয়ে ওদের অবস্থান তৃতীয়। ভিন্ন গ্রহের ফুটবলার লিয়নেল মেসির ভক্তরা খুদে জাদুকরের হাতে বিশ্বকাপ দেখার স্বপ্নে বিভোর। ৩৫ আন্তর্জাতিক ম্যাচে ওরা আছে অপরাজিত। এবার হয়তো মেসির শেষ সুযোগ। কিন্তু ভক্তদের দুঃখের কারণ ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার হয়তো দেখা হয়ে যেতে পারে ফাইনালের আগেই সেমি ফাইনালে। একটি জনপ্রিয় দলকে বাদ পড়তে হবে ফাইনালের আগেই।
১৯৯৮ আর ২০১৮ বিশ্বকাপ জয়ী ফ্রান্স কিন্তু এবারেও অনেক শক্তিশালী দল। ওদের দলে রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলা অনেক তুখোড় ফুটবলার। ফিফা র্যাংকিংয়ে ওদের অবস্থান চতুর্থ। ফ্রান্স গ্রুপ পর্যায়, ১৬ দলের পর্ব পেরিয়ে সেমিফাইনালে পৌঁছালে ওদের হারানো সহজ হবে না।
তিন ফেভারিটদের পাশাপাশি উচ্চারিত হচ্ছে বেলজিয়াম, ইংল্যান্ড, স্পেন, পর্তুগাল আর নেদারল্যান্ডসের নাম। জানিনা আফ্রিকার দেশ ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন অথবা এশিয়ার দেশ কাতার, সৌদি আরব, দক্ষিণ কোরিয়া, কিছু অঘটন ঘটিয়েও দিতেও পারে।
মনে রাখতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের তপ্ত মরুর দেশ কাতারে স্বস্তি পাবে না শীতপ্রধান ইউরোপীয় দেশগুলো। সেই তুলনায় দক্ষিণ আমেরিকা বা আফ্রিকার দেশগুলোর জন্য বাড়তি সুবিধা হবে। বিশ্বকাপ লং ডিসটেন্স দৌড়ের মতো। শিরোপা জয় করতে হলে অবশ্যি দলকে ধারাবাহিক ভাবে ভালো খেলতে হবে। মানসম্পন্ন বিকল্প খেলোয়াড় থাকতে হবে। সেই সূত্রে অনেকেই ভাবছেন ব্রাজিল ও বেলজিয়াম ফাইনাল খেলা হতে পারে এবার।