সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের আহ্বান প্রধানমন্ত্রীর

ঢাকা, ১৮ জুলাই, ২০২৪ (বাসস): প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ব্লু ইকোনমি’কে আরো সম্বৃদ্ধ করার জন্য বিস্তীর্ণ সমুদ্র এলাকায় সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বিনিয়োগের জন্য বিদেশি ও স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

তিনি মাছের রপ্তানি বাড়াতে মাছের সংগ্রহ, বিতরণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণে যথাযথ মান বজায় রাখতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে নির্দেশ দেন। কারণ বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হবে মাছ।

প্রধানমন্ত্রী আজ সকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ’বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াকালচার এন্ড সীফুড শো ২০২৪’ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি’র ভাষণে একথা বলেন।

তিনি বলেন, যারা বিনিয়োগকারি তাদেরকেও আমরা আহবান জানাব। কারণ, আমাদের যে সমুদ্র সম্পদকে ব্যবহার করে আমাদের ‘ব্লু ইকোনমি’কে আরো সমৃদ্ধশালী আমরা করতে পারবো। সীউইড, শামুক, ঝিনুক, মুক্তা প্রভৃতি আহরণ এবং সমুদ্রের পানি থেকে লবন উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি সমুদ্রের পানি থেকে বিদ্যুৎ. হাইড্রো ইলেকট্রিসিটি উৎপাদনেও গবেষণা চলছে। ইনশাল্লাহ আমরা সেটাও করতে পারবো।

সরকার প্রধান বলেন, সমুদ্র সম্পদের বহুমুখি ব্যবহার আমাদের অর্থনীতি ’ব্লু ইকোনমি’কে আমরা আরো সমৃদ্ধশালী করতে পারবো। সেক্ষেত্রে আমি আশাকারি যারা বিনিয়োগকারি, যারা বাংলাদেশে এসেছেন বা যারা আমাদের দেশি বিনিয়োগকারি, আপনারা যৌথভাবে এই বিনিয়োগের ক্ষেত্র আবিস্কার করে এখানে আরো বিনিয়োগ করতে পারেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিডা একটা বিরাট ভূমিকা রাখে। আপনারা তাদের কাছ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা পেতে পারেন এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা অনেক বেশি সুবিধা দিয়ে থাকি। সেখানে যে কেউ বিনিয়োগ করতে পারেন। তার যে লভ্যাংশ সেটা খুব সহজেই তারা নিয়ে যেতে পারেন। পাশাপাশি ব্যাংকের লেনদেনটাও আমরা অনেক বেশি সহজ করে দিয়েছি। সেখানে আপনি অর্থ জমা করে প্রয়োজনে সেটাও নিয়ে যেতে পারেন। অফশোর অ্যাকাউন্ট খোলারও সুযোগ আছে। সেই সুবিধাও সরকার করে দিয়েছে। সেখানে উচ্চহারে সুদও পেতে পারেন। আবার এখানে বিনিয়োগও করতে পারেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই আমি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারিদের সবাইকে আহবান করবো আপনারা আসেন, বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেন। এই সম্পদ আমাদের আরো কাজে লাগান। এটাকে যাতে আমরা আরো বেশি কাজে লাগাতে পারি সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’

সরকার প্রধান বলেন, আজকের এই ‘অ্যাকুয়া কালচার ও সীফুড শো’ নীতি নির্ধারক, রপ্তানিকারক, স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে পারষ্পরিক ব্যবসায়ী সংলাপ এবং নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার একটি প্রাণবন্ত প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। যা পারষ্পরিক বোঝাপড়া, অংশীদারিত্ব, জ্ঞান প্রভৃতি আদান প্রদানের ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ ভুমিকা রাখবে বলেই আমি মনেকরি এবং আশাকারি আমাদের যুব সমাজও আরো বেশি এগিয়ে আসবে। প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে মাছ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে আমাদের যুব সমাজ যতবেশি যুক্ত হবে ততই এই খাতটি আরো এগিয়ে যাবে। এক্ষেত্রে এসএমই ফাউন্ডেশন থেকে সহজ শর্তে ঋণ প্রদানেরও উল্লেখ করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে অ্যাকুয়াকালচার ও সীফুড রপ্তানির সম্ভাবনার আলোকে একটি প্রামান্য চিত্রও প্রদর্শিত হয়।

মৎসও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী মো. আব্দুর রহমান অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি শ ম রেজাউল করিম ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব সৈয়দ মাহমুদ বেলাল হায়দার স্বাগত বক্তৃতা করেন। জার্মান ভিত্তিক প্লানকোয়াডর‌্যাট এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মার্টিন গেসকেস এবং বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুড এক্সপোটার্স এসোসিয়েশনের (বিএফএফইএ) সভাপতি কাজী বেলায়েত হোসেন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।

আলোচনা পর্ব শেষে প্রধানমন্ত্রী ‘অ্যাকুয়া কালচার ও সীফুড শো’ এর বিভিন্ন স্টল ঘুরে দেখেন।

১৭জুলাই থেকে ১৯ জুলাই পর্যন্ত ঢাকার বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াকালচার এ্যান্ড সীফুড শো শুরু হয়েছে। তিন দিনব্যাপী এই আয়োজনে অ্যাকুয়াকালচার ও সীফুড সম্পর্কিত বিভিন্ন সেশন অনুষ্ঠিত হবে যেখানে বাংলাদেশের মৎস্য খাতের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে আলোচনা হবে। এই আয়োজনে ১২টি দেশের ৫৪ টি স্টল রয়েছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা), মৎস্য অধিদপ্তর, সলিডারিডাড নেটওয়ার্ক এশিয়া ‘বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাকুয়াকালচার অ্যান্ড সীফুড শো-২০২৪’ এর আয়োজন করেছে। এই আয়োজনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোটার্স এসোসিয়েশন সহযোগিতা করছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় জিডিপিতে মৎস খাতের অবদান ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ এবং কৃষিখাতে জিডিপিতে ২২ দশমিক ২৬ শতাংশ, আর তার নিজের খাতে জিডিপিতে অবদান ২ দশমিক ৮১ শতাংশ। কিন্তু বহু মানুষ প্রায় ২ কোটি মানুষ এই মৎস উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ।

মৎস চাষে ব্যবসায়ীদের পৃথক বরাদ্দ প্রদানসহ নানা সুযোগ সুবিধা প্রদানের উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, আমাদের যুব সমাজ বা ইয়াং জেনারেশনকে বলবো, তারাও এই মৎস চাষের দিকে নজর দিতে পারে। কারণ, আমাদের নদী-নালা, খাল, বিল এত বেশি। আর আমাদের মাটি এবং পানি দুটোই অত্যন্ত উপযুক্ত।

তাঁর সরকারের জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বিশাল সমুদ্র এলাকা অর্জনের প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, তবে এতবড় সমুদ্র সীমা অর্জনের পরও ডিপ সী থেকে মৎস আহরণের এখনও তেমন কোন ব্যবস্থা নিতে পারিনি। অনেক চেষ্টার পর দুই চারজন ব্যবসায়ী যারাই আসে তারাও বোধ হয় এই খাতে অর্থ বিনিয়োগ করতে চান না। এই জন্যই আমাদের দরকার বিদেশি বিনিয়োগ। এটা হলো বাস্তবতা। তাহলেই এটা হয়তো আমরা করতে পারবো।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এখন ‘ব্লু ইকোনমি’ ঘোষণা দিয়েছি। তেল, গ্যাস প্রভৃতি খনিজ সম্পদের পাশাপাশি এই সমুদ্র সম্পদও আমাদের আহরণ করতে হবে। গভীর সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ, সী উইডটাও খুব খুরুত্বপূর্ণ। যেটার আমরা পরীক্ষামূলকভাবে কিছুটা চাষ শুরু করেছি। সামনে যদি এটা আরো বাড়াতে পারি তাহলে সেখানে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। গভীর সমুদ্র থেকে সম্পদ আহরণ ও কাজে লাগানোর কাজে আমাদের আরো মনোনিবেশ করতে হবে।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সীফুড এবং অ্যাকুয়াকালচার সেক্টর যাতে বৈশ্বিক বাজারে স্থান পায় বা সেই স্টান্ডার্ড নিয়ে করতে পারি, সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে নজর দেওয়া দরকার। কারণ, তিনি দেখেছেন বিশ্বে সী-ফুডের চাহিদা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে যারা খুব বেশি মাংস খেত তারা এখন মাছের দিকে ঝুঁকছেন। কাজেই এটাকে যদি আমরা ভ্যালু এডেড করতে পারি তাহলে আমরা আরো বেশি মাছ রপ্তানি করতে পারবো।

সরকার প্রধান বলেন, আমরা চিংড়িসহ কিছু অন্যান্য মাছ রপ্তানি করি। সেই সাথে আমাদের সমুদ্রের মাছ এবং দেশিয় মাছগুলোকে প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানি করতে পারলে সেখানে বিরাট একটা সুবিধা আমরা পাব।

শেখ হাসিনা বলেন, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃত ব্লাক টাইগার, বাগদা চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে ভোক্তাদের কাছে অনেক জনপ্রিয়। এখন নতুন ধরনের অনেক মাছ এসে গেছে সেগুলোও আমাদের দেখতে (রপ্তানির জন্য) হবে।

তিনি বলেন, বিশ^ বাজারে মাছ রপ্তানি করতে হলে মাছের গুণগত মান বজায় রাখতে হবে এবং মানসম্পন্ন হতে হবে। সামুদ্রিক মৎসজাত পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য মাছের উৎপাদন, সংরক্ষণ, পরীক্ষণ এবং রপ্তানি চেইনে সর্বত্র কঠোরভাবে গুনগত মান নিশ্চিত করার আমরা উদ্যোগ নিয়েছি।

সরকার টেস্টিং এবং প্যাকেজিং এর গুণগত মানবৃদ্ধিতে পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সেই জন্য সরকার টেস্টিং ল্যাবেরেটরি যেমন করে দিয়েছে, চিংড়ি এবং ইলিশ গবেষণাও তেমনিভাবে ইনষ্টিটিউট করে দিয়েছে।

’৯৬ সালে তাঁর দল সরকারে আসার আগে রপ্তানি ক্ষেত্রে কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা ঘটায় বিশ্বে বাজার নষ্ট হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন আর সেই সমস্যা নেই।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বলেছিলেন- ‘মাছ হবে দেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারি সম্পদ’। কাজেই আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকেই মৎস সম্পদের টেকসই উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তরিকভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই খাতটা যাতে আরো অবদান রাখতে পারে সে ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অনুকূল জলবায়ুর পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় মৎস চাষের একটা আদর্শ পরিবেশ রয়েছে। আর সেটা আমরা আরো উন্নত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি এবং অনেকটা সাফল্য অর্জন করেছি এবং আরো করবো ভবিষ্যতে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

15 − nine =