শেষ হলো পদ্মা সেতু নির্মাণযজ্ঞ

সালেক সুফী

আমরা পদ্মা পাড়ের মানুষ বুঝতে পারি সেতু নির্মাণ আমাদের অবহেলিত জীবনে কি আশীর্বাদ নিয়ে এসেছে। আমাদের ভাঙ্গার মানুষদের একসময় বলা হতো ছাতি সারা ইঞ্জিনিয়ার। নানা ভাবে অবজ্ঞা অবলহেলার পাত্র ছিলাম। শুধু আমরা ভাঙ্গা, ফরিদপুর কেন গোটা দক্ষিণ বাংলা ছিল অবহেলিত অঞ্চল।

সেই দক্ষিণ বাংলা এখন জেগে উঠেছে পদ্মা সেতুর সফল সফল বাস্তবায়নে। পাল্টে গেছে জীবনধারা। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের সঙ্গে গড়ে উঠেছে বাধাহীন যোগাযোগ ব্যবস্থা। অনায়াসে ভ্রমণ করেছি ঢাকা থেকে পটুয়াখালী পায়রা, ঢাকা থেকে সাতক্ষীরা একাধিকবার।

নিজেদের অর্থে পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ জাতিকে আত্মবিশ্বাসী করেছে। আর এই দুরূহ কাজটি সম্পাদন করার প্রজ্ঞা, সাহস এবং দৃঢ়তা দেখানোর জন্য বঙ্গবন্ধু কন্যাকে টুপি খোলা কুর্নিশ, আন্তরিক ভালোবাসা, অভিনন্দন।

তথাকহিত দুর্নীতির অভিযোগ এনে একে একে বিশ্বব্যাংক, এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিশ্রুত অর্থায়ন থেকে সরে যাবার পরে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বিষয়ে সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যখন পদ্মা সেতু প্রকল্প বিষয়ে অভিযোগ তোলা হয় তখন পর্যন্ত একটি কানাকড়ি ছাড় করা হয়নি।

পরামর্শক নির্মাণ বিষয়ে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ কানাডার আদালতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আজ রেল সংযোগ, গ্যাস সঞ্চালন লাইন এবং পাশাপাশি বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন সঙ্গী করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে দাঁড়িয়ে আছে সগৌরবে পদ্মা বহুমুখী সেতু।

‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’  মহামানব বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক উচ্চারণ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। বরিশাল, খুলনার  প্রান্তিক অঞ্চল এখন রাজধানী ঢাকার পাশের ঘরের প্রতিবেশী। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে পদ্মা সেতু এখন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

যারা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু নির্মাণ অলীক স্বপ্ন বলে কুৎসা রটিয়েছে তাদের মুখে চুনকালি দিয়ে বাস্তব সত্য হয়ে দাঁড়িয়ে পদ্মা সেতু। শুধু সড়ক সেতু নয় এখন চালু হয়েছে রেল সংযোগ। ঢাকা থেকে রেলযোগে ভাঙ্গা-ফরিদপুর হয়ে রেল যাচ্ছে দক্ষিণবঙ্গে, অচিরে রেল যাবে যশোর হয়ে কলকাতায়।

অনেকে প্রশ্ন তোলেন খরচ নিয়ে। তারা হয়তো জানেন না প্রমত্তা পদ্মা নদীর উপর সেতু নির্মাণে কত কারিগরি ঝুঁকি এবং চ্যালেঞ্জ ছিল। এমনিতেই পদ্মা  নদী দিয়ে বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পানি প্রবাহিত হয়, প্রতি বর্ষায় নদী তলদেশে বিশাল গভীরতার স্কাওয়ারিং হয়। সেতুর পিলারগুলো গভীরতম স্কাওয়ারিংয়ের নিচে স্থাপন করা ছিল অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।

একসময় বেশ কয়েকটি পিলার ডিজাইন অনুযায়ী নির্দিষ্ট গভীরতায় স্থাপন করার পর দেখা গেলো নিচে আরেকটি জল প্রবাহ। তখন পুনরায় ডিজাইন পরিবর্তন করে আরো অনেক বেশি গভীরতায় নেওয়া হলো বেশ কয়েকটি পিলার।

আমাদের প্রিয় শিক্ষক প্রথিতযশা ড. জামিল রেজা চৌধুরীর কাছ থেকে জেনেছি সেতু নির্মাণের অনন্য বৈশিষ্টগুলো। দুরন্ত নদীটিকে বাগে আনতে নদী শাসন ছিল অত্যন্ত জটিল কাজ। তদুপুরি করোনার সময়ে বাস্তবায়নাধীন কাজ চালিয়ে নেওয়া ছিল বিশাল চ্যালেঞ্জ।

সবকিছু মিলিয়ে জেনেশুনে যারা সেতু নির্মাণের ব্যয় বিষয়ে ভারতের ভুপেন হাজারিকা সেতুর সঙ্গে তুলনা করেন তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছেন। সেতু নির্মাণের দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিত্ব সেতু কর্তৃপক্ষের সিনিয়র সচিব খন্দকার আনওয়ারুল ইসলামের কাছে শুনেছি সেতু নির্মাণের চ্যালেঞ্জগুলো।

সেতু হয়ে এখন সর্বোচ্চ পাঁচ ঘন্টায় পৌঁছানো যায় সাতক্ষীরা অথবা পটুয়াখালী। দক্ষিণাঞ্চলে সকল প্রান্তে এখন চার ছয় লেনের সড়ক সম্প্রসারণ চলছে।  অচিরেই পায়রা এবং মংলা বন্দরের সঙ্গে সারা দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো সহজ এবং উন্নত হবে।

মংলা এবং মংলা সমুদ্র বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার মিলন মোহনায় পরিণত হবে। কুয়াকাটা এবং সুন্দরবন এ অঞ্চলের সেরা পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে। গ্যাস, বিদ্যুতের সহজ লভ্যতায় বিকশিত হবে শিল্পাঞ্চল। সবুজ বিপ্লব,কৃষি বিপ্লব ঘটবে দক্ষিণ অঞ্চলে।

সুপারিশ করবো উন্নয়নের নামে যেন দক্ষিণ অঞ্চলের স্বকীয়তা বিসর্জন  দেওয়া না হয়। সর্বত্র যেন সবুজ উন্নয়ন নিশ্চিত করা হয়। বৃহত্তর খুলনা, বৃহত্তর বরিশাল, বৃহত্তর ফরিদপুরকে যেন সুনির্দিষ্ট  আধুনিক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনায় বিকশিত করা হয়।

তাহলেই বাংলাদেশ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনে গড়ে উঠবে। আবারো নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সাহস এবং দুরদৃষ্টির জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক অভিবাদন জানাচ্ছি।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

20 − 12 =