ইরান-ইসরাইল দ্বন্দ্বের ‘আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি’ ঘটাতে দেশ দু’টি ধাপে ধাপে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এই ঘোষণার মধ্যেই রাতভর তেহরানের বিভিন্ন জায়গা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছে। তেহরান থেকে এএফপি এই খবর জানিয়েছে। খবর বাসস।
ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে লিখেছেন, ‘ইসরাইল ও ইরান একটি ‘সম্পূর্ণ ও সর্বাত্মক’ যুদ্ধবিরতিতে পুরোপুরি সম্মত হয়েছে।’
তবে তাৎক্ষণিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দেশের পক্ষ থেকে কোনো আনুষ্ঠানিক নিশ্চিতকরণ পাওয়া যায়নি। গত কয়েকদিনের নজিরবিহীন পাল্টাপাল্টি হামলায় ইরানে শত শত ও ইসরাইলে প্রায় দুই ডজন মানুষ নিহত হয়েছে।
ট্রাম্প জানিয়েছেন, যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। শুরু হবে মঙ্গলবার তেহরানের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৭টা (বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টা) থেকে, প্রথমে ইরানকে একতরফাভাবে সকল সামরিক অভিযান স্থগিত করতে হবে, এর ১২ ঘণ্টা পর ইসরাইলও একই পথে হাঁটবে।
তিনি বলেন, ‘২৪ ঘণ্টা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ১২ দিন ব্যাপী যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তিকে বিশ্ব স্যালুট জানাবে।’
তিনি পোস্টে আরো জানান, দুই দেশই প্রতিটি ধাপে শান্তিপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীল আচরণে সম্মত হয়েছে।
তবে এর মধ্যেই রাতভর তেহরানের উত্তর ও কেন্দ্রীয় অংশে জোরালো বিস্ফোরণের খবর মিলেছে। এএফপির সাংবাদিকরা জানান, সংঘাত শুরুর পর থেকে এটিই ছিল সবচেয়ে প্রবল বিস্ফোরণ।
এই সংঘাতের তীব্রতা আরো বেড়ে, ব্যাপক আকারের রূপ নিতে পারে বলে বিশ্ব নেতারা উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাই যেকোনো ধরনের যুদ্ধবিরতি তাদের জন্য বিশাল এক স্বস্তির কারণ হবে।
ইসরাইল গত ১৩ জুন ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে আকস্মিক ‘প্রতিরোধমূলক’ হামলা চালানোর পর থেকেই দুই দেশ পরস্পরের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে আসছিল।
তখনই ট্রাম্প সতর্ক করেছিলেন, এই পরিস্থিতি একটি ‘বড় ধরনের আঞ্চলিক সংঘাতে’ রূপ নিতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ঘাঁটিতে হামলা: ইরান কাতারে অবস্থিত সবচেয়ে বড় মার্কিন সামরিক ঘাঁটি ‘আল উদেইদ’-এ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কয়েক ঘণ্টা পর ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। তবে ট্রাম্প এই হামলাকে ‘খুবই দুর্বল’ বলে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উড়িয়ে দেন।
সহিংসতা কমানোর আহ্বান জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘তেহরান এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার আগাম বার্তা দিয়েছিল এবং এতে কেউ হতাহত হয়নি।’
এদিকে, ইরানের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ জানিয়েছে, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের ‘আগ্রাসী ও উদ্ধত’ হামলার জবাবে তারা এই হামলা চালিয়েছে।
নিরাপত্তা পরিষদ আরো জানায়, ইরান থেকে যতগুলো ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তার আগের হামলায় ঠিক ততগুলো বোমা ব্যবহার করেছিল। অর্থাৎ প্রতিক্রিয়াটি ছিল সামঞ্জস্যপূর্ণ, উত্তেজনা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে নয়।
আন্তর্জাতিক সংকট সংস্থার জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আলি ভায়েজ এএফপি’কে বলেন, ‘এই হামলাটি এমনভাবে পরিকল্পিত ও পরিচালিত হয়েছিল, যাতে কোনো মার্কিন সেনা হতাহতের ঘটনা না ঘটে। ফলে উভয় পক্ষের জন্যই একটি সমঝোতার পথ খোলা রয়েছে।’
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্র ইসরাইলের সঙ্গে যৌথভাবে ইরানের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয়। যুক্তরাষ্ট্র শনিবার রাত থেকে রোববার ভোর পর্যন্ত ইরানের ভূগর্ভস্থ পারমাণবিক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রসহ আরো দু’টি পারমাণবিক স্থাপনায় বাংকার-বাস্টিং বোমা নিক্ষেপ করে।
ইসরাইলের অভিযান এবং মার্কিন হামলার কারণে পরিস্থিতির অবনতিতে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকলে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেন, ‘বিশৃঙ্খলার এই ধারা থামাতেই হবে।’
এদিকে চীনও হুঁশিয়ারি করে জানিয়েছে, এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
‘স্পষ্ট আগ্রাসন’ বলে অভিযোগ কাতারের: ইরান দাবি করেছে, মার্কিন ঘাঁটিকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়েছে, কাতারের বিরুদ্ধে নয়।
তবে দোহা এ হামলাকে ‘স্পষ্ট আগ্রাসন’ বলে অভিযোগ এনে বলেছে ‘আমাদেরও পাল্টা জবাব দেওয়ার অধিকার রয়েছে যা ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ’ হবে।’
এদিকে, ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানায়, ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী ‘আল উদেইদ’ ঘাঁটিতে ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছে।
কাতার জানিয়েছে, ঘাঁটিটি আগেই খালি করে ফেলা হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের এক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা জানান, ওই হামলায় স্বল্প ও মধ্যপাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে।
এএফপি সাংবাদিকরা সোমবার সন্ধ্যায় দোহার মধ্যাঞ্চলে ও রাজধানীর উত্তরে লুসাইলে বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন এবং রাতের আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র উড়তে দেখেছেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের ফুটেজে দেখা গেছে, তেহরানের মধ্যাঞ্চলে বহু মানুষ পতাকা নিয়ে জড়ো হয়েছে এবং ‘আমেরিকানদের মৃত্যু চাই’ বলে স্লোগান দিয়েছে।
এদিকে, কাতার ‘আঞ্চলিক পরিস্থিতির’ কারণে সাময়িকভাবে তার আকাশসীমা বন্ধ করে দেয়।
যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসসহ অন্যান্য বিদেশি মিশন তাদের নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করার নির্দেশ দেয়।
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরাইলি হামলায় ইরানে ৪শ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অপরদিকে, ইরানের হামলায় ইসরাইলে ২৪ জন মারা গেছে বলে দেশটির সরকারি হিসাব থেকে জানা গেছে।
দুই দেশের মধ্যে দিনভর পাল্টাপাল্টি ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর মধ্যরাতে ইসরাইলি সেনাবাহিনী তেহরানের কিছু অংশের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিতে বলে। তাদের লক্ষ্য, ‘ইরানের সামরিক স্থাপনা’।