অটিজম সচেতনতা

ময়ূরাক্ষী সেন

তাসনিমা ও সোহেলের একমাত্র ছেলে অয়ন। বয়স চার হবে কিন্তু এই বয়সের অন্যান্য বাচ্চার মতো সে গুছিয়ে কথা বলতে পারে না। কথার বলার সময় অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। খেলাধুলার প্রতি তার কোনো আগ্রহ নেই, সে সবসময় চুপচাপ ও একা থাকে। প্রথমদিকে তাসনিমা ও সোহেল বিষয়টি তেমন গুরুত্ব দেননি। কিন্তু দিন যত যাচ্ছে অয়নের সমস্যাগুলো আরো বেশি চোখে পড়ছে। এরপর তারা অয়নকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান, চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর তাদের জানান অয়নের মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা রয়েছে। যাকে অটিজম বলা হয়। শুধু অয়ন না, বিশ্বজুড়ে অনেক অটিজম শিশু জন্ম নিচ্ছে। ২ এপ্রিল বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় অটিজম সচেতনতা দিবস। এই দিনটিতে জাতিসংঘ অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আক্রান্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণে উৎসাহিত করে।

অটিজম কি

সহজ ভাষা অটিজম হলো মস্তিষ্কের এক ধরনের ত্রুটি। যার ফলে একজন শিশু শারীরিকভাবে বৃদ্ধি পেলেও মানসিকভাবে বৃদ্ধি পায় না। জন্মের পরপরই অটিজম শিশুদের সমস্যা শনাক্ত করা যায় না। কারণ শারীরিকভাবে তারা সম্পূর্ণ অন্যান্য স্বাভাবিক শিশুদের মতোই থাকে। জন্মের প্রথম তিন মাস শিশুর মধ্যে কোনো অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় না।

অটিজমের কারণ

বিশেষজ্ঞরা অটিজমের সঠিক কারণ বের করতে পারেনি। তবে ধারণা করা হয় জিনগত ও পরিবেশগত সমস্যার কারণেই অটিজম শিশু জন্ম নিয়ে থাকে। পরিবেশের বিষাক্ত উপাদান শিশুর স্নায়ু কোষের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। কিছু বিষাক্ত উপাদানের জন্য গর্ভের শিশুর স্নায়ু কোষে নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। ধারণা করা হয় মার্কারি, লেড, পোকামাকড় মারার বিষ, খাদ্য সংরক্ষণ করার রাসায়নিক দ্রব্য, খাদ্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধির কৃত্রিম রঙ ইত্যাদি অটিজম শিশু জন্ম নেওয়ার জন্য দায়ী। গর্ভে থাকা অবস্থায় মা কিংবা শিশু কেউ যদি কোনো ভাইরাস কিংবা ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আক্রান্ত হয় তাহলে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। রুবেলা ভাইরাস এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া গবেষণায় আরো কিছু কারণ উঠে আসলেও অটিজমের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাওয়া গেলে হয়তো অটিজম শিশুর জন্ম নেওয়া কিছুটা হলেও কমানো যেত।

অটিজমের লক্ষণ

অটিজম শিশু তার ত্রুটি নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কিন্তু জন্মের পর পরই এ সমস্যা শনাক্ত করা যায় না। জন্মের পর থেকে অন্তত তিন বছর সময় লাগে এ রোগ শনাক্ত হতে। কারো ক্ষেত্রে আগে শনাক্ত হয়ে যায় কারোও তিন বছরের একটু বেশি সময় লাগে। শিশুর মধ্যে অস্বাভাবিকতা সাধারণত বাবা মায়েরা সহজে লক্ষ্য করতে পারে না। ফলে চিকিৎসা গ্রহণ করতে ও রোগ শনাক্ত হতে কিছুটা দেরি হয়ে যায়। বেশিরভাগ শিশু এক থেকে দুই বছরের মধ্যে কিছু কিছু শব্দ বলা শিখে যায়। অটিজমের ক্ষেত্রে শিশুরা বয়স পার হয়ে যাবার পরেও কথা বলে না। কথা বললেও তা হয় খুব অস্পষ্ট। শিশুরা খেলতে ও অন্য শিশুদের সঙ্গ পছন্দ করে, কিন্তু অটিজম শিশুরা অন্য বাচ্চাদের সাথে মিশতে চায় না। খেলাধুলার প্রতি তাদের আগ্রহ থাকে না। তাদের খেলনা দেওয়া হলে তা তারা দূর থেকে দেখে কিন্তু তার কাছে যায় না কিংবা ধরে দেখে না। কেউ ডাক দিলে সাড়া দেয় না এবং কেউ যদি তার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে তাহলে তার চোখের দিকে না তাকিয়ে সে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। অটিজম শিশুদের মধ্যে পুনরাবৃত্তিমূলক আচরণ লক্ষ্য করা যায়। যেমন নির্দিষ্ট কিছু খাবার ছাড়া তারা খেতে চায় না, নির্দিষ্ট কিছু মানুষ ছাড়া তার কথা বলে না, নির্দিষ্ট কিছু খেলা বারবার খেলতে থাকে ও একই অঙ্গভঙ্গী বারবার করে। অটিজম শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বাবা-মায়েরা অন্যান্য লক্ষণ এড়িয়ে গেলেও কথা বলা যখন বন্ধ করে দেয় কিংবা একদমই কথা বলে না তখন সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসকের কাছে যান।

অটিজম শনাক্তে পরীক্ষা

কোনো একটি নির্দিষ্ট পরীক্ষার মাধ্যমে অটিজম শনাক্ত করাও যায় না। রক্ত পরীক্ষা কিংবা কোনো টেস্ট নেই যার ফলাফল দেখে অটিজম শনাক্ত করা যায়। বুদ্ধিমত্তা এবং কিছু আচরণগত সমস্যার লক্ষ্য করে একজন চিকিৎসক তাকে অটিজম বলেন। অনেক সময় লক্ষণ দেখা না দিলে এ  রোগ শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় তিন বছরের আগে পুরোপুরি অটিজম লক্ষণ প্রকাশ পায় না।

অটিজমের চিকিৎসা

অটিজম শিশুর চিকিৎসা কেমন হবে তা নির্ভর করছে তার লক্ষণের উপর। এ ধরনের শিশুদের চিকিৎসা দিয়ে থাকেন নিউরোলজিস্ট ও শিশু মনোরোগবিদ। ডাক্তার এবং মনোবিজ্ঞানী দুজনের সমন্বয়ে এ রোগের চিকিৎসা করা হয়ে থাকে। রোগ শনাক্তের পর অনেক বাবা মায়েরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। সেক্ষেত্রে অটিজম শিশুদের মা-বাবারও থেরাপি ও কাউন্সিলিং প্রয়োজন। অটিজম শিশুদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে খুব বেশি ওষুধ ব্যবহার করা হয় না। অটিজম শিশুর কথা বলার সমস্যা থাকে তাই তাদের স্পিচ থেরাপি দেওয়া হয়। কাউন্সিলিংয়ের পাশাপাশি আরও বিশেষ কিছু থেরাপি ও ব্যায়াম করানো হয়। অনেক অটিজম শিশুর খিঁচুনি  ও ঘুমের সমস্যা থাকে। সে ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চিকিৎসক ওষুধের পরামর্শ দিয়ে থাকেন।

সমাজের বোঝা না

দুঃখজনক হলেও সত্য যে অটিজম কখনো পুরোপুরি ভালো করা সম্ভব না। চিকিৎসা ও ঔষধের মাধ্যমে শুধুমাত্র নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। তবে আশার কথা হচ্ছে অনেক মানুষ অটিজমের সঠিক চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। কিন্তু আমাদের সমাজে আজও অটিজমরা অবহেলিত। বাংলাদেশে তাদের জন্য অনেক সচেতনতামূলক কথা বলা হলেও এখনো তাদের জন্য সঠিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তারা অন্য স্বাভাবিক শিশুদের সাথে সঠিকভাবে মিশে উঠতে পারে না। তাদের জন্য কিছু অটিজম স্কুল থাকলেও এর সংখ্যা খুবই কম।

অটিজম ব্যক্তি যদি কোথাও যায় তাকে বাঁকা চোখে দেখা হয় এবং শিশুদেরকে নানারকম কটূ কথা বলা হয়। কুসংস্কার অনুযায়ী বিশ্বাস করা হয় যে বাবা-মায়ের পাপ কাজ কিংবা অভিশাপ হিসেবে অটিজম শিশু জন্ম নেয়। ফলে অটিজম শিশু জন্ম নিলে সেই পরিবারকে সবাই এড়িয়ে চলে। কিন্তু মনে রাখতে হবে অটিজম কোনো রোগ নয় এটি একটি জন্মগত ত্রুটি। এর জন্য সন্তান কিংবা বাবা-মা কেউই দায়ী না।

অটিজম নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। শুধু সরকারি কিংবা বেসরকারি সংস্থা থেকে নয় যে যার স্থান থেকে অটিজম শিশুদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। একজন অটিজম শিশুর পরিবারও আতঙ্কিত এবং মানসিকভাবে বিধ্বস্ত থাকে তাই তাদেরকেও সহযোগিতা করতে হবে ও মানসিক সাহস দিতে হবে।

বাবা মায়ের করণীয়

শিশুর মানসিক বিকাশে ত্রুটি রয়েছে তা জেনে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। কারণ মনে রাখতে হবে আপনি একা নন পুরো বিশ্বজুড়ে হাজারো বাবা-মায়ের সন্তানেরা অটিজম হয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করছে। অটিজমের কোনো লক্ষণ দেখলে আতঙ্কিত হবার কিছু নেই কারণ অনেক সময় স্বাভাবিক শিশুর মধ্যেও কিছু অস্বাভাবিক লক্ষণ থাকতে পারে তার মানে এই নয় যে সে অটিজম। তবে নিশ্চিত হবার জন্য শিশুকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান এবং অটিজম শনাক্ত হলে মাথা ঠান্ডা রেখে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা উচিত। চিকিৎসক এবং বাবা-মায়ের প্রচেষ্টায় অনেক অটিজম শিশুরা এখন ভালো আছে।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: স্বাস্থ্য কথা

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

three − 2 =