অনুপম-পিয়া-পরমব্রত: ত্রিভুজ প্রেম নাকি প্রতারণা

মৌ সন্ধ্যা

গানের কথার সঙ্গে জীবনের গল্প মিলে যাবে। এটা খুব স্বাভাবিক। কারণ গান জীবনের কথা বলে। যে গান যার জীবনের সঙ্গে মিলে যায় তার কাছে সেই গান হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী। একই গান কাউকে ভাসায় আনন্দের জোয়ারে কাউকে কাতর করে দেয় ব্যথায়। কখনো কখনো মনের ব্যথা সারিয়ে দেয় গান।

প্রেম-বিচ্ছেদ, সংসার জীবনের মান অভিমান, খুনসুটি এসব উঠে আসে গানে। গানের মানুষেরা সব সময় গানে নিজের গল্পই বলেন তেমন নয়। চারপাশের মানুষের বাস্তব জীবনের গল্পও উঠে আসে গানে গানে। কিন্তু যখন কোনো গানস্রষ্ঠার নিজের গানের গল্প নিজের জীবনের সঙ্গে মিলে যায় তখন সেসব গানের আবেদন বেড়ে যায় আরও অনেক বেশি। বেড়ে যায় সেসব গান নিয়ে আলোচনা।

অনুপম-পিয়ার বিয়ে

২০১৫ সালের ৬ ডিসেম্বর বিয়ে করেছিলেন কলকাতার সংগীত পরিচালক-গায়ক অনুপম রায় এবং সমাজসেবী-গায়িকা পিয়া চক্রবর্তী। অনুপম-পিয়া সামাজিকভাবেই বিয়ে করেছিলেন। বড় পরিসরে হয়েছিল তাদের বিয়ের আয়োজন। বিয়ে রেজিস্ট্রির পর অগ্নিসাক্ষী করে অনুপমের হাতে সিঁদুর পরেছিলেন পিয়া। তার পরনে ছিল প্রচুর গয়না এবং লাল বেনারসি। চেলির জায়গায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনেছিলেন পিয়া। অনুপমও বাঙালি পুরুষদের বিয়ের চিরাচরিত পোশাক ‘জোড়’ পরে বিয়ে করেছিলেন পিয়াকে। আত্মীয়-স্বজন, প্রিয়জন এবং গুরুজনদের সঙ্গে নিয়ে সারাজীবন একসঙ্গে থাকার শপথ নিয়েছিলেন অনুপম-পিয়া। কিন্তু অদৃষ্টের লিখন ছিল ভিন্ন।

অর্ধ যুগের সংসার তাদের

অনুপম-পিয়ার দীর্ঘ ছয় বছরের বৈবাহিক সম্পর্কের ইতি ঘটে ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে। সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ত্রী পিয়া চক্রবর্তীর সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন গায়ক-কম্পোজার অনুপম রায় নিজেই। অনুপম লিখেন, ‘আমরা, অনুপম ও পিয়া দুজনে মিলে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তবে স্বাধীনভাবে বন্ধু হিসেবে থাকব আমরা। আমাদের এই যাত্রা ছিল নানা অভিজ্ঞতা আর সুন্দর স্মৃতিতে ভরা। যদিও ব্যক্তি হিসেবে মতপার্থক্যর কারণে, আমরা ভেবেছি স্বামী-স্ত্রী হিসেবে আমাদের ভিন্ন হয়ে যাওয়াই আমাদের জন্য মঙ্গল। আগেও যেমন ভালো বন্ধু ছিলাম আমরা তেমনই থাকব। একে অন্যের সঙ্গে জুড়ে থাকব সব সময়।’ সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে অনুপম লেখেন, ‘আমরা অনুরোধ করব সবাইকে গোটা বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে লালন করে এই পরিবর্তনকে আমাদেরও গোপনীয়তা ও সম্মানের সঙ্গে অনুধাবন করতে সাহায্য করার।’ বছর কয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে পিয়া বলেছিলেন, বাংলা ব্যান্ড চন্দ্রবিন্দুর প্রতি দুজনের প্রগাঢ় প্রেমই কাছে নিয়ে এসেছিল তাদের। বৈবাহিক সম্পর্ক ঘুচেছে ঠিকই, তবু বন্ধুত্ব রয়ে যাবেই বলে আশ্বাস গায়কের। কিন্তুু তাদের ডিভোর্সের দুই বছরের মাথায় ঘটলো আরও একটি ঘটনা।

পিয়ার জীবনে নতুন মানুষ

অনুপমের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন পিয়া। সে সময় অনুপমের প্রিয় বন্ধু অভিনেতা-পরিচালক-প্রযোজক পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় পিয়া’র। অনেকেই বলেন সেই সম্পর্কের কারণেই নাকি বিয়ে ভাঙে অনুপম-পিয়ার। তবে পরমব্রত ও পিয়া অনেকদিন তাদের এ সম্পর্কের কথা স্বীকার করেননি।

সাত পাকে বাঁধা পড়লেন পরমব্রত-পিয়া

অবশেষে সব গালগল্প সত্য প্রমাণিত হয় ২০২৩ সালের ২৭ নভেম্বর। ওই দিন সকালেই খবর আসে পরমব্রতকে বিয়ে করবেন পিয়া। আসলে ততক্ষণে বিয়ে সেরে ফেলেছেন তারা। ২৭ নভেম্বর পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে সেরেছেন পিয়া চক্রবর্তী। তাদের বিয়ে নিয়ে চারিদিকে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়। তবে এই সবকিছুর মাঝে যার নাম বারবার উঠে আসে তিনি সংগীতশিল্পী অনুপম রায়। এই বিয়ে নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে মরিয়া হয়ে ওঠে প্রত্যেকেই।

বিয়ের পরের রাতেই হাসপাতালে পিয়া

বিয়ের পরের রাতেই পেটের অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালে ছুটতে হয় পিয়া চক্রবর্তীকে। কিডনির পাথর অপারেশন হয় তার। এরপর সুস্থ হয়ে বাড়িও ফিরে আসেন পরমের স্ত্রী। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেই আপডেট নিজেই দেন নববধূ। আপাতত সব ধকল কাটিয়ে ফ্যামিলির সঙ্গে স্বস্তিতে রয়েছেন পিয়া চক্রবর্তী। সম্প্রতি পরমব্রত এবং পিয়া মধুচন্দ্রিমা করতে দেশের বাইরে গিয়েছেন। ডাবলিন থেকে ছবি শেয়ার করেছেন পিয়া।

প্রাক্তনের বিয়ের পর অনুপমের মন্তব্য

পিয়া চক্রবর্তীর দ্বিতীয় বিয়ের পর নেটিজেনদের বুলিংয়ের শিকার হয়েছে অনুপম, পরমব্রত ও পিয়া তিনজনই। বিশেষ করে অনুপমের গাওয়া প্রাক্তন সিনেমার গানটিই ছুড়ে দেওয়া হয়েছে তার দিকে। সবাই বলছে ‘তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর’ গানের কথাগুলো বুঝি পিয়ার উদ্দেশ্যেই গেয়েছিলেন গায়ক। এদিকে প্রাক্তন স্ত্রী পিয়ার বিয়ের খবর শোনার পর বাবা-মাকে নিয়ে ভাইজ্যাকে চলে গিয়েছিলেন অনুপম। সেখানে গিয়ে সমুদ্রের পাড়ে সময় কাটিয়ে এসেছেন তিনি।

অনুপম রায় কি এখন একা

অনুপম ভক্তরা তার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে চলেছেন নানাভাবে। পরমব্রত ও পিয়াকে নানা ভাবে দুষছেন। অনুপমের একা হয়ে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না। আসলেই কি একা আছেন অনুপম রায়। নাকি নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছেন তিনি! ২০২৩ সালের মে মাসে বেশকিছু গণমাধ্যমে খবর আসে পিয়ার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর গায়িকা প্রশ্মিতা পালের প্রেমে মজেছেন অনুপম রায়। টলিউডে জোর গুঞ্জন এ নিয়ে। নির্মাতা রাজ চক্রবর্তীর ‘বোঝে না সে বোঝে না’ সিনেমায় গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন প্রশ্মিতা। ‘শুধু তোমারই জন্য’, ‘কণ্ঠ’, ‘পোস্ত’সহ একাধিক সিনেমার জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তিনি। প্রশ্মিতা অনুপমের সুরেও গান গেয়েছেন। ‘হাইওয়ে’ সিনেমায় অনুপমের সুর করা ‘তোমায় নিয়ে গল্প হোক’ গানটি গেয়েছিলেন প্রশ্মিতা। কাঠমান্ডু ছবির ‘মন আমার’ গানটি অনুপমের সুরে দুজনে গেয়েছিলেন একসঙ্গে।

এছাড়াও দুজনেই ভারতীয় বাংলা গানের জগতে পরিচিত নাম। তাই বন্ধুত্ব হওয়া অস্বাভাবিক নয়। অনুপমের মতোই প্রশ্মিতাও আগের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে এসে আপাতত সিঙ্গেল। এ কারণেই তাদের এই ঘনিষ্ঠতা দেখে জোর গুঞ্জন সেই বন্ধুত্ব কিছুটা হলেও এগিয়েছে সম্পর্কের দিকে! এই গুঞ্জনকে কিছুটা হলেও ইন্ধন দিয়েছে অনুপম রায়ের জন্মদিনের অনুষ্ঠান। অনুপমের জন্মদিনে তার হাতেগোনা বন্ধুদের মধ্যে হাজির ছিলেন প্রশ্মিতাও। সত্যিই কি গায়িকার প্রেমে পড়েছেন অনুপম? এ বিষয়ে এই গায়কের জবাব, প্রশ্মিতাকে তিনি এক দশক ধরে চেনেন, এটা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব।

শেষকথা

সিনেমাতে দেখা যায় এমন – এক নায়িকাকে পাওয়ার জন্য দুই নায়কের তুমুল লড়াই। পুরো সিনেমা জুড়ে থাকে টান টান উত্তেজনা। দর্শক আগ্রহ ভরে অপেক্ষা করতে থাকে শেষে নায়িকা কার হবে সেটা দেখার জন্য। হয়তো অনুপম ও পরব্রতর মধ্যে একরকম মানসিক লড়াই চলেছে সব সময়। অনুপম হয় তো কখনই কল্পনা করেননি তার প্রিয়বন্ধুর কাছে চলে যাবে তার প্রিয়তমা স্ত্রী। দুম করে বন্ধুর স্ত্রীর প্রেমে পড়ে যাওয়া ঠিক হলো কি না এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন পরমব্রত। কেউ কেউ এই অভিনেতাকে প্রতারক বলতেও ছাড়েননি। তাই বলে বন্ধুর বউকে ভাগিয়ে নিয়ে বিয়ে! হঠাৎ করেই পরমব্রতর গলায় প্রিয়ার মালা পরানোর দৃশ্য হজম করতে বেশ কষ্টই হয়েছে অনুপম ভক্তদের। এই নব দম্পতির বিয়ের ছবিতে শুভেচ্ছার পাশাপাশি জুটেছে সমালোচনা।

সর্বশেষ কৌশিক গাঙ্গুলির ‘অর্ধাঙ্গিনী’ সিনেমার জন্য একটি গান তৈরি করেন অনুপম রায়। গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন ইমন চক্রবর্তী। সম্প্রতি গানটির কয়েকটি লাইন গেয়ে ফেসবুকে পোস্ট করেন অনুপম। এরই মধ্যে গানটি ছড়িয়েছে ব্যাপকভাবে। অনুপমের এই নতুন গান যেন তারই জীবনের প্রতিচ্ছবি। গানের কথাগুলো এমন:

‘আমি আবার ক্লান্ত পথচারী/ এই কাঁটার মুকুট লাগে ভারী,/ গেছে জীবন দুদিকে দু’জনারই/ মেনে নিলেও কি মেনে নিতে পারি?/ ছুঁতে গিয়েও যেন হাতের নাগালে না পাই/ এভাবে হেরে যাই, যেই ঘুরে তাকাই/ কেমন যেন আলাদা আলাদা সব,/ আলগা থেকে তাই, খসে পড়েছি প্রায়/ কেমন যেন আলাদা আলাদা সব।/ কুয়াশা ভেজা নামছে সিঁড়ি/ অনেক নিচে জল,/ সেখানে এক ফালি চাঁদ ভাসছে/ করছে টলমল।/ তাকে বাঁচাব বলে, জলে নেমেও/ বাঁচাতে পারি না।/

শিল্পীরা এমনই হন, জীবনের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়েও জীবনের কথা বলে চলেন তারা। জীবনের ঘটে যাওয়া সব ঘটনার রঙ ফিকে হয়ে যায়। শুধু থেকে যায় শিল্প, থেকে যায় গান অভিনয়। সবাই ভালো থাকুক যে যার মতো। আর জয় হোক শিল্পের। জীবন বয়ে যাবে তার গতিতে। প্রকৃতি ঠিক জানে কার জন্য পুরস্কার ও কার জন্য শাস্তি।

লেখাটির পিডিএফ দেখতে চাইলে ক্লিক করুন: হলি বলি টলি

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

12 − 12 =